অভিধা হিসেবে ‘আধুনিকতা’র কোনো একটা অর্থ নেই। এর প্রয়োগক্ষেত্রও হতে পারে নানা রকম। ধর্মীয় আন্দোলন ও সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে কিংবা শিল্প সাহিত্য স্থাপত্য ভাস্কর্য ও সংস্কৃতির আরো নানা ক্ষেত্রে ‘আধুনিকতা’ শব্দের বিভিন্ন মাত্রা লক্ষ করা যেতে পারে। তবে এই শব্দ প্রয়োগের এক প্রধান ক্ষেত্র নিশ্চয়ই সমাজ রূপান্তর। পাশ্চাত্য সমাজের ইতিহাস আলোচনায় পঞ্চদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে মোটামুটি আধুনিকতার সূত্রপাত বলে ধরা হয়। ইউরোপীয় রেনেসাঁসকে অনেকেই এই আধুনিকতার প্রথম দিক চিহ্ন বলে মনে করেন। কিন্তু রেনেসাঁস ঠিক আধুনিকতার অন্তর্গত, না তার সমীপবর্তী, এ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তার কারণ যে সব প্রধান চরিত্রলক্ষণ দিয়ে আধুনিকতাকে সাধারণত চিহ্নিত করা হয়ে থাকে, তার অনেক কিছুর আভাস হয়তো রেনেসাঁস পর্বে টের পাওয়া যায়, তবে তখনো সেগুলি তেমন পূর্ণ বিকশিত চেহারা অর্জন করেনি।
আধুনিকতা এক প্রধান চরিত্রলক্ষণ ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা। সমাজের একক হিসেবে গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের বদলে ব্যক্তির স্বীকৃতি আধুনিকতায় উত্তরণের পথে একটি বড়ো ধাপ। প্রাগাধুনিক সমাজে ব্যক্তির বিকাশ ছিল স্বভাবত রুদ্ধ। সমাজ সংগঠনে ও সামাজিক স্বীকৃতিতে ব্যক্তির বদলে গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের প্রাধান্য তখনো অবিসংবাদিত । কৌম জীবনের আচার-আচরণ ও বিধিনিষেধের মধ্য দিয়েই তখন সমাজজীবন প্রধানত নিয়ন্ত্রিত হত। ব্যক্তির সিদ্ধান্ত প্রয়োগের পরিসর প্রায় ছিল না বললেই চলে। এরকম অবস্থায় ব্যক্তির অধিকারের ধারণাও স্বভাবতই বিস্তার লাভ করতে পারে। মানুষ তখনো তার সমাজসত্তায় ব্যক্তিতে রূপান্তরিত হতে পারেনি। যুক্তিতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা সে-রূপান্তরে খুব জরুরি ছিল। প্রকৃতিবিজ্ঞানের অগ্রগতি ও প্রযুক্তির বিস্তার মানুষের মনে যুক্তিবাদিতাকে আরো গ্রাহ্য করে তোলে। প্রথা প্রচলন ও শাস্ত্রবচনের পরিবর্তে এল যুক্তি তথ্য প্রমাণ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা। আধুনিক মননের এই লক্ষণ থেকে গড়ে উঠল নতুন আদলের জ্ঞানবিজ্ঞান।
ব্যক্তির উত্তরণে আনুষঙ্গিক সহায়ক প্রক্রিয়াগুলির মধ্যে ছিল শিল্পায়ন, নগরায়ণ, শ্রম বিভাজন, সাধারণ আইনি তন্ত্রের প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি প্রকরণ। কালে কালে এই সব মিলিয়ে নতুন যে জীবনবৃত্ত গড়ে উঠল তাকেই আধুনিক সমাজের চরিত্রলক্ষণ বলে ৫৫ নির্দেশ করা হয়। এই সমাজে কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সমাজজীবনের বদলে শিল্পপ্রযুক্তিভিত্তিক নগরজীবন ক্রমশ প্রধান হয়ে ওঠে। রূপান্তরের এই প্রক্রিয়ার পর্বে পর্বে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি ও গোষ্ঠীর আপেক্ষিক অবস্থান ও প্রাধান্যেরও পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। গ্রামীণ সমাজে ছিল জমি ও ভূস্বামীর প্রাধান্য, সমাজের অন্যান্য স্তর ছিল অনেকেটাই অধস্তন অবস্থায়। আধুনিকতায় রূপান্তরের পর্বে এই শ্রেণি-অবস্থানে বড় রকমের বদল ঘটে। ১৭৮৯-এর ফরাসি বিপ্লব এই বদলে এক নতুন মাত্রা সংয়োজন করে। রাতারাতি কোনো একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে নিশ্চয়ই এত বড়ো একটা রূপান্তর সাধিত হয়নি। কিন্তু ক্রমে ক্রমে ভূস্বামী শ্রেণির রাজনৈতিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্য খর্ব করে তার জায়গায় একদিন এল বণিক শ্রেণির প্রাধান্য এবং তারই সূত্র ধরে একদিন প্রতিষ্ঠিত হলো শিল্পপুঁজির অবিসংবাদী প্রভাব । ছকটা অবশ্যই এরকম নির্দ্বন্দ্ব ছিমছাম ছিল না কখনো।
