ফরাসি বিপ্লব পরবর্তীকালে উদ্ভূত কল্পলৌকিক সমাজতন্ত্র (ইংরেজি: Utopian Socialism) হচ্ছে আধুনিক সমাজতান্ত্রিক চিন্তার প্রথম স্রোতটিকে চিহ্নিত করার জন্য ব্যবহৃত একটি যৌগিক শব্দ। সাঁ সিমোঁ, শার্ল ফুরিয়ে এবং রবার্ট ওয়েন ছিলেন কল্পলৌকিক সমাজতন্ত্রের প্রবক্তা। এদের মধ্যে সাঁ সিমোঁ ও শার্ল ফুরিয়ে ছিলেন ফরাসি চিন্তাবিদ এবং রবার্ট ওয়েন ইংরেজ চিন্তাবিদ। তাঁরা প্রণয়ন করেছিলেন কল্পলৌকিক সমাজতন্ত্রের বিশেষ নানা ব্যবস্থা যেগুলো পরিণত হয়েছিল বৈজ্ঞানিক কমিউনিজমের প্রত্যক্ষ তাত্ত্বিক উৎসে।
কার্ল মার্কস ও ফ্রিডরিখ এঙ্গেলসকে মার্কসবাদ প্রতিষ্ঠা ও অগ্রসর করার জন্য বিভিন্ন রূপের কল্পলৌকিক সমাজতন্ত্রী, ক্ষুদে বুর্জোয়া সমাজতন্ত্রীসহ অপ্রলেতারীয় মতবাদের বিরুদ্ধে আপোষহীনভাবে মতাদর্শগত সংগ্রাম পরিচালনা করতে হয়েছিল। তবে কল্পলৌকিক সমাজতন্ত্রীদের ঐতিহাসিক অবদান হলো এই যে, উদিত পুঁজিবাদকে তাঁরা তীব্র ও সাহসী সমালোচনায় খণ্ড-বিখণ্ডিত করেন, যার বৈপরীত্য তখনও পর্যন্ত পুরোপুরি আকারে উন্মুক্ত হয়নি। ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস লিখেছেন,
“একটা ব্যাপার এই তিনজনের পক্ষেই সমান। ঐতিহাসিক বিকাশ ইতিমধ্যে যে প্রলেতারিয়েতের সৃষ্টি করেছে সেই প্রলেতারিয়েতের স্বার্থের প্রতিনিধি হয়ে এঁরা কেউ দেখা দেননি। একটা বিশেষ শ্রেণির মুক্তি দিয়ে শুরু না করে ফরাসি দার্শনিকদের মতো তাঁরা সমগ্র মানবেরই মুক্তি দাবি করেন। তাঁদের মতোই এঁদেরও অভিলাষ যুক্তি ও শাশ্বত ন্যায়ের রাজ্য স্থাপন।”[১]
আঁরি ক্লদ দে সাঁ সিমোঁ (১৭৬০-১৮২৫) জন্মগ্রহণ করেন প্যারিসের এক সুপ্রাচীন অভিজাত পরিবারে। তিনি অতীতের তুলনায় প্রতিটি নতুন আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার এক নৈর্বক্তিক প্রগতিবাদী ধারনা পেশ করেছিলেন। তবে প্রকৃতি উপলব্ধির ব্যাপারে বস্তুবাদী হয়েও সামাজিক সমস্যাবলী মীমাংসায় সাঁ সিমোঁ ভাববাদী থেকে যান। তাঁর কাছে ইতিহাস হলো মানবজাতির ধীশক্তির অগ্রণী বিকাশের ভিত্তিতে এক সামাজিক ব্যবস্থার বদলে অন্যের দ্বারা মানবজাতির উদীয়মান বিকাশ।
ইতিহাসের ব্যাপারে মহান এই কল্পলৌকিক ব্যক্তির ভাববাদী ধারনার সংগে মিলেমিশে ছিল বস্তুবাদী বৈশিষ্ট্যের নানা প্রতিভাময় অনুমান। সাঁ সিমোঁ এই সঠিক চিন্তাধারার কাছাকাছি এসেছিলেন যে, অর্থনৈতিক অবস্থান হলো রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলির বুনিয়াদ, আর সামাজিক-রাজনৈতিক ধরনগুলি নির্ভরশীল হলো মালিকানা সম্পর্কাদির উপর। সমাজ জীবনে উৎপাদনের গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকার কথা তিনি উল্লেখ করেছিলেন, বুর্জোয়া সমাজের শ্রেণিজনিত কাঠামো ধ্যানধারণার খুব কাছাকাছি এসেছিলেন।
