মহুয়া সাপোটাসি পরিবারের মধুকা গণের ভারতবর্ষ ও এশিয়ার চিরসবুজ বৃক্ষ

বিবরণ: মহুয়া সাপোটাসি পরিবারের মধুকা গণের একটি বৃহদাকার সপুষ্পক বৃক্ষ। এরা প্রায় ২০ মিটার উচ্চতাবিশিষ্ট এভারগ্রীন বা সেমিএভারগ্রীন খরা প্রতিরোধী গ্রীষ্মমন্ডলীয় বৃক্ষ। ধারনা করা হয় মহুয়ার আদিবাস ভারতবর্ষে।

প্রচলিত বাংলা নাম: মহুয়া অন্যান্য নাম: মহুলা, মধুকা, মোহা, মোভা, মহুভা, বাটার ট্রি বৈজ্ঞানিক নাম: Madhuca longifolia, সমনাম: Madhuca indica, Bassis latifoli, Bassia latifolia জীববৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাস জগৎ/রাজ্য: Plantae বিভাগ: Angiosperms অবিন্যাসিত: Eudicots অবিন্যাসিত: Asterids বর্গ: Ericales পরিবার: Sapotaceae গণ: Madhuca প্রজাতি: Madhuca longifolia (J.Konig) J.F.Macbr. জাতসমূহ: M. longifolia var. latifolia, M. longifolia var. longifolia

বিবরণ: মহুয়ার পাতা মোটা এবং লেদারি। ফুল ছোট, সুগন্ধযুক্ত এবং শাখার মাথায় গুচ্ছাকারে ফোটে, রঙ ঈষৎ হলুদ বা ডাল হোয়াইট। সুস্বাদু ও পুষ্টিকর বলে মহুয়া ফুল আদিবাসীদের কাছে খুব প্রিয়। মহুয়া গাছের কালচারাল এবং ইকোনোমিক মূল্যও যথেষ্ট। Antheraea paphia নামীয় মথ মহুয়ার পাতা খেয়ে তসর সিল্ক tassar silk তৈরী করে যার বাণিজ্যিক মূল্য প্রচুর। মহুয়া একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এগ্রোফরেস্ট্রি স্পিসিস। মহুয়ার শিকড় বিস্তৃত বিধায় সহজেই ভূমিক্ষয় রোধ করতে পারে। মহুয়া তীব্রগন্ধী ফুল এবং ফেব্রুয়ারী-এপ্রিলে ফুটে থাকে। মহুয়ার ফল জুলাই–অগাস্টে পাওয়া যায় । ফলের পাল্প মিষ্টি এবং কার্বোহাইড্রেটের একটি ভালো উৎস। কাঁচা মহুয়া সবুজ এবং পাকলে কমলা বা লালচে হলুদ হয়।

আরো পড়ুন: মহুয়া গাছের ভেষজ গুণ

মহুয়ার ফুল, আলোকচিত্রঃ সৈয়দ তারিক

১০ বছর বয়স থেকেই ফুল দিতে শুরু করে মহুয়া গাছ। স্রেফ গাছ ধরে ঝাকালেই পাকা মহুয়া ফুল ঝরে পরে। মানুষের সাথে সাথে ময়ূর, অন্যন্য পাখী, বন্য পশু, ভালুক এবং হরিণও মহুয়া ফুলের ভক্ত। মহুয়ার ফুল কোন ধরণের প্রক্রিয়াকরণ বা রান্না ব্যতিরেকেই খাওয়া যায়। মহুয়ার বীজের কুড়া (seed kernels ) হতে এক ধরনের হলুদাভ তৈলাক্ত পদার্থ এক্সট্রাক্ট করা হয়। একে ভালোভাবে রিফাইন করার পর মহুয়া বাটার পাওয়া যায়। সম্ভবত এজন্য মহুয়া গাছের আরেক নাম বাটার ট্রি। এই বাটার বিভিন্ন আদিবাসী ও ছোট পাহাড়ি জনগোষ্ঠী রান্নার কাজে ব্যবহার করে। এ ছাড়াও এই বাটার দিয়ে সাবান ও মোম ও ত্বকের জন্য অয়েনমেন্ট তৈরি করা হয়। মহুয়ার বাটার ত্বকের সংস্পর্শে আসা মাত্র বিগলিত হয় বলে এটি ত্বকের শুস্কতারোধ ও রিংকেল রোধে খুব কার্যকর। ত্বকের বয়োবৃদ্ধি রোধে, নতুন সতেজ ত্বক সৃষ্টিতে এবং ত্বকের স্থিতিস্থাপকতা বজায় রাখতে এই বাটার তুলনাহীন। মহুয়ার ফুল খুব মিষ্টি বিধায় চিনির বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যায়। যদিও অতিরিক্ত ফুলব্যবহারে নেশাগ্রস্থ হবার সম্ভাবনা থাকে। তাছাড়া ফুল হতে জ্যাম, জেলি, স্কোয়াস তৈরি করা হয়। শুকনো ফুল দিয়ে পিকেল, কিসমিস, বেকারী ও অন্যান্য কনফেকশনারী দ্রব্যাদি তৈরি করা যায়। খাবারে সুগন্ধ যুক্ত করতে মহুয়া ফুল রান্নায় ব্যবহার করা হয়। ফুলের মত ফলও কাঁচা ও পাকা উভয় অবস্থাতেই খাওয়া যায়। ফলের খোসা সবজি হিসেবে ব্যবহৃত হয় ভিতরের অংশ শুকিয়ে সংরক্ষণ করা যায়, পরবর্তীতে অন্যান্য খাবারের সাথে মিশিয়ে খাওয়া হয়।

