উত্তর আধুনিকতাবাদ বা উত্তর আধুনিকবাদ বা উত্তরাধুনিকতাবাদ বা উত্তরাধুনিকবাদ বা আধুনিকোত্তরবাদ (ইংরেজি: Postmodernism) একটি বিস্তৃত আন্দোলন যা বিংশ শতাব্দীর মধ্য থেকে শেষভাগের দর্শন, চারুকলা, স্থাপত্য এবং সমালোচনার ক্ষেত্রে বিকশিত হয়েছিল এবং আধুনিকবাদ থেকে বিদায়কে চিহ্নিত করেছিল। আধুনিকতা এবং সেই যুগের প্রবণতাকে অনুসরণ করে আবির্ভূত উত্তর আধুনিকতাবাদ শব্দটি সাধারণত ঐতিহাসিক যুগ বোঝাতে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে। এই মতবাদটি সাম্রাজ্যবাদী-উপনিবেশবাদী সময়ের প্রাধান্যকারী প্রতিক্রিয়াশীল গণবিরোধী ধারা যা সামরিক-সাম্রাজ্যবাদী সন্ত্রাসবাদী রাষ্ট্রগুলোর বুদ্ধিজীবীরা প্রচার করে।
উত্তর আধুনিকবাদ মূলত সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদবিরোধী চিন্তাধারা। উত্তর আধুনিকতাবাদীদের একটি প্রবণতা হচ্ছে বস্তু জগৎকে বুঝার ক্ষেত্রে কোনো নিয়মনীতি ধারাবাহিকতা এমনকি কোনো কার্যকারণ বা ‘কজ এন্ড এফেক্ট’ রূপ কোনো অনিবার্যতার সম্পর্ককে অস্বীকার করার প্রবণতা। সব কিছু সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন, কোনো কিছুই কোনো কিছুর সাথে সম্পর্কিত নয়। অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে কোনো কিছুই কোনো কিছুই নয় এরূপ একটি নেতিবাচক ভাবের প্রচার করা।[১]
পোস্ট-মডার্নিজম বলতে বোঝানো হয় আধুনিক-বাদ পরবর্তী দর্শন। এই দর্শন বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করতে চায় জীবন-জগৎ-ইতিহাস-সংস্কৃতি। এর পরিধিতে রয়েছে স্থাপত্য, সাহিত্য, ভাষা, চিত্রকলা, চলচ্চিত্র, ভিডিও, নৃত্য, সংগীত, ক্ষমতা, রাষ্ট্রশক্তি, মার্কসবাদ, যাবতীয় পূর্ববর্তী দর্শনচিন্তাও। তবে, প্রসঙ্গত একথা মনে রাখতে হবে যে, উত্তর-আধুনিক দর্শন আধুনিকবাদের নিছক সম্প্রসারণমাত্র নয় বরং আধুনিকবাদের সমালোচনা এবং তার বিরোধিতায় মুখর।[২]
ঐতিহাসিকভাবে দেখতে গেলে, উত্তর-আধুনিকবাদ বিশ শতকে তিন বা চারের দশক থেকেই নানা ক্ষেত্রে মাথা চাড়া দিতে শুরু করে। প্রথম এই মতবাদকে চিহ্নিত করা যায় নগর-স্থাপত্যের ক্ষেত্রে। পরবর্তীকালে বেশ কয়েকটি ঘটনাধারা উত্তরাধুনিক দর্শনের অভিমুখ নির্মাণ করে তোলে। এগুলির মধ্যে বিশেষ উল্লেখয্যোগ্য ১৯৬৮ সালে ইউরোপ জুড়ে বিভিন্ন দেশে শ্রমিক-ছাত্র-বুদ্ধিজীবী-তরুণদের বিভিন্ন আন্দোলন এবং বিদ্রোহ, ভিয়েতনাম যুদ্ধ, আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকা জুড়ে উপনিবেশবাদ আর নয়া উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার লড়াই, পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে নারীবাদের উত্থান, যোগাযোগ, প্রযুক্তি ক্ষেত্রের ব্যাপক বিস্তার, আর পরে কম্পিউটার সংস্কৃতির আগ্রাসন, বিশ্বায়নের তুমুল হৈ হল্লা’, বহুজাতিকের “দারুণ দামামা’ প্রভৃতি। আরো, গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এই পরিপ্রেক্ষিতে সম্ভবত নয়ের দশকের গোড়ায় সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পূর্ব ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশের পতন, যেটি সাধারণভাবে সমাজতন্ত্রের পতন’ হিসেবে চিহ্নিত এবং পাশাপাশি ঠাণ্ডা যুদ্ধের অবসান।