সাঁ সিমোঁর শিক্ষায় শ্রেণীসংগ্রাম হলো একের পর এক বদলে যাওয়া মানবসমাজের এক সাধারণ লক্ষণ। তিনি এই গুরুত্বপূর্ণ চিন্তাধারায় উপনীত হয়েছিলেন যে, ফরাসি বিপ্লব জড়িত ছিল অর্থনৈতিক রাজনৈতিক ও ভাবাদর্শগত বিপুল নানা রদবদলের সংগে এবং এইসব শ্রেণির সংগ্রাম উপস্থাপিত করেছিল অভিজাত, বুর্জোয়া ও নিঃস্বগণ। ‘জনৈক জেনেভাবাসীর পত্রে’ তিনি এ বিষয়ে লিখেছেন। ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস উল্লেখ করেছেন,
“… ১৮০২ সালে ফরাসি বিপ্লবকে [শুধু অভিজাত ও বুর্জোয়ার মধ্যে নয়, বরং] অভিজাত, বুর্জোয়া এবং নিঃস্বদের মধ্যকার শ্রেণীসংগ্রাম হিসেবে চিনে নিতে পারাটা ছিলো একটি মহৎ প্রতিভার আবিষ্কার।”[২]
একই সংগে শ্রেণি ও শ্রেণিসংগ্রামের বিষয়ে সাঁ সিমোঁর সুস্পষ্ট কোনো ধারনা ছিলো না। বিভিন্ন শ্রেণি, সেগুলির সামাজিক প্রকৃতি, সারবস্তু ও উৎপত্তির ব্যাপারে তিনি সঠিক ধারনায় আসতে পারেননি। শ্রেণিতে শ্রেণিতে সমাজকে বিভক্ত করা সম্পর্কে তাঁর সুস্পষ্ট মানদণ্ডের অভাব ছিলো।
সামন্তবাদের বদলে যে-সমাজ আসবে, তাতে সাঁ সিমোঁ নিরীক্ষণ করেছেন মালিক ও না-মালিকদের মধ্যে তারতম্য, লক্ষ্য করেছেন তাদের মধ্যে সংগ্রামকেও। না-মালিকদের ব্যাপার সম্পর্কে দেখা দিয়েছে সংজ্ঞা ‘প্রলেতারিয়েত’। শিল্পজনিত শ্রেণির গণ্ডিতে অ-মালিকদের গ্রুপরূপে প্রলেতারিয়েতের অস্তিত্বকে স্বীকৃতি দিয়ে তিনি তাকে এক বিশেষ শ্রেণিরূপে আলাদা করেননি।
শিল্প ব্যবস্থার ধারনা হলো সাঁ সিমোঁর সাহিত্যিক বৈজ্ঞানিক রচনাবলীতে কেন্দ্রীয় স্থানাধিকারী। তাতে বর্ণিত হয়েছে আদর্শ সমাজ সম্বন্ধে তাঁর ধ্যানধারণা। তাঁর মতে ভবিষ্যৎ সমাজে বিজ্ঞান নিবিড়ভাবে জড়িত থাকবে শিল্পের সংগে, আর তা, অর্থনীতির পরিকল্পনাভিত্তিক পরিচালনের মতোই, এসে পৌঁছাবে শ্রম-উৎপাদনশীলতার যথেষ্ট বৃদ্ধির দ্বারপ্রান্তে। সাঁ সিমোঁর মতে, শিল্প ব্যবস্থা শোষণ খতম করে, যেহেতু তাঁর আদর্শ ধারনা অনুসারে শিল্পপতিরা ভাড়াটে শ্রমিকদের মেহনতে তৈরি বৈষয়িক সম্পদকে আত্মসাৎ করে না, বরং তাদের মুনাফা হলো অধিকতর সম্মানজনক ও জটিল কাজ সুসম্পন্ন করার ভাতাস্বরূপ। পরিণামে অংকিত হয়েছে এক কল্পলৌকিক চিত্র যেখানে ব্যক্তিগত মালিকানার ও কারবারি (পুঁজিবাদী) ক্রিয়াকলাপভিত্তিক সমাজে