আমাদের দেশে বর্তমানে যে-সব ছবি হচ্ছে, তার মধ্যে কিছু কিছু প্রশংসনীয় ব্যাপার নিশ্চয়ই আছে। তারা মোটামুটি ছবির মাধ্যমটাকে ধরতে পেরেছেন। কিন্তু তাই বলে এই নয় যে পৃথিবীর চলচ্চিত্র প্রগতির সঙ্গে এরা হাত মেলাতে পেরেছেন। বিশেষ করে সমাজ চেতনার দিকটা।
আমাদের সবচেয়ে বড়ো দুঃখ হচ্ছে এই যে, আমাদের দেশের শিল্পীরা সমাজ সচেতন নয়। মানুষের সাধারণ দুঃখ-ভালােবাসার মধ্যে এঁরা প্রবেশ করেন না। ফলে এঁদের শিল্পসৃষ্টি একটা পরিমিতির মধ্যে থেকে যায়। সেইজন্যে সর্বাঙ্গীণ আনন্দ পাবার অবস্থা ঘটে ওঠে না। এঁদের কাজকর্ম সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত মতামত নানারকম থাকতে পারে, সেগুলো তুলে আমি জল ঘোলাতে চাই না। কিন্তু মানুষকে ভালোবাসার একটা ব্যাপার আছে। এবং সেইখানে কাউকে ক্ষমা করার কোনো ব্যাপার নেই।
এ দেশে দু-একজন শিল্পী কিছু কাজকর্ম করেছিলেন, তারাও আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছেন দেখছি। আমার ভয় ঠিক না হলেই খুশি হব, কিন্তু এঁদের ব্যবহারে মনে হচ্ছে যে এঁরা নিজেদেরকে বিক্রি করার জন্যে প্রস্তুত হয়ে পড়েছেন। ভগবান করুন এঁরা যেন সত্যি বিক্রীত না হয়ে যান। এই দেশে এখন দরকার প্রচণ্ড ভাবে ছবি করা। এবং দরকার কিছু উৎসাহী যুবকের যারা জান দিয়ে দেবে কাজের জন্যে। এদেশে এখন চলচ্চিত্র সম্পর্কে মানুষের উৎসাহ জেগেছে। তারা বিভিন্ন শিল্প সোসাইটি করেছে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় জেলায়। এদের উৎসাহ এবং অকৃত্রিম আগ্রহ ভালোবাসার জন্য। কিন্তু এরা জানে না যে ফিল্মি জগৎটা কী অভদ্র এবং ইতর। এর মাঝখান থেকেই লোককে কাজ করতে হয়, এবং তার ফাঁক দিয়ে কতকগুলো কথা বলবাব চেষ্টা করা হয়। এ যে কতখানি দুরূহ, তা একমাত্র ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বুঝবে না, বোঝানো সম্ভবপর নয়। বাংলা ছবি সম্পর্কে আমার পক্ষে বেশি কিছু বলা মুশকিল, এই কারণে যে, যারা কাজ করছেন, তারা প্রত্যেকেই আমার ঘনিষ্ঠ এবং নিকট সহযোগী। এদের সম্পর্কে এইজন্যে নামধাম ধরে কিছু বলতে পারলাম না। সেটা মনুষ্যত্বে বাধে। তবে এইটুকু বলতে পারি, এখনকার বাংলা ছবি দেখে আমি খুবই হতাশ। যখন সারা পৃথিবী একটা দারুণ দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, যখন বিপ্লবের আহ্বান এর চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে— তখন আমরা এদেশে বসে এইসব বাজে ক্লাসের ব্যাপার করছি। অসহ্য।
আমার পক্ষে আধুনিক বাংলা ছবি সম্পর্কে বলা খুব কঠিন। আমি বাংলা ছবি প্রায় দেখি না। দেখলেই কষ্ট হয়। আমাদের মতো একটা দেশ, যার কোনো তুলনা নেই, আমাদের দেশের চলচ্চিত্র নির্মাণকারীরা সে দেশ সম্পর্কে কোনো খোঁজখবর রাখেন বলে মনে হয় না।
এইজন্য আমি যেটুকু দেখি, সেগুলো বিদেশী ছবি। তারা নিজের দেশকে ভালোবাসতে জানে। এই জিনিসটাই আমাদের দেশের চলচ্চিত্রকাররা পরিপূর্ণ হারিয়েছে। মানুষকে ভালোবাসা, দেশকে ভালোবাসা, মানুষের জীবন সংগ্রামের সঙ্গী হওয়া— এটা হচ্ছে সর্বশিল্পের শেষ কথা। এইটে যখন হারিয়ে যায়, তখন মানুষ সব হারায়। এর ঊর্ধ্বে কোনো কথা নেই। পয়সার জন্যে উল্টোপাল্টা কাজ যে-কোনো লোক করতে পারে, কিন্তু তাতে কোনো জায়গায় ব্যাপারটা পৌঁছায় না। লড়াই করাই সবচেয়ে বড়ো ঘটনা। এবং সেটা করার জন্যে যত রকমের দুঃখ আসুক, আঘাত আসুক ভয় করলে চলবে না।
আগামী দিনের ছেলেদের কাছে আমি আশা করব যে এরা সেই মনোভাব নিয়েই কাজে এগোবে। আমরা ইংরেজিতে যাকে বলে এই generation মোটামুটি শেষ হয়ে গেছে। এখন হচ্ছে নতুন ছেলেদের যুগ। ওরা কিছু করুক। ওদের মধ্যে দিয়েই আমরা প্রাণ পাব।
ওদের জন্যই আমরা বসে আছি।
ঋত্বিক ঘটক (জন্ম : ৪ নভেম্বর, ১৯২৫ – মৃত্যু : ৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৬) একজন বিখ্যাত বাঙালি চলচ্চিত্র পরিচালক। বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে তাঁর নাম বহুবার বহুভাবে উচ্চারিত। তিনি পরিচালনা করেছেন নাগরিক (১৯৫২, মুক্তি ১৯৭৭), অযান্ত্রিক (১৯৫৮), বাড়ী থেকে পালিয়ে (১৯৫৮), মেঘে ঢাকা তারা (১৯৬০) কোমল গান্ধার (১৯৬১), সুবর্ণরেখা (১৯৬২), তিতাস একটি নদীর নাম (১৯৭৩), যুক্তি তক্কো আর গপ্পো (১৯৭৭) প্রভৃতি চলচ্চিত্র।