আধুনিকবাদের প্রধান নির্মাণ গড়ে উঠেছিল দীপায়ন যুগে। এক নিটোল, নিচ্ছিদ্র, আদি-মধ্য-অন্ত্য নির্দিষ্ট ইতিহাসের আখ্যান গড়ে উঠেছিল দীপায়ন যুগে, যেখানে এক নিশ্চিতি কাজ করে যাচ্ছিল আধুনিক যুগ’ প্রসঙ্গে, যেন আধুনিক যুগে পৌছে ইতিহাস প্রগতির বাধা সড়ক খুঁজে পেয়েছে। এইবার সেই পথে আলো জ্বেলে মানুষের ক্রমমুক্তি ঘটতে থাকবে। কিন্তু, একটু মনোযোগী বিশ্লেষণে এই ইতিহাস নির্মাণের বড়ো একটা গলদ ধরা পড়বে। এই আধুনিক ইতিহাস-নির্মিত ‘মানুষ’ আসলে, ইউরোপের শ্বেতকায়, ‘মহাপরাক্রান্ত আত্মগর্বী মানুষ। ফলে দীপায়ন যুগে পুঁজির যে বিশেষ চেহারা, সেই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সহজ পরিণতি হিসেবে দেখা হতে থাকে ‘মানব বিশ্ব। ইউরোপের অজানা জগৎ ‘বর্বর’, ‘অশিক্ষিত’ ‘অসভ্য’ জগৎ। কেন্দ্র থেকে নির্ধারিত হতে শুরু করে ‘প্রান্ত’- মানুষের ইতিহাস নির্মিত হয় ইউরোপকে ‘প্রগতির ধারক বাহক হিসেবে বিশ্বাস করে। ‘যুক্তি দিয়ে, প্রযুক্তি দিয়ে, প্রচুরতম লোকের প্রভূততম সুখ সাধনের প্রতিশ্রুতি দেয় এই দীপায়ন যুগ সৃষ্ট মতাদর্শ- যদিও সেই সময়টাই ইউরোপের উপনিবেশ স্থাপন করে চলার যুগ- উপনিবেশের ‘নিগার’ প্রজাকে শোষণ করে, অত্যাচার করে, ইউরোপীয়দের সুখ সাধন হয়ে ওঠে প্রগতিবাদী ‘আধুনিক ইতিহাসের প্রধান লক্ষণ। দীপায়ন যুগের সমালোচনা পৃথিবীর নানা চিন্তাবিদ-ই বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন ধরনে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। ১৯৪৪ সালে ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের থিওদোর আদর্নো আর ম্যাক্স হর্কহেইমার ডায়ালেকটিক অব এনলাইটেনমেন্ট-এ এদিকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু আলোকপাত করেন। ইতিহাসের এই পরিচিত নির্ধারিত ধাচ- ‘আধুনিকতা’, ‘প্রগতি’, সার্বিক (total) ‘ইতিহাস’- এই ধারণাগুলি ধাক্কা খেতে থাকে- কার্ল মার্ক্সের পুঁজি, দাস ক্যাপিটাল গ্রন্থে যার প্রথম বীজ উপ্ত রয়েছে। নতুন ধারণা নিয়ে পুরনো আধুনিক ধাচকে স্থানান্তরিত করতে শুরু করে আধুনিকোত্তরবাদ। যেখানে ইতিহাস হয়ে ওঠে। বহুত্বময়, নানা নকশার, নানা অভিমুখের জটিল বয়ন।
দর্শনের ক্ষেত্রেও আধুনিকোত্তরবাদ নিজস্ব বৈনাশিক, বহুত্বময়তা নিয়ে উপস্থিত। দেকার্ত, কান্ট, ফ্রেগে, বিটগেনস্টাইন, কোয়োইন প্রমুখ দার্শনিকদের বিশ্লেষণ বিচার শেষে ডেভিডসন, রোটি, দেরিদা প্রমুখ দার্শনিকরা ‘অদ্বিতীয়, সমগ্ন, বদ্ধ শব্দতালিকার বদলে বহু বিকল্প-সমৃদ্ধ তাৎক্ষণিক ব্যাখ্যা খুঁজছেন। দেরিদাকল্পিত বিনির্মাণ পদ্ধতি এই চিন্তাধারার খুব বড়ো হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। সর্বকালজয়ী দার্শনিক ব্যাখ্যার বদলে আধুনিকোত্তরবাদের ঝোক আপেক্ষিকতার দিকে।
