বাংলা ছবির ক্ষেত্রে বাংলা সাহিত্য যেভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে সেটাকে সম্পূর্ণভাবে সাহায্যকারী জিনিস বলে মনে করা উচিত হবে না। বাংলা সাহিত্যের অসীম প্রভাবে ছবিটা “বই”-ই হয়ে দাড়িয়েছে। এবং আমাদের ছবি-করিয়েদের প্রথম এবং প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে বইটাকে ছবিতে কতখানি বিশ্বস্তভাবে রূপান্তরিত করা যায়। এবং সে কাজ আজও সমানে চলেছে। স্বাধীনভাবে ছবির জন্য লেখা এখনও মারাত্মকভাবে কম হচ্ছে।
সাহিত্যকে আশ্রয় যখন করতেই হবে, না করে যখন উপায় নেই বলে মনে হচ্ছে সেখানে সাহিত্যের প্রতি একজন ছবি করিয়ের কী দৃষ্টিভঙ্গি হতে হবে সেটা নিয়ে আমাদের খানিকটা ভেবে দেখার প্রয়ােজন আছে। এখানে আইজেনস্টাইন্ সাহেবের কিছু মূল্যবান লেখার কথা মনে পড়ছে।
আইজেনস্টাইন সাহেবের মতে যে-কোনাে উপন্যাসকে ছবি করতে গেলে তিন রকম ভাবে এগনাে যায় : ১, সম্পূর্ণ গ্রহণ, ২. আংশিক গ্রহণ, ৩. পয়সার জন্য করে যাওয়া। পয়সার জন্য যে গল্পকে ছবি করতে হয় সেটা নিয়ে গভীর চিন্তার কোনাে অবকাশ নেই। সেটা পরিষ্কার। সম্পূর্ণ গ্রহণ। সেখানেও চিত্রশিল্পের নিজস্ব বক্তব্য কিছু আছে, একটা মাধ্যম থেকে আর-একটা মাধ্যমে যেতে গেলে খানিকটা রদবদলের প্রয়ােজন হবেই। সম্পূর্ণ গমটি যেমন আছে ছবিতে তেমনভাবে রূপান্তরিত করা যায় না। সেখানে লেখকের মূল বক্তব্যের প্রতি ধর্মনিষ্ঠ থাকা অত্যন্ত প্রয়ােজন। এবং সেই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ছবির প্রয়ােজন অনুসারে গুছিয়ে নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। যেমন ধরুন পুডকিনের মাদার’। পাভেল যেখানে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে মার সঙ্গে দেখা করতে আসছে, উপন্যাসে আছে সেটা মায়ের বাড়ি, কিন্তু পুদভকিন অনুভব করলেন মাধ্যম অনুসারে এটা একটা ঘরের মধ্যে। হলে আবেগের বিশালতা দেখানাে যাবে না। তাই তিনি ফাঁকা মাঠের মধ্যে মাকে নিয়ে এলেন-দুপাশে যেখানে মাথা-উঁচু গম হাওয়ায় দুলছে আর পাভেল আসছে ছুটে আলাের পথ বেয়ে দুজনের মিলন এই উন্মুক্ত আকাশের তলায় হল। এটা কিন্তু গাের্কির লেখায় ছিল না। কিন্তু আন্তরিক দিক থেকে এটাই সমস্ত ঘটনার প্রতীকরূপে প্রকটমান হয়ে দাঁড়াল।
এ ছাড়াও, সাহিত্যের চিত্ররূপ দিতে গেলে অনেক সময় ইংরাজিতে যাকে বলে telescope করা অথবা বাড়ানাে- এই দুটোরই প্রয়ােজন পড়ে। কিন্তু লেখকের বক্তব্যের প্রতি সত্যনিষ্ঠ থাকতে হয়।
