ডি. ডবলিউ, গ্রিফিথ যখন ‘ইনটলারেন্স’ আর ‘দি বার্থ অব নেশন’ করেছিলেন, তখনই সত্যি সিনেমা জন্মগ্রহণ করেছিল। সে হলাে ১৯১৮-২০ সালের ব্যাপার। তার আগেই অবশ্য ‘গ্রেট ট্রেন রবারি’তে প্রথম ক্লোজ-আপ ব্যবহৃত হয়েছিল। সেটা ১৯০৩ সালে।
‘ইনটলারেন্স’ এবং ‘দি বার্থ অব এ নেশন’ যখন নবীন সােভিয়েত রাশিয়ায় পৌছল, তখন কুলেশভ তার ‘ওয়র্কশপ’ খুলে ফেলেছেন এবং এক্সপেরিমেন্ট করে যাচ্ছেন। তিনি ক্রিমিয়াতে হাত-ধরাধরি একটি ছেলে ও একটি মেয়েকে দেখালেন, তার পর দেখালেন ওয়াশিংটনের হােয়াইট-হাউস, তারপর সেন্ট-পিটার্সবার্গের জারের প্রাসাদ এবং তার পরে তুষারপাত দেখালেন এবং দুটো ছেলেমেয়েদের মুখের ক্লোজ-আপ।
মন্তাজের জন্ম হল, এত দুরের বিভিন্ন ছবি মিলে একটা ঘটনায় দাড়িয়ে গেল। দর্শক বুঝতেও পারল না যে কতকগুলাে অসংলগ্ন ছবি একত্র হয়ে একটা ঘটনার সৃষ্টি করেছে। তারা ভাবল ব্যাপারটা একই জায়গায় ঘটছে। অথচ এক শট-এর সঙ্গে অন্য শট-এ হাজার হাজার মাইলের তফাত।
কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার সের্গেই আইজেনস্টাইন আর আর্টিস্ট ভি. পুদভূকিন– এঁরা কুলেশভের ওয়র্কশপে কর্মী হয়ে গেলেন। তারা প্রাণপণে বুঝতে চেষ্টা করলেন যে, মজাটা কী! সেইসময়েই গ্রিফিথের ছবি দুটো এসে পৌঁছল রাশিয়ায়। এ-ছবি দুটি দেখে এঁদের চক্ষু চড়কগাছ। তখন থিয়ােরির দিকে মন গেল। এঁরা খাটতে আরম্ভ করলেন। আইজেনস্টাইনের প্রথম ছবি স্ট্রাইক’। এ দেশে কেউ দেখেছে কি না জানি না। তারপর এল ‘ব্যাটলশিপ পােটেমকিন’। তার ওডেসা স্টেপ সিকোয়েন্স আজও পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র-ফর্ম বলে গণ্য হয়ে থাকে, এবং সেটা সত্যিই তাই। ওর ওপরের স্তরের কাজ আজ পর্যন্ত কেউ কোথাও করতে পারে নি। পুড়ােভকিনের ‘মাদার’(গাের্কি) তার পাশেই দাঁড়িয়ে।
এই দুই শিল্পীর ওই সৃষ্টিগুলাে এবং পরবর্তী কর্মকাণ্ড পৃথিবীর সব চিত্রনির্মাতাদের মুখে ভাষা দিয়েছে। এই দুজন না থাকলে ছবি ছবিই হত না।
তখন ছিল ঠিক বিপ্লব-পরবর্তী যুগ। জিনিসপত্তর কিছু পাওয়া যেত না। মস্কোর পথে পথে বরফ উত্তরণ করে এদের স্টুডিওতে যেতে হত! কী যে কষ্টে এরা জিনিসপত্র সংগ্রহ করতেন! সে আমরা ভাবতেও পারি না। তবু তারাই ছবির জগতের ভিত্তি স্থাপন করে গেলেন।
এই দুজন ছিলেন পরমবন্ধু। কিন্তু দুজনের মধ্যে একটু ঝগড়াও ছিল। পুদভূকিন বললেন ছবি একটার পর একটা শট-এর মিলনের ব্যাপার। তাকে দিয়ে মানে তৈরি হয়।
আইজেনস্টাইন বললেন, এভরি শট ইজ ইন কনফ্লিকট উইথ দি আদার, দ্বন্দ্বের সাহায্যে তৈরি হয়। একটা শট, তার নিজস্ব মানে নেই, পরের শটটারও নিজস্ব কোনাে মানে নেই ; কিন্তু দুটো মিলে একটা তৃতীয় মানে তৈরি হয়।
