টাঙ্গন নদী বা টাংগন নদী বা টাঙ্গণ নদ (ইংরেজি: Tangon River) বাংলাদেশ ভারতের একটি আন্তঃসীমান্ত নদী। এই নদীটি বাংলাদেশের পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও ও দিনাজপুর জেলা এবং পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। নদীটির বাংলাদেশ অংশের দৈর্ঘ্য ১২৩ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ১২০ মিটার এবং নদীটির প্রকৃতি সর্পিলাকার। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড বা পাউবো কর্তৃক টাংগন নদীর প্রদত্ত পরিচিতি নম্বর উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের নদী নং ৪৮।[১]
আন্তর্জাতিক প্রবাহ
টাংগন নদী পঞ্চগড় জেলার পঞ্চগড় সদর উপজেলার মাগুরা ইউনিয়নের বিলাঞ্চল হতে উৎপত্তি লাভ করেছে। অতঃপর নদীটি ঠাকুরগাঁও জেলাধীন পীরগঞ্জ উপজেলার বাইরচুনা ইউনিয়ন দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ দিনাজপুর জেলায় প্রবেশ করেছে। এরপর নদীটি মালদহ জেলা অতিক্রম করে বাংলাদেশের চাঁপাই নবাবগঞ্জ জেলার ভােলাহাট সীমান্তের কাছে পৌঁছে যায় ও তারপর পারে মহানন্দা নদীতে গিয়ে পতিত হয়।
টাঙ্গন নদী ব্যবস্থা
পঞ্চগড় সদর উপজেলার মাগুরা ইউনিয়নের জলাভূমি থেকে উৎপত্তির পর নদীটি দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে ঠাকুরগাঁও উপজেলার রাজাগাঁওএর কাছে আটওয়ারী থেকে আসা রসিয়া নদীর সাথে মিলিত হয়। ঠাকুরগাঁও শহরের পশ্চিম দিক দিয়ে প্রবাহিত হবার সময় এর বাম তীরে সেনুয়া নদী এসে পড়ে। ঠাকুরগাঁও শহর পার হলে এর ডান তীরে শুক নদ এসে মিলিত হয়। এরপর টাঙ্গণ নদ পীরগঞ্জ উপজেলায় ঢুকে যায় ও ডানদিক থেকে আসা লাচ্ছি নদীর সাথে মিলিত হয়। টাঙ্গণ নদ এরপর ভাটিতে দিনাজপুর জেলার বােচাগঞ্জ উপজেলার সীমানা ধরে এগুতে থাকে ও ছাতৈলের কাছে ভারতে প্রবেশ করে। এর আগে জলাভূমি থেকে সৃষ্ট রণগাঁও নদী এর বামতীরে এসে পড়ে।
টাঙ্গন নদ ভারতে প্রবেশের বেশ কিছু পর বিরল উপজেলা থেকে সীমান্ত পার হয়ে আসা ,তুল্লাই/তেঁতুলিয়া নদী এসে এর বামতীরে পতিত হয়েছে। তুল্লাই নদী বােচাগঞ্জ উপজেলার ঈশানিয়া জলাভূমি থেকে উৎপন্ন হয়ে বিরল উপজেলায় প্রবেশ করেছে ও তারপর এই উপজেলার ভান্ডারার কাছ দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছে। টাঙ্গণ ও তুল্লাই নদীর মিলিত প্রবাহ দক্ষিণ দিনাজপুর ও মালদা জেলার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশের চাঁপাই নবাবগঞ্জ জেলার ভােলাহাট সীমান্তের কাছে পৌঁছে যায় ও তারপর পারে মহানন্দা নদীতে গিয়ে পতিত হয়।[২]
টাঙ্গন নদীর অন্যান্য তথ্য
টাংগন নদী পঞ্চগড় সদর, আটোয়ারী, বোদা, ঠাকুরগাঁও সদর, পীরগঞ্জ ও বোচাগঞ্জ উপজেলা দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। নদীটি জোয়ারভাটা প্রভাবিত নয়। টাংগন নদীর অববাহিকার প্রকল্প হচ্ছে টাংগন ব্যারাজ সেচ প্রকল্প, ঠাকুরগাঁও শহর রক্ষা প্রকল্প এবং বুড়িবাঁধ সেচ প্রকল্প। ঠাকুরগাঁও পৌরসভা এই নদীর তীরে অবস্থিত। নদীটিতে ০.৯৫ কিলোমিটার বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ আছে।
মৌসুমি প্রকৃতির এ নদীতে বর্ষার সময় পর্যাপ্ত মাত্রায় পানি প্রবাহিত হয়। এ সময় নদীর পাড় উপচে তীরাঞ্চল প্লাবিত হয়ে থাকে এবং বিভিন্ন অংশে ভাঙনপ্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। তবে শুষ্ক মৌসুমে নদীতে পানির প্রবাহ থাকে না। সোং ও সেনুয়া এই নদীর উপনদী।
টাঙ্গন নদী সংক্রান্ত লোককাহিনী
টাঙ্গন কীভাবে তৈরি হলো তাই নিয়ে একটি লোককাহিনী এই অঞ্চলের বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের মুখে এখনো শোনা যায় । সেই কাহিনীটি এ রকম — ছোটবেলায় পার্বতী নাচতে নাচতে এই পুন্ড্রদেশে চলে এসেছিল। এক সময় নাচ থেমে গেলে সে দেখতে পেল, এ-এক অজানা দেশ । সে কাঁদতে শুরু করল । তার কান্না শুনে বলি নামে এক দৈত্য তার কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কে? কোথা থেকে এসেছ?’ পার্বতী তার পরিচয় দিয়ে বলল, ‘আমাকে পৌছে দাও আমার বাড়িতে।’ বলি তখন দক্ষালয়ে পার্বতীকে পৌছে দিল। দক্ষ রাজা বলির এই আচরণে সন্তুষ্ট হয়ে বললেন, ‘কি বর চাও?’ বলি বলল, ‘মহারাজ, আপনার মেয়ের মতো টংকন করে করে নদী বহে যেতে পারে, আমাকে সেই বর দিন। যে নদী দেখে এই দেশের মানুষ পার্বতীকে কন্যার মতো মনে রাখতে পারবো।’ দক্ষ রাজা বললেন, তথাস্তু। সেই থেকে এই নদীর নাম হলো টঙ্গন, যা বর্তমানে টাঙ্গন নামে পরিচিত।[৩]
তথ্যসূত্র:
১. মানিক মোহাম্মদ রাজ্জাক, বাংলাদেশের নদনদী: বর্তমান গতিপ্রকৃতি। কথাপ্রকাশ, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি, ২০১৫, পৃ: ১১৮-১১৯।
২. ম ইনামুল হক, বাংলাদেশের নদনদী, অনুশীলন ঢাকা, জুলাই ২০১৭, পৃষ্ঠা ৪৩।
৩. ড. অশোক বিশ্বাস, বাংলাদেশের নদীকোষ, গতিধারা, প্রথম প্রকাশ, ফেব্রুয়ারি ২০১১, পৃষ্ঠা ২১১।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।