কোনো এক যাদু দ্বারা মানুষে মানুষে শোষণ গরহাজির থাকে। সাঁ সিমোঁর মত হচ্ছে ভবিষ্যৎ সমাজে সবাইকে কাজ করতে হবে এবং প্রতিটি লোকের কৃত শ্রম অনুযায়ী সমাজে তার স্থান নির্দিষ্ট হবে। বিজ্ঞানের সংগে শিল্পের সমন্বয়সাধন, কেন্দ্রীকৃত ও পরিকল্পিত উৎপাদন ইত্যাদি মত তিনি প্রচার করেন। তবে ব্যক্তিমালিকানা ও পুঁজির সুদের সমর্থন করেন। রাজনৈতিক সংগ্রাম ও বিপ্লবের প্রতি তার মনোভাব ছিলো নেতিবাচক; প্রলেতারিয়েতের ঐতিহাসিক উদ্দেশ্য কী, তা তিনি বুঝতে পারেননি। তাঁর বিশ্বাস ছিলো, সরকারি সংস্কারমূলক কাজ, আর এক নবপ্রবর্তিত ধর্মের প্রভাবে সমাজের নৈতিক শিক্ষাই শ্রেণিগত অসংগতি দূর করার দিকে এগিয়ে যাবে।
ফরাসি কল্পলৌকিক সমাজতন্ত্রের আরেকজন প্রতিভাধর প্রতিনিধি শার্ল ফুরিয়ে (১৭৭২ – ১৮৩৭) বুর্জোয়া সমাজের তীক্ষ্ণ সমালোচক ছিলেন। তাঁর জন্ম এক ব্যবসায়ী পরিবারে। বিদ্যালয়ে অপূর্ব মেধাবিরূপে খ্যাত ছিলেন। সাগ্রহে ভূগোল, নানা ভাষা, সংগীত অধ্যয়ন করেন, কাব্যে মেতেছিলেন, ভালো আঁকতেন। দৃষ্টিভঙ্গির নিজস্বতা গড়তে তিনি স্বীকৃতি দিয়েছেন তিনটি সর্বদা বিদ্যমান উৎসকে যথা, ঈশ্বর, বস্তু ও গণিতকে যেগুলোকে তিনি চিরকালীন ন্যায়ের প্রকাশস্বরূপ বিবেচনা করতেন।
ফুরিয়ে ঘোষণা করেন যে, তাঁর উপর ভার পড়েছে এক সামাজিক নীতি আবিষ্কার করার, ঈশ্বরের রহস্য পরিকল্পনা উদ্ঘাটন করার। তাঁর শিক্ষা অনুসরণ করার কল্যাণে মানবজাতি সহজে ও সরল পথে সুষম অবস্থায় আসতে পারে। ফুরিয়ে বিপুল দৃষ্টিদান করেছেন পুঁজিবাদী শাসন ব্যবস্থার, তার সামাজিক-অর্থনৈতিক ভিত্তির, রাজনৈতিক আকারের, ভাবাদর্শগত ও নৈতিক রীতিনীতির সমালোচনার ব্যাপারে।
শার্ল ফুরিয়ে ছিলেন সেই অল্প সংখ্যক সমাজতন্ত্রীদের অন্যতম, নারী মুক্তির জন্য যিনি উদ্দীপ্ত সংগ্রাম চালান। মহান এই ইউটোপিয়ান সামাজিক প্রগতিকে স্থাপন করেছেন নারী মুক্তির উপর সরাসরি নির্ভরশীলরূপে। এঙ্গেলস উল্লেখ করেছেন,
“নরনারীর মধ্যকার বুর্জোয়া রূপের সম্পর্ক এবং বুর্জোয়া সমাজে নারীর অবস্থান বিষয়ে তাঁর সমালোচনা আরো বেশি জবর। তিনিই প্রথম ঘোষণা করেন যে কোনো নির্দিষ্ট সমাজে নারীর মুক্তির মাত্রাই তার সাধারণ মুক্তির পরিমাপক।”[৩]
তিনি মানব সভ্যতার অস্তিত্বে পাপ, অনিষ্ট ও দুর্দশা বজায় থাকার জন্য ঘনঘন দোষারোপ করেছেন দার্শনিকদের ও অর্থনীতিবিদদের। তবে মানব সভ্যতার দুর্দশার মুখ্য কারণ শ্রম ও পুঁজির মধ্যকার পরস্পর বিরোধিতার উপলব্ধি পর্যন্ত পৌঁছে উঠতে পারেননি। সভ্যতার সংকট মীমাংসার পদ্ধতি ফুরিয়ে নিরীক্ষণ করেছেন শ্রেণীসংগ্রাম ও বিপ্লবের মধ্যে নয়, বরং শান্তিপূর্ণ পথে সার্বিক সামঞ্জস্যের এক শাসনব্যবস্থা গড়ার মধ্যে।