এই গেল প্রথম দিককার কথা। এর পরে আসে আংশিক গ্রহণের পর্যায়। এখানে উদাহরণস্বরূপ আইজেনস্টাইন সাহেবের ‘An American Tragedy’র কথা মনে পড়ে। ছবিটি উনি করতে পারেন নি। হলিউডের প্যারামাউন্ট ওকে ছবিটি করতে দেয়নি। উপন্যাসটি থিয়ােডাের ড্রেজারর লেখা। এখানে একটি ছেলে বড় হওয়ার জন্যে একটা বড়ােলােকের মেয়ের সঙ্গে প্রেম করেছিল। সে নিজে ছিল একটা মজদুর। এবং তার একটি মজদুর প্রেমিকা ছিল। ও যখন বুঝল যে ওর প্রথম মজদুর প্রেমিকা ওর উচ্চাশার পথে বাধা হয়ে দাড়াবে তখন তাকে খুন করবে ঠিক করল। সমুদুরে নৌকো নিয়ে মেয়েটিকে ও বেড়াতে যেতে বলল। ওরা দুজনেই গেল। উপন্যাসে আছে যে হঠাৎ দৈবদুর্বিপাকে নৌকোটা উলটে গেল এবং মেয়েটি মারা গেল। আইজেনস্টাইন সাহেব এই বিখ্যাত ঘটনাটিকে ‘পাতি বুর্জোয়া’ Reading বলে মনে করলেন। তিনি তাই তার ফিরে যে Script করেছিলেন তাতে দেখালেন যে accidentনয়, ছেলেটি নিজের স্বার্থে ইচ্ছে করেই নৌকো উলটে দিয়েছিল। ড্রেজার সাহেব তখন বুড়ো। তিনি সেটাকে সমর্থন করেছিলেন। এইটে হচ্ছে আংশিক গ্রহণ। যার ফলে সমস্ত উপন্যাসের ব্যাখ্যা বদলে যায়।
তৃতীয় ধরনের উপন্যাস নিয়ে আমাদের আলােচনা করার কিছুই নেই কেননা সেটা সম্পূর্ণ আর্থিক প্রয়ােজনের তাগিদে লেখা, সেগুলাে শিল্পের আওতায় আসে না। | আমাদের বাংলা দেশে কোনাে শিল্পীই এসব ব্যাপার সম্পর্কে অবহিত আছেন বলে মনে হয় না। তারা অন্ধের মতাে খালি ছবি করে যাচ্ছেন বই ধরে ধরে। কিন্তু এর বক্তব্যের ভেতরে অনুপ্রবিষ্ট হতে পেরেছেন কি না সে বিষয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ আছে। নাম করে মানুষকে চটাব না। কিন্তু এই-ই হচ্ছে বাংলা দেশের সাধারণ চেহারা। এর থেকে মুক্তি করে আমরা পাব জানি না কিন্তু পেতেই হবে। | আমার নিজের ছবি- অযান্ত্রিক। সুবােধ ঘােষের একটি বিখ্যাত গল্পের ভিত্তিতে তৈরি। সে গল্প আপনারা নিশ্চয়ই সকলে পড়েছেন। ঐ এগারাে পাতার গল্পটিকে একটি সম্পূর্ণ ছবিতে পরিণত করতে আমাকে নিশ্চয়ই ভাবতে হয়েছিল। কতখানি সার্থক হয়েছে সেটা আপনারা বলবেন- তবে আমি চেষ্টার ত্রুটি করি নি। সুবােধবাবুর মূল বক্তব্যের প্রতি আমি চেষ্টা করেছি বিশ্বস্ত থাকতে। জানি না কতখানি কৃতকার্য হয়েছি।