সােজা কথায় থিসিস, অ্যান্টিথিসিস, সিন্থিসিস। এখানেই আসে ডায়লেকটিকস, এখানে আসে কার্ল মার্কসের অ্যাপ্রােচ টু রিয়েলিটি’। একটা এদিকে একটা ওদিকে দুটো মিলিয়ে একটা তৃতীয় মানে তৈরি করে। এই নিয়ে রাতের পর রাত তাদের ঝগড়া হত। যখন বরফঝরা মস্কোতে না ছিল কাঠ, না ছিল জ্বালানি। খাবার পাওয়া যেত না। সেইসময় এই দুজনে যে-ঝগড়া করে গেলেন, তার দ্বারা আমরা মানুষ হলাম।
তার পরে এলেন দভঝেংকো। ওঁর প্রথম ছবি ইজভিন-গােরা’। এ-ছবি দেকে মসফিল্মের পরিচালক এই দুজনকে ডাকলেন, আইজেনস্টাইন ও পুদভকিন বললেন, এছবিতে কিছুই বােঝা যাচ্ছে না, পাগলের প্রলাপ বলে মনে হচ্ছে।
আইজেনস্টাইন বললেন, আবার দেখব, এবারে মস্কোভা থিয়েটারে। ছবি চলাকালে হলের পাশে তরুণ দভুঝেংকো। আশেপাশে ভদকা ছিল না। কিন্তু যখন ছবি শেষ হলাে আইজেনস্টাইন আর পুদভকিন সম্পূর্ণ মাতাল। আইজেনস্টাইন দভঝেংকোকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে বললেন, ডায়লেকটিকস-এ এইরকম ব্যবহার কেউ দেখে নি। তুমি বিরাট।
এই তিনটি তােক মার্কসিস্ট ডায়লেকটিসিজম ছবিতে ব্যবহার করে ছবিতে প্রাণ প্রােথিত করে দিয়ে গেছেন। আজকে আমরা যারা ছবি করার নামে চালবাজি করি, তাদের সকলের অস্থিমজ্জায় এই তিন ব্যক্তি বিদ্যমান। যদি কোনাে ভদ্রলােক কখনাে কিছু করে থাকতে পারেন সারা পৃথিবীতে, এরাই হচ্ছেন তার প্রাণবস্তু।
এঁদেরকে প্রণাম।
এর পরে বহুকাল কেটে গেছে। কার্ল ড্রেয়ার তার প্যাশন অব জোয়ান অব আর্ক’ ছবিতে ফ্যালকননত্তিকে ব্যবহার করলেন। ড্রেয়ার একজন স্ক্যান্ডিনেভিয়ান, ফ্যালকনেত্তি একজন ইটালিয়ান, আর, জোয়ান অব আর্ক’ হচ্ছে ফরাসি দেশের ন্যাশনাল হিরােইন। একটা বিদেশি পরিচালক সারা ফ্রান্স দেশে মেয়ে খুঁজে পেল না। একটা ইটালিয়ান মেয়েকে নিয়ে এসে কাজ করল। অথচ যে-চরিত্রের জন্য ব্যবহার করল তিনি হচ্ছেন সমস্ত ফরাসি জাতির প্রতিনিধি। এই নিয়ে আপত্তির প্রচণ্ড ঝড় উঠেছিল। ড্রেয়ার সেদিকে ক্ষেপও করলেন না, পুরাে ছবিটা শেষ করলেন।
এ-ছবি যাঁরা দেখেছেন, তারা বুঝবেন পৃথিবীর চলচ্চিত্রে অভিনয়ের ক্ষেত্রে এতবড়াে ঘটনা আর ঘটে নি। সমতু ফরাসি দেশের আত্মাকে প্রচণ্ডভাবে প্রকাশ করা হয়েছিল এই ছবিতে। এবং ক্যামেরার কোন রকম গতি না রেখে দ্বন্দ্বমূলক বক্তববাদী পরিচালনা কাকে বলে তা বুঝিয়ে দিয়েছেন। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ তিন-চারখানি ছবির মধ্যে এটি পড়ে।
মুশকিল হচ্ছে যে, এইভাবে শিল্পীদের নিয়ে কাজ করতে গেলে আশঙ্কা ঘটে।
ফ্যালকনেত্তি ছবি শেষ হওয়ার পরে যদিও তখন মাত্র আঠারাে বছর বয়স আত্মহত্যা করলেন!