মানব সভ্যতার পরবর্তী ধাপে যে-ভাবী সমাজের আসা উচিত, তার ব্যাপারে ফুরিয়ে ব্যবহার করেছেন ‘সমাজজনিত ব্যবস্থা’, ‘সমাজজনিত সামঞ্জস্য’ ধারনা। ‘সমাজতন্ত্র’, ‘সাম্যবাদ’ সংজ্ঞা তিনি ব্যবহার করেননি। সমাজজনিত ব্যবস্থা সংক্রান্ত তাঁর ধারনাকে অভিহিত করা চলে ইউটোপিয়ান সমাজতন্ত্রের এক রকমফের রূপে। সমিতি বা phalange হলো ফুরিয়ে’র সুষম সমাজের মূল কেন্দ্রবিন্দু। সমিতি হলো উৎপাদন-পরিভোগ ধরনের মৈত্রী সংগঠন। তিনি লিখেছেন সমিতিগুলোর বিশ্ব একতা দেখা দেবার সম্ভাবনার কথা। তার আত্মপ্রকাশ ঘটবে অর্থনৈতিক গঠন ব্যবস্থার ভিত্তির একতায়, শিল্প সেনাদলের সংগঠনে, সাধারণ মুদ্রা ব্যবস্থা, পরিমাপ ব্যবস্থা, সাধারণ ভাষা, হরফ, ইত্যাদি স্থাপনের মধ্য দিয়ে।
ফুরিয়ে ছিলেন রাজনৈতিক সংগ্রাম ও বিপ্লবের ঘোর বিরোধী। তিনি শান্তিপূর্ণ সামাজিক পুনর্গঠনের উদ্দেশ্যে আহ্বান জানিয়েছিলেন মিটমাট, শ্রেণিতে শ্রেণিতে সহযোগিতা। এই হলো তাঁর শিক্ষার প্রধান দোষ। তাঁর সামাজিক তত্ত্বে ক্ষুদে-বুর্জোয়া দৃষ্টিভঙ্গির সংখ্যা কম নয়। ক্ষুদে-বুর্জোয়াপনা সর্বাগ্রে হলো সামঞ্জস্যের অন্যতম এক মূল ধারনা_ শ্রমের সংগে পুঁজির শান্তিপূর্ণ সহযোগিতা, শ্রেণিতে শ্রেণিতে আপোসের ধারনা। তিনি স্বপ্ন দেখেন পুঁজিপতিদের, যারা নিজেদের বিনাশ্রমের আয় বজায় রেখে মাতবে হিতকর কাজে স্বপ্ন দেখেন শ্রমিকদের, যারা ধীরে ধীরে রূপান্তরিত হবে ক্ষুদে পুঁজিপতিতে। সাঁ সিমোঁর মতো ফুরিয়েকেও ‘সমাজতন্ত্রের অন্যতম এক পথপ্রদর্শক’ নামে অভিহিত করার ব্যাপারে মার্কসকে ভিত্তি জুগিয়েছিল ভাবীকালের ন্যায়পরায়ণ সামাজিক গঠনব্যবস্থার নীতিসমূহের ব্যাপারে ফুরিয়ে’র নানা প্রতিভাধর অনুমান।
কল্পলৌকিক সমাজতন্ত্রী রবার্ট ওয়েন (১৪ মে, ১৭৭১- ১৭ নভেম্বর, ১৮৫৮) একজন ব্রিটিশ (ওয়েলশীয়) সমাজ সংস্কারক এবং কল্পলৌকিক সমাজতন্ত্র ও সমবায় আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ। তিনি ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নায়ক। তিনি পুঁজিবাদী ব্যবস্থার তীব্র সমালোচনা করলেও পুঁজিবাদের অসংগতির মূল কারণ বলতে পারেননি। তাঁর মতে শিক্ষার অভাবই সামাজিক অসাম্যের মূল কারণ, পুঁজিবাদী উৎপাদন পদ্ধতি নয়। তাঁর ধারনা শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারের দ্বারাই সামাজিক অসাম্য দূর করা