আধুনিকতার বিবর্তন পথ বিভিন্ন দেশে ও বিভিন্ন সমাজে নানা বৈচিত্র্যে ভরা। আধুনিকতার সময়কালও বিভিন্ন সমাজে বিভিন্ন রকমের। কোনো সমাজেই এই রূপান্তর খুব নিরুপদ্রব ও মসৃণ ছিল না। আধুনিকতার যাত্রাপথে দেখা দিয়েছে নানা সংকট ও সংঘর্ষ। দেশে দেশে সেখানেও আছে নানা ভিন্নতা।
আধুনিক শিল্পোন্নত পৃথিবীর ইতিহাসে উপনিবেশের বিস্তার এক প্রধান অভিজ্ঞতা। বিভিন্ন পাশ্চাত্য শক্তির প্রতিষ্ঠিত উপনিবেশসমূহে আধুনিকতা দেখা দিয়েছিল পশ্চিমি অভিঘাতে। আধুনিক শিল্প, কলকারখানার প্রতিষ্ঠা ও রেলপথ, ডাক-তার ইত্যাদি ব্যবস্থার প্রসাবের মাধ্যমে যে আধুনিকতা দেখা দিচ্ছিল তার ফলে এইসব সমাজের শিক্ষাব্যবস্থা ও ভাষা, ধর্ম ও সংস্কৃতি পর্যন্ত নানা টানাপোড়েনের সম্মুখীন হলো। প্রথাগত বিভিন্ন ধরনের ধর্মীয় ও সামাজিক রাজনীতির উচ্ছেদ ও সংস্কারকে কেন্দ্র করে আধুনিকতার রূপান্তর পর্বে দেখা দিয়েছে বিস্তর সংঘাত ও সংঘর্ষ । আমাদের এখানকার সতীদাহ উচ্ছেদ, বিধবাবিবাহ প্রচলন ও ইংরেজি শিক্ষার প্রসার ইত্যাদি কর্মকাণ্ডের মধ্যে এই সংকটের ইতিহাস লিপিবদ্ধ আছে।
সমাজ রূপান্তরের বিশেষ একটা পর্বকে যদি বলা হয় আধুনিক, আর সেই পর্বের কিছু সামান্য লক্ষণকে যদি বলা হয় আধুনিকতা, তাহলে সেইসব লক্ষণকে আমরা আমাদের সমাজবয়ানে যেভাবে ব্যবহার করি, তাকে বলা যেতে পারে আধুনিকতাবাদ। আধুনিকতায় উত্তীর্ণ সমাজের লক্ষণগুলিকে যদি আমরা কিছুটা শ্রেষ্ঠত্ব আরোপ করি, তাহলে প্রাগাধুনিক সমাজের তুলনায় আধুনিক সমাজ উৎকৃষ্ট বলে বিবেচিত হবে। এ গেল সময়ান্তরের ভালোমন্দের কথা। একই সময়ে আধুনিক আর অনাধুনিকের মধ্যেও অনুরূপ শ্রেষ্ঠ-নিকৃষ্ট বিচারের প্রয়োগ সম্ভব। এই প্রক্রিয়ায় আধুনিকের দৃষ্টিকোণ থেকে অনাধুনিক বা প্রাগাধুনিক প্রগতির পরিপন্থী। আধুনিকতাবাদের এই প্রয়োগের দিকে একটা দাপটের সম্ভাবনা থেকে যায়। শ্রেষ্ঠ নিকৃষ্ট মানদণ্ডে একবার পৌঁছতে পারলে সমাজবিন্যাসে আধুনিকতার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা তখন খুব স্বাভাবিক হয়ে দেখা যায়। আধুনিকতার এই প্রতিষ্ঠা পর্বে আধুনিক বা প্রাগাধুনিকের অনেক কিছু চূর্ণ হয়ে যেতে পারে। আধুনিকের নজরে আধুনিকতার সিদ্ধির সম্ভাব্য কোনো কিছু মাত্রা তখন আর স্বীকৃতি পায় না। এই জায়গা থেকে গড়ে ওঠে আধুনিকতার বিরুদ্ধ প্রতিক্রিয়া, প্রতিরোধ ও নানা সমালোচনা। তাই আধুনিকতা সমালোচনা আধুনিকতারই সমবয়সী। এক কালের রোম্যান্টিকতাবাদ থেকে আরম্ভ করে আজকের উত্তর আধুনিকতাবাদ পর্যন্ত এই সমালোচনা ও প্রতিক্রিয়ার এক বিস্তৃত ধারা বর্তমান।
পেইন্টিঙয়ের ইতিহাসঃ নিবন্ধে ব্যবহৃত পেইন্টিংটি অঁরি মাতিসের (১৮৬৯ – ১৯৫৪) ডান্স বা নাচ যেটি আঁকা মুক্তি, যেটি আঁকা হয়েছিল ১৯১০ সালে।
তথ্যসূত্র:
১.সুধীর চক্রবর্তী; বুদ্ধিজীবীর নোটবই, নবযুগ প্রকাশনী, বাংলাবাজার, ঢাকা, প্রথম সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ২০১০, পৃষ্ঠা, ৫৮-৫৬।
রোদ্দুরে ডট কমে অতিথি লেখক হিসেবে রাজনৈতিক বিশ্লেষণ, কলাম, অনুবাদ, নিবন্ধ ও প্রবন্ধ লেখায় সম্মতি জ্ঞাপন করেছেন পূরবী সম্মানিত, ইভান অরক্ষিত, রনো সরকার এবং রণজিৎ মল্লিক। এছাড়াও আরো অনেকের লেখা এখানে প্রকাশ করা হয়।