আরো পড়ুন:  গুড় বাংলাদেশের সহজলভ্য ও প্রচলিত মিষ্টান যাতে আছে নানা গুণ

প্রতি ১০০ গ্রাম ফুলে ১১১ ক্যালোরি শক্তি , ৭৩.৬ গ্রাম ময়েশ্চার, ২২.৭ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট, ১.৪ গ্রাম প্রোটিন, ১.৬ গ্রাম ফ্যাট, মিনারেলস, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, আয়রণ এবং ভিটামিন এ এবং সি থাকে।

মহুয়ার ব্যবহার: মহুয়ার তেল স্কীন কেয়ারের জন্য অতুলনীয়। এই তেল বীজ শোধন ও পেস্ট কন্ট্রোলেও ব্যবহার করা হয়, ফ্যাট/চর্বি দিয়ে সাবান ও ডিটারজেন্ট তৈরি হয়। তা ছাড়াও মহুয়ার চর্বি ভেজিটাবল বাটার হিসেবে খুব উপাদেয়। মহুয়ার বাটার ফুয়েল ওয়েল / বায়ো ডিজেল এর ভালো উৎস। মহুয়া বীজের তেলে mowin নামীয় সামান্য বিষাক্ত যৌগ রয়েছে, যথার্থ বিশুদ্ধকরণ প্রক্রিয়া যা সহজেই দূর করা সম্ভব। গাছের পাতা, ফুল, ফল ডালপালা ছাগল-ভেড়ার খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বীজের খৈল ভালো গোখাদ্য। তবে মহুয়া বীজকে গোখাদ্য হিসেবে ব্যবহারের পূর্বে বীজটি mowin মুক্ত করা প্রয়োজন। বীজের খৈল/সীড কেক অত্যন্ত ভালো অর্গানিক সার ও ইনসেক্টিসাইড। মহুয়া খৈল-এ এ্যালকলয়েড বৈশিষ্ট থাকায় তা দিয়ে মাছ ধরা যায়। তা ছাড়াও এই খৈল পুকুরে সার হিসের এবং পোনা মাছের খাদ্য হিসেবেও ভালো কাজে দেয়। কাঁচা ফুল দিয়ে এ্যালকোহলিক ড্রিংক তৈরি হয়। আদিবাসীদের কাছে এ পানীয় খুব প্রিয় এবং তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারক। অরণ্যবাসীদের প্রতিটি উৎসব-পার্বনে এ পানীয় অত্যাবশ্যকীয় উপাদান হিসেবে সমাদৃত। পশ্চিমবঙ্গের রাঙ্গামাটির অঞ্চল থেকে শুরু করে মধ্য ভারত, দাক্ষিনাত্য যেখানেই মহুয়া জন্মায় সেখানেই হাটের থেকে একটু দূরে একটি সুধার হাট বসে, যার প্রধান পণ্য মহুয়ার মদ। ফুল শুকিয়ে রেখে বহুদিন খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করা যায়।

মহুয়া গাছের বাকলসহ গাছের প্রতিটি অংশ ঔষধি গুণসম্পন্ন বিধায় আদিবাসী বিভিন্ন জাতির লোকজনের এ গাছ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ফুল দিয়ে ঔষধি সিরাপ তৈরি করা হয়। ফুল ব্রংকাইটিস ও চক্ষুরোগে উপকারে আসে। ফুল হতে যে তেল তৈরি হয় তাতে Fatty acid composition, palmitic acid, stearic acid, oleic acid ও linoleic রয়েছে। এই তেলের emollient প্রোপার্টিজ থাকায় এই তেল ত্বক, রিমোটিজম ও মাথাব্যথায় কার্যকর। মহুয়া ভালো ল্যাক্সেটিভ বিধায় কোষ্টকাঠিণ্য, পাইলস, এ্যানাল ডিজিজ ও বমনরোধে সুফলদায়ক। মহুয়াতে ট্যানিন থাকায় মহুয়া হিলিং গুণসম্পন্ন। এ ছাড়াও ক্রণিক আলসার, এ্যাকিউট টনসিলাইটিস, মাড়ির রক্তক্ষরণে, স্পঞ্জী মাড়ির জন্য মহুয়া উপকারী। পোড়ানো মহুয়ার পাতা ঘি সহযোগে পোড়া ক্ষতে ব্যবহার করলে খুব উপকার পাওয়া যায়। মহুয়া গাছের বাকল ডায়াবেটিসের জন্য উপকারী। দুধের সাথে মহুয়া ফুল জ্বাল করে খেলে ইম্পোটেন্সিতে কাজ দেয়। মহুয়ার ফুল ছিড়লে, কান্ড ও শাখা কাটলে দুধের মত এক ধরণের কষ বের হয় যা তীব্র আঠালো এবং এ্যাস্ট্রিনজেন্ট। এই কষ রিমোটিজমের জন্য উপকারী।