যায়। এ ব্যাপারে বিস্তারিত কর্মসূচিও তিনি তুলে ধরেছিলেন। ব্যক্তিগত মালিকানার বিরুদ্ধে তাঁর সাহসিক সমালোচনার পাশাপাশি স্থানলাভ করেছিলো এই সরল ধারনা যে, তার প্রভুত্বের কারণ প্রোথিত আছে মালিকদের মূর্খতা, ভ্রান্তি ও স্বার্থপরতার মধ্যে। একই সময়ে নিজের এই প্রত্যয়ের ব্যাপারে তিনি ছিলেন স্বচ্ছদৃষ্টিসম্পন্ন যে, ব্যক্তিগত মালিকানার উৎখাত ব্যতীত মানবজাতির সামাজিক, মনীষাজনিত ও নৈতিক প্রগতি সুনিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
রবার্ট ওয়েন ওয়েলসের নিউটাউন গ্রামে ১৭৭১ সালের ১৪ মে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ছিলেন একজন দরিদ্র জিন নির্মাতা আর দারিদ্র্যের কারণে তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করা হয় নি। মাত্র নয় বছর বয়সে ওয়েন কাপড়ের দোকানে চাকরি নেন এবং তার বয়স যখন ১৮ বছর, তখন তিনি ম্যানচেস্টার চলে যান। সেখানে একটি সুতা কলে সুপারিনটেনডেন্ট হিসেবে কিছুদিন কাজ করেন। পরে একশ পাউন্ড পুঁজি নিয়ে নিজেই সুতা উৎপাদন ব্যবসা শুরু করেন। তার ব্যবসা কয়েকদিনের মধ্যে ফুলেফেঁপে ওঠে এবং তিনি ম্যানচেস্টারের একজন প্রথম শ্রেণির ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিতি পান। ১৮০০ থেকে ১৮২৯ সাল পর্যন্ত সময়কালে তিনি ম্যানেজিং পার্টনার হিসেবে স্কটল্যান্ডে নিউ ল্যানার্কের সুতা-বয়ন কল পরিচালনা করেন। তিনি বিশেষভাবে ‘লোকগুলোকে মনুষ্য নামক প্রাণীর আরো উপযোগী অবস্থায় স্থাপন করে’ এবং ‘উঠতি প্রজন্মকে আরো যত্নে লালন পালন করে’ তাঁর কারখানাকে ২৫০০ মানুষের এক আদর্শ কলোনিতে রূপান্তর করেন। তিনি ছিলেন ইনফ্যান্ট স্কুলের আবিষ্কর্তা, নিউ ল্যানার্কে সেগুলোকে প্রথম প্রবর্তন করেন। শিশুরা দু’বছর বয়স থেকে স্কুলে এসেছে, যেখানে তারা এতো বেশি উপভোগ করেছে যে তাদেরকে বাড়িতে ফেরত নেয়াটা কঠিন হয়েছে। যেখানে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীরা লোকগুলোকে প্রতিদিন ১৩-১৪ ঘণ্টা খাটিয়েছে, নিউ ল্যানার্কে কর্মদিবস ছিলো সাড়ে দশ ঘণ্টার। তিনি শ্রমিকদের জন্য তাঁর কারখানায় পরীক্ষা চালান যা বাস্তবের কাছ দিয়ে গেলেও রাষ্ট্রটিকে শ্রমিকরা দখল না করে যে তা বাস্তবায়ন করতে পারে না তা শত বছর পরে প্রতিভাত হয়। তিনি ছোট ছোট আত্মশাসিত গোষ্ঠী নিয়ে গঠিত স্বাধীন ফেডারেশন ভবিষ্যতের ‘যুক্তিনির্ভর’ সমাজের ছবি আঁকেন। কিন্তু তা কার্যে পরিণত করার সব চেষ্টাই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