আধুনিকোত্তরবাদের অপর একটি বড়ো ক্ষেত্র ভাষাবিজ্ঞান আর চিহ্ন। সুইজারল্যান্ডের ভাষাবিজ্ঞানী ফার্দিনান্দ দ্যা সোসুর (১৮৫৭-১৯১৩) কথিত কয়েকটি মৌল ধারণা নির্ভর করে যে গঠনবাদী ভাষাতত্ত্ব গড়ে উঠেছিল, তার গ্রহণ-বর্জন ঘটিয়ে গড়ে উঠল উত্তর গঠনবাদী ভাষাদর্শন। যার সম্প্রসারণ দেরিদার বি-নির্মাণ পদ্ধতি সৃষ্টিতে। আধুনিকোত্তর দর্শনের প্রধান তিন ব্যক্তিত্ব বলা চলে মিশেল ফুকো (১৯২৬-১৯৮৪), জাক লাকা (১৯০১-১৯৮১) এবং জ্যাক দেরিদা (১৯৩০-২০০৪)। এঁদের লেখাপত্রগুলি পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। ফুকো যেমন সমাজ, ইতিহাস, প্রতিষ্ঠান, রাজনীতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে ক্ষমতা’র ভূমিকা এবং চাপের সর্বগ্রাসী অবয়ব বিশ্লেষণ করে দেখান। লাকা উত্তরগঠনবাদী প্রক্রিয়ার মনঃসমীক্ষণের চেষ্টা করেন। লাকা মানবমনকে ভাষাতাত্ত্বিক পদ্ধতিতে ‘পাঠ’ করতে চান, অন্য দিকে জ্যাক দেরিদা–ভাষাক্ষেত্রে দর্শনক্ষেত্রে চূড়ান্ত বৈনাশিক, বহুত্বময়, অনির্দিষ্টতাকে প্রতিষ্ঠা করতে চান। এই তিনজন ছাড়া বিশেষ উল্লেখয্যোগ্য বঁলা বার্ত (১৯১৫-১৯৮০), কোনো রচনা বা টেক্সটকে পাঠ বুদ্ধিজীবীর নোটবই করার ক্ষেত্রে যার মৌলিক চিন্তা আর তত্ত্বগুলি গুরুত্বপূর্ণ। বার্ত কথিত ‘পাঠকর্তার মৃত্যু আলোচ্য প্রেক্ষিতে স্মরণীয় ভাবনা।
‘মার্ক্সবাদ’ বিষয়েও আধুনিকোত্তরবাদের বিশেষ একটি ধারার মতামত মূল্যবান। তার মধ্যে সম্ভবত সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ আন্তোনিও গ্রামসির (১৮৯১-১৯৩৭) কারাগারের লেখালেখি এবং অন্যান্য ভাবনাচিন্তাগুলি সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পুনঃপাঠের প্রবণতা। রাষ্ট্রের আধিপত্য এবং কর্তৃত্ব বিষয়ে গ্রামসির মৌলিক চিন্তা সবসময়ে মার্ক্সীয় চিন্তার প্রেক্ষিতে খুবই প্রয়োজনীয়। আধুনিকোত্তরবাদকে যে সব সংশয়বাদীরা পুঁজির এক বিশেষ অবস্থায় সৃষ্ট দর্শন হিসেবে দেখতে চান বা আধুনিকোত্তরবাদকে মনে করেন পুঁজিবাদে সর্বসমর্পিত দর্শন হিসেবে তাদের বিরুদ্ধে বলা যায় যে, আধুনিকোত্তরবাদের কোনো কোনো ধারা মার্কসবাদের সঙ্গে এক সংলাপ চালাতে বদ্ধপরিকর। ফুকোর চিন্তাধারার অন্তিমে গ্রামসির প্রতি-আধিপত্যবাদের (Counter Hegemony) প্রসঙ্গে তারা উৎসাহী। এই প্রেক্ষিতে লুই আলথুসার-এর (১৯১৮-১৯৯০) মার্কসপাঠ প্রকল্প আর ব্যাখ্যা এবং যুগের্ন হাবেরমাস (১৯২৯ জ.) আলোচিত সমাজতত্ত্বচিন্তা বিশেষ মনোযোগ দাবি করে।
তথ্যসূত্র:
১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ৩১৮।
২. সুধীর চক্রবর্তী; বুদ্ধিজীবীর নোটবই, নবযুগ প্রকাশনী, বাংলাবাজার, ঢাকা, প্রথম সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ২০১০, পৃষ্ঠা, ৪০৬-৪০৮
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।