তারপর অনেকেই নাম করা যায়। যারা ডায়লেকটিকস অব সিনেমাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যান। যেমন বার্ট হানস্ট্রা, ইয়ােরিস ইভেন্স, বেসিল রাইট ইত্যাদি। রবার্ট ক্লাহাটি এবং জন গ্রিয়ারসন- এই ডায়লেকটিক্যাল অ্যাপ্রােচটাকে কোথায় পৌঁছে দিয়েছিলেন, তা ফ্ল্যাহাটির লুইসিয়ানা স্টোরি’ দেখলেই বােঝা যাবে। তার বেশি আর এগােতে হবে। এখানে আমাকে সংক্ষিপ্তভাবে কথা বলতে হচ্ছে, কারণ এর ওপরে বিরাট বই লেখা চলে।
তারপর বর্তমান যুগে ডায়লেকটিক্যাল কাজে অনেকেই ব্যাপৃত। তাদের মধ্যে জাপানের ওজু, মিসসাশুচি, কুরােসাওয়া এবং নবীন ওসিমা, ইটালির বিশেষ করে ফেলিনি এবং রসােলিনি, ফ্রান্সের জালুক গদার এঁরা কাজ করে যাচ্ছেন। মেক্সিকোর ভূলাদিমির টোরে নিলসন, গ্রীসের কায়নিস- এঁরা কাজ করে যাচ্ছেন।
সর্বশ্রেষ্ঠ হচ্ছেন, আমার মতে, জীবিতদের মধ্যে, লুই বুনুয়েল। তার তুলনা নেই। তিনি হচ্ছেন সর্বশ্রেষ্ঠ। আমি ভীষণ দুঃখিত যে, আমার দেশের মানুষ এদের কাজগুলাে দেখতে পায় না।
আশা করি এমন একটা দিন আসবে যখন দেশের লােকেরা এদের কাজ দেখতে পাবে।
ঋত্বিক ঘটক (জন্ম : ৪ নভেম্বর, ১৯২৫ – মৃত্যু : ৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৬) একজন বিখ্যাত বাঙালি চলচ্চিত্র পরিচালক। বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে তাঁর নাম বহুবার বহুভাবে উচ্চারিত। তিনি পরিচালনা করেছেন নাগরিক (১৯৫২, মুক্তি ১৯৭৭), অযান্ত্রিক (১৯৫৮), বাড়ী থেকে পালিয়ে (১৯৫৮), মেঘে ঢাকা তারা (১৯৬০) কোমল গান্ধার (১৯৬১), সুবর্ণরেখা (১৯৬২), তিতাস একটি নদীর নাম (১৯৭৩), যুক্তি তক্কো আর গপ্পো (১৯৭৭) প্রভৃতি চলচ্চিত্র।