এর পর বাড়ি থেকে পালিয়ে। শিবরাম চক্রবর্তীর যুদ্ধ-পূর্বোত্তর বাংলা একটা ছবিকে আমি টেনে আনার চেষ্টা করেছি- যুদ্ধ-উত্তর বাংলাদেশে। ওতে নানারকম চেষ্টাচরিত্তির করা গিয়েছিল। আমি জানি না কতখানি সফল হয়েছি। তবে মূল বক্তব্যটাকে আমি নিশ্চয়ই বদলে দেবার চেষ্টা করেছিলাম। কী হয়েছে সেটা আপনারা জানেন। | ‘মেঘে ঢাকা তারা’ এর নামটাও আমার দেওয়া। চেনামুখ’ নামে কোনাে এক জনপ্রিয় কাগজে এ গল্পটা বেরিয়েছিল। এর মধ্যে কোনাে একটা জিনিস আমাকে আঘাত করেছিল। তাই Bill শেক্সপিয়রের “The cloud Clapped Star” এইটে আমার মাথায় এসে দাঁড়িয়েছিল। এবং সম্পূর্ণভাবে ভেঙে আমি এই ছবির Script করি। এটা খানিকটা Sentimental হতে পারে; কিন্তু এর মধ্যে থেকেই আমার ছবিতে overtones throw করার ব্যাপারটা আসতে আরম্ভ করে। এইখানে আমি ভারতীয় Mythology-কে ব্যবহার করা শুরু করি- যেটা আমার জীবনের একটা অঙ্গ। মেঘে ঢাকা তারা নিয়ে বেশি কিছু বলার নেই। শুধু এইটুকু বলব যে মেঘে ঢাকা তারা আমার চিন্তাশক্তিকে প্রকাশ করছে এখানে লেখকের কোনাে ভূমিকা নেই। কথাটা কষ্টকর হলেও সত্যি।
‘কোমল গান্ধার’-কোমল গান্ধার’ এই প্রথম ছবি যেখানে আমি আমার নাম পরিষ্কার ভাবে দিয়েছিলাম। এটাকে বুঝতে হলে তদানীন্তন কালের নাট্য আন্দোলনের সামিল হতে হয়। তা নইলে এর সম্পর্কে বেশি কিছু বােঝানাে যাবে না। কাজেই ‘কোমল গান্ধার’ ছবি ভালাে কি খারাপ এ আলােচনায় আমি প্রবেশ করতে রাজী নই। এটা আপনারা নিজেদের যুক্তি-বিবেচনা অনুসারে বিচার করে দেখবেন।
‘সুবর্ণরেখা‘- কোমল গান্ধারে’ গল্প নেই শুনে একটা আমার রাগ হয়েছিল। তাই সুবর্ণরেখা’তে চুটিয়ে গল্প দিলাম, বক্তব্য একই। খালি প্রকাশভঙ্গি বিভিন্ন। সুবর্ণরেখা’ মানুষকে কতখানি প্রভাবিত করতে পেরেছে সেটা আমি জানি না। তবে চেষ্টা আমার পরিপূর্ণই ছিল। জানি না, কতখানি সফল হতে পেরেছি। কিন্তু এর পেছনে যেটা বক্তব্য সেটা খুব সহজ নয়। এটা বুঝতে হলে খানিকটা পরিমাণে উপনিষদের সঙ্গে যােগাযােগ রাখতে হয়। আমি যে শেষ করেছি চরৈবেতি’ মন্ত্রের ওপরে এটাকে বুঝতে ভারতীয় দর্শনের সঙ্গে খানিকটা যােগাযােগ রাখা দরকার। আমার পক্ষে এর বেশি পরিষ্কার করে বলা সম্ভবপর নয়। বাকিটুক যারা ছবি দেখবেন তাদের হাতেই ছেড়ে দেওয়া যাক।
আজ এই পর্যন্ত। নমস্কার।
ঋত্বিক ঘটক (জন্ম : ৪ নভেম্বর, ১৯২৫ – মৃত্যু : ৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৬) একজন বিখ্যাত বাঙালি চলচ্চিত্র পরিচালক। বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে তাঁর নাম বহুবার বহুভাবে উচ্চারিত। তিনি পরিচালনা করেছেন নাগরিক (১৯৫২, মুক্তি ১৯৭৭), অযান্ত্রিক (১৯৫৮), বাড়ী থেকে পালিয়ে (১৯৫৮), মেঘে ঢাকা তারা (১৯৬০) কোমল গান্ধার (১৯৬১), সুবর্ণরেখা (১৯৬২), তিতাস একটি নদীর নাম (১৯৭৩), যুক্তি তক্কো আর গপ্পো (১৯৭৭) প্রভৃতি চলচ্চিত্র।