উত্তরবঙ্গের বাংলা লোকসংগীতের রত্নসমূহের মধ্যে মালদহ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী অঞ্চলে এক বিশেষ ধরনের গান গম্ভীরা বা গম্ভীরা গান (ইংরেজি: Gombhira) নামে পরিচিত। এই গান বিশ শতকের শুরুর দিকে কেবল ধর্মীয় ভাবাপন্ন ছিলো, তবে ১৯২০-এর পরে এতে রাজনৈতিক ও সামাজিক উপাদান যুক্ত হয়েছে। এমনকি পরিবেশনাতেও নতুন রূপ এসেছে। তবে জলপাইগুড়ি জেলায় গমীরা নামে এক ধরনের লোকসংগীত আছে, তার প্রকৃতি স্বতন্ত্র।
গম্ভীরা গান আঞ্চলিক সঙ্গীত হলেও এটা বিশেষ একটি অনুষ্ঠানের সঙ্গে সংযুক্ত। সেই অনুষ্ঠান শিবের গাজন, ইহা এই অঞ্চলে আদ্যের গম্ভীরা বলিয়া পরিচিত। আদ্য বা শিবের গম্ভীরা উপলক্ষে যে গান হয়, তাহাও গম্ভীরা গান। গম্ভীরার অনুষ্ঠান উপলক্ষে মুখোস নৃত্যও হয়ে থাকে, সেটি গম্ভীরা নৃত্য বলে পরিচিত।[১]
গম্ভীরা লোকগানের ইতিহাস
পূর্বে বৌদ্ধ ‘হীনযান’ সম্প্রদায় বৈশাখী পূর্ণিমায় বুদ্ধের যে পূজা করতেন, সেই উৎসব পরে গম্ভীরা উৎসবের উপকরণের সহায়ক হয়। নানা পুরাণ গ্রন্থে, শিব ও শিবশক্তির পূজা ও বাদ্যসহকারে নাচ, গানের উৎসবের ইতিহাস পাওয়া যায়। শিব-দুর্গার এই উৎসবই গাজন বা গম্ভীরা নামে পরিচিত। গম্ভীরা সাধারণত মহান কৃষকের লোকগান এবং কৃষক ও অন্যান্য কারিগরদের মধ্যেই বেশী প্রচলিত। রাঢ় অঞ্চলের গাজনই, উত্তরবঙ্গের মালদহ ও তার আশেপাশের অঞ্চলে গম্ভীরা নামে পরিচিত।
চৈত্র সংক্রান্তির অন্তত পাঁচ দিন আগে হতেই এই উৎসবের সূচনা হয় এবং এই পাঁচ দিন ধরেই যে আচার পালন করা হয়ে থাকে, তাতে নানা আচার-মুলক সঙ্গীত গাওয়া হয়। এসবের মধ্যেও মানত করে সন্ন্যাসী হওয়ার রীতি প্রচলিত আছে এবং সন্ন্যাসীরাই আচার-সঙ্গীতে অংশ গ্রহণ করে থাকে। কিন্তু এই আচারানুষ্ঠানের বাইরেও সাধারণ লোক সমবেত হয়ে এক লৌকিক সঙ্গীতানুষ্ঠান পালন করে। তাতে একটি গানের আসরে শিবের ঘট স্থাপন করে শিবকে উদ্দেশ্য করেই নানা গীত রচনা করা হয়ে থাকে। গানগুলি সকলই সাময়িক ঘটনামুলক। প্রধানতঃ সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে ইহা বর্ষবিবরণী পর্যালোচনা মাত্র। চৈত্র সংক্রান্তির দিন বৎসরের ঘটনাবলীর একটা হিসাব নিকাশ নেয়া হয়, তাতে প্রধানতঃ সমাজের অভাব-অভিযোগের কথাই বিশেষ ভাবে শুনতে পাওয়া যায়। পরজীবী পরপীড়ক অসভ্য জমিদারদের বিরুদ্ধে মহান কৃষকগণ এই গানগুলির মাধ্যমে শিবের কাছে তাদের অভিযোগ জানাতেন।
গম্ভীরার গানগুলি কেবলমাত্র সাময়িক ঘটনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে বলে এগুলোর সাহিত্যগুণ বিশেষ কিছুই থাকে না। ইহাদের মধ্যে কোন ভাব-গভীরতাও নাই; রচনার পরিপাট্য নাই; কোনদিক দিয়াই কোন কবিত্বেরও স্পর্শ নাই। আধুনিক কালে ইহাদের মধ্য সমসাময়িক রাজনৈতিক চিন্তা গিয়াও প্রবেশ করিয়াছে।
এই গানের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য এই যে, প্রত্যেকটি গানই শিবঠাকুরকে উদ্দেশ্য করে রচিত হয়ে থাকে। সংসারের সকল সুখদুঃখ অভাব অভিযোগের কারণই শিব, তাহার নিকট এই সমস্ত বিষয়ে অভিযোগ জানিয়ে প্রতিকারের প্রার্থনা করাই গম্ভীরা গানের মূল উদ্দেশ্য। শিব ঘটে অধিষ্ঠান করিয়া নির্বিকারভাবে এই সকল অভিযোগ, এমন কি, অনেক সময় তিরস্কারও শুনিয়া যান। ইহাদের মধ্য দিয়া ভক্তের সঙ্গে ভগবানের কোনো সুদূর পার্থক্য কল্পিত হয় না।
তথ্যসূত্র
১. আশুতোষ ভট্টাচার্য, বঙ্গীয় লোক-সঙ্গীত রত্নাকর, প্রথম খন্ড, এ মুখার্জি এন্ড কোম্পানি প্রা. লিমিটেড, কলকাতা, পুনর্মুদ্রণ, ১৯৭৭, পৃষ্ঠা ৩৪১-৩৪২।
রাজশাহী অঞ্চলের একটি গম্ভীরা গান নিচে ইউটিউব থেকে শুনুন।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।