রবার্ট ওয়েনের প্রত্যক্ষ পরিচালনাধীন লন্ডন লেনদেন বাজারের অস্তিত্ব টিকে ছিলো ১৮৩২ থেকে ১৮৩৪ সাল পর্যন্ত। লেনদেন বাজার গড়ার পাশাপাশি ওয়েন একই সংগে সমবায় নীতিসমূহের ভিত্তিতে ট্রেড ইউনিয়নগুলোর সংস্কারের পথে উৎপাদন পুনর্গঠনের এক ইউটোপীয় পরিকল্পনার ব্যাপারে মতপ্রকাশ করেন। বছর যেতে না যেতেই ওয়েনের সমবায় ব্যবস্থাও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ভি. আই. লেনিন লিখেছেন,
“রবার্ট ওয়েন থেকে শুরু করে পুরনো সমবায়ীদের নানা পরিকল্পনার অলৌকিক রূপটি কেমন? এই যে তাঁরা স্বপ্ন দেখেছিলেন সমাজতন্ত্র দ্বারা আধুনিক সমাজকে শান্তিপূর্ণ পুনর্গঠনের ব্যাপারে কিন্তু এই মূল প্রশ্নকে গণ্য না করে, যেমন শ্রেণিসংগ্রামের, শ্রমিক শ্রেণি দ্বারা রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের, শোষকদের শ্রেণির প্রভুত্ব উৎখাতের প্রশ্নকে।”[৪]
কমিউনিজমের ধারনা ততদিন পর্যন্ত কল্পলোক থেকে বিজ্ঞানে রূপান্তরিত হতে পারেনি, যতদিন না প্রয়োজনীয় সামাজিক, অর্থনৈতিক, শ্রেণিজনিত ও তাত্ত্বিক পটভূমি পরিপক্কতা লাভ করেছে। এই পটভূমি মূলত গড়ে উঠেছিল উনিশ শতকের চল্লিশের দশকে। এর মধ্যে প্রধান ও নির্ধারক ছিলো এই যে, পশ্চিম ইউরোপের সুবৃহৎ রাষ্ট্রগুলিতে পুঁজিবাদ নিজস্ব পরিপক্কতা লাভ করেছিলো।[৫]
তথ্যসূত্র:
১. ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস, ইউটোপীয় ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র, মার্কস এঙ্গেলস রচনা সংকলন, দ্বিতীয় খণ্ড প্রথম অংশ, প্রগতি প্রকাশন মস্কো, ১৯৭২, পৃষ্ঠা ১১৫
২. এঙ্গেলস এর এ্যান্টি-ডুরিং, কাজল বন্দ্যোপাধ্যায় অনূদিত, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি, ২০০৭, পৃষ্ঠা ২৮
৩. এঙ্গেলস এর এ্যান্টি-ডুরিং, কাজল বন্দ্যোপাধ্যায় অনূদিত, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি, ২০০৭, পৃষ্ঠা ২৯-৩০
৪. V.I. Lenin, ‘On Co-Operation’, Collected Works, Vol. 33, 1973, page 473
৫. এই প্রবন্ধের বেশিরভাগ তথ্য খারিস সাবিরভ, কমিউনিজম কী, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, ১৯৮৮, পৃষ্ঠা ৯৯-১৩৬ থেকে নেয়া হয়েছে। প্রবন্ধটি অনুপ সাদি রচিত ২০১৫ সালে ভাষাপ্রকাশ ঢাকা থেকে প্রকাশিত সমাজতন্ত্র গ্রন্থের ৩৭-৪৪ পৃষ্ঠা থেকে নেয়া হয়েছে এবং রোদ্দুরের পাঠকদের জন্য এখানে প্রকাশ করা হলো।
রচনাকালঃ নভেম্বর ৫, ২০১৪
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।