আরো পড়ুন:  কাঁকুড় বা কাঁকড়ি খাওয়ার উপকারিতা ও ছয়টি ভেষজ গুণাগুণ

আয়ুর্বেদিক দৃষ্টকোণ হতে মহুয়া তাপ নিরোধক (coolant), যৌন উত্তেজক (aphrodisiac), শ্বাসতন্ত্রের রোগ নিরোধক (expectorant) পরিপাকতন্ত্রীয় সমস্যা নিরামায়ক (carminative) ও মাতৃদুগ্ধ বর্ধক গুণসম্পন্ন গাছ।

মহুয়া ফুলকে নিয়ে আছে নানা উপ্যাখান, কত কবিতা, কত গান। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের রয়েছে বহু গান। পাহাড়িরা এর ফুল দিয়ে নেশাদ্রব্য তৈরি করে। ভালুক নাকি রাতের বেলা এর ফুল খেয়ে মাতাল হয়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ তার মহুয়া কাব্যের ভূমিকায় লিখেছেন, “মহুয়া বসন্তের অনুচরণ, আর তার রসের মধ্যে প্রচ্ছন্ন আছে উন্মাদনা”। তিনি মহুয়া ফুলের বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন-রে মহুয়া, নামখানি গ্রাম্য তোর, লঘু ধ্বনি তার, /উচ্চ শিরে তবু রাজকুলবনিতার/ গৌরব রাখিস উর্ধ্বে ধরে/ আমি তো দেখেছি তোরে/ বনস্পতি গোষ্ঠী-মাঝে অরণ্য সভায়/ অকুণ্ঠিত মর্যাদায়/ আছিস দাঁড়ায়ে/ শাখা যত আকাশে বাড়ায়ে। প্রস্ফূটিত মহুয়া ফুলের মধুগন্ধী উদ্দমতা তুলনাহীন। এই গন্ধ দূরবাহী, তীব্র ও উন্মাদনাময়। আদিবাসী ও অরণ্যের পশুপাখির কাছে মহুয়া প্রিয় তরু। এই ফুলের নির্যাস উত্তেজক এবং আদীবাসীদের প্রিয় পানীয়।

মহুয়ার এত গুন আছে বলে এবং এটি বন্য বৃক্ষ বলে ভারতের আদিবাসী সমাজ জীবনের সাথে এটি ওতোপ্রোতোভাবে জড়িয়ে আছে। ভারতীয় উপমহাদেশে অন্ততঃ কয়েকশো গ্রাম আছে যার নাম মহুলবনী। গন্ড উপজাতিদের (যাদের নাম থেকে গন্ডওয়ানাল্যান্ডের নামকরণ হয়েছে) একটি উপকথা আছে। অনেক দিন আগে এক গন্ড প্রধান গ্রামের বাইরে বেড়াচ্ছিলেন। তিনি এমন একটা কিছু খুঁজছিলেন যা দিয়ে তিনি তাঁর অতিথিদের তাক লাগিয়ে দিতে পারেন। খুঁজতে খুঁজতে তিনি দেখলেন একটা জলের কুন্ড যেটার ভিতরে প্রচুর মহুয়া ফুল ঝরে পড়েছে। তার আশে পাশে অনেক পাখি সেই জল পান করছে। পাখিদের দেখে মনে হল তাদের মধ্যে কোনো ভয় ডর নেই। মহানন্দে তারা সেই প্রধানের চার পাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তিনি সেই জল পান করে দেখলেন সেটার স্বাদ অপূর্ব। সেই জল খেয়ে তিনিও মহানন্দে নাচতে শুরু করলেন। বলা হয় এভাবেই মহুয়া কে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল।

আরো পড়ুন:  আম গাছের ছাল, পাতা, ফলের ২০টি ওষধি গুণাগুণ

রচনাকালঃ ২১ এপ্রিল ২০১৪

1 thought on “মহুয়া সাপোটাসি পরিবারের মধুকা গণের ভারতবর্ষ ও এশিয়ার চিরসবুজ বৃক্ষ”

  1. আমার মহুয়া গাছের চারা দরকার । কিভাবে পেতে পারি। দয়া করে জানাবেন।

    Reply

Leave a Comment

error: Content is protected !!