বাংলাদেশে মার্কসবাদ প্রভাব বিস্তার করতে আরম্ভ করে বিশ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে। বিশ শতকের শুরু থেকেই বিপ্লবী অনুশীলন ও যুগান্তর দলের সদস্যবৃন্দের ভেতরে মার্কসবাদী চিন্তা খুব ক্ষুদ্র আকারে কাজ করতে থাকে। ১৯২০ সালের ১৭ অক্টোবর কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের দ্বিতীয় কংগ্রেসের পর তাসখন্দে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হলে বাঙলায় তার ঢেউ লাগে। ১৯২৫ সালের ভেতরেই দৈনিক সংবাদপত্রগুলির পাতায় পাতায় কমিউনিস্টদের বিপ্লবী পরিকল্পনার বিবরণ ছাপা হতে শুরু করে। লেখক বুদ্ধিজীবীরা সাম্যবাদ ও মার্কসবাদ নিয়ে লিখতে শুরু করেন। সেই প্রথম ভারতীয় বাঙালিরা সাম্যবাদ, সাম্যবাদী মতাদর্শ এবং ভারতে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে পারে। কাজী নজরুল ইসলামের কাব্যগ্রন্থ সাম্যবাদী প্রকাশিত হয় ১৯২৬ সালে। ১৯৪৬ সালে সিপিআই তেভাগা আন্দোলন নামে বাংলায় সামন্ত্রতন্ত্রের বিরুদ্ধে একটি জঙ্গি আন্দোলন শুরু করে।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক আন্দোলনের একটি শক্তিশালী ধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে বাঙলায় তেভাগা ও টংক আন্দোলন থেকেই। অর্থাৎ ব্রিটিশ আমলের শেষকাল থেকেই বাংলাদেশেও মার্কসবাদের চর্চা এবং মার্কসবাদ লেনিনবাদের ভিত্তিতে রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে উঠে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ১৯৪৮ সালে এদেশে মার্কসবাদ লেনিনবাদের ভিত্তিতে কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয়।
১৯৪৮ সালের কোলকাতা কংগ্রেসে পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে ওঠে পাকিস্তানের কমিউনিস্টদের করণীয় ছিল সমগ্র পাকিস্তানব্যাপী শ্রমিক শ্রেণীর পার্টি গড়ে তুলে তার নেতৃত্বে সকল জাতিসত্ত্বার জনগণের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম চালিয়ে সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব জয়যুক্ত করা। কিন্তু পাকিস্তান সরকারের ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি ও পশ্চিম পাকিস্তান জোনাল কমিটি বিপর্যস্ত হয়ে যায়। পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তান জোনাল কমিটি মার্কসবাদী লেনিনবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে সমগ্র পাকিস্তানব্যাপী বিপ্লব সম্পন্ন করার বিষয়টা গ্রহণ না করে উগ্র বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের পঙ্কে নিমজ্জিত হয়ে শুধুমাত্র পূর্ব পাকিস্তানব্যাপী কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করে।
১৯৪৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত কলকাতায় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত অনুসারে কংগ্রেসে আগত পাকিস্তানের প্রতিনিধিরা স্বতন্ত্রভাবে এক বৈঠকে মিলিত হয়ে ৯ সদস্যবিশিষ্ট পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করেন। এই কমিটিতে ছিলেন সাজ্জাদ জহির, খোকা রায়, নেপাল নাগ, জামাল উদ্দিন বুখারি, আতা মোহাম্মদ, মণি সিংহ, কৃষ্ণবিনোদ রায় ও মনসুর হাবিবউল্ল্যা। সাজ্জাদ জহির কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। পাকিস্তানের পার্টি দুর্বল বিধায় এই পার্টিকে পরিচালনা করার জন্য সিপিআইয়ের পক্ষ থেকে ভবানী সেনকে দায়িত্ব দেয়া হয়। পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি বা পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতি ছিলো কলকাতায় অনুষ্ঠিত সিপিআইয়ের দ্বিতীয় কংগ্রেসে গৃহীত রাজনীতিই। আলাদাভাবে বিশেষ কোনো রণনীতি বা রণকৌশল গ্রহণ করা হয়নি। নবগঠিত পাকিস্তানে শ্লোগান তোলা হয়, ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়, লাখো ইনসান ভুখা হ্যায়, সশস্ত্র সংগ্রাম গড়ে তুলে এই সরকার হঠাও।
১৯৫৬ সালের আগস্ট মাসে কলকাতায় গোপনে পার্টির প্রথম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। কংগ্রেস চলেছিলো মোট তিন দিন। এই কংগ্রেসে ১৩ জনের নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি নির্বাচন করা হয়। কমিটিতে নির্বাচিত হয়েছিলেন নেপাল নাগ, মণি সিংহ, সুখেন্দু দস্তিদার, আমজাদ হোসেন, মোহাম্মদ তোয়াহা, শহীদুল্লাহ কায়সার, অনিল মুখার্জী, মোজাফফর আহমদ, খোকা রায়, হারুণ অর রশিদ, বারীন দত্ত, আলতাব আলী এবং সরদার ফজলুল করিম।
বাংলাদেশের কমিউনিস্টরা ১৯৬৫ সালে মস্কোপন্থী হিসেবে মার্কসবাদী লেনিনবাদী এবং পিকিংপন্থীরা মাওবাদী লাইনে ভাগ হয়ে যায়। তাতে ১৯৬৭ সালে আবদুল হক, মোহাম্মদ তোয়াহা, সুখেন্দু দস্তিদারের নেতৃত্বে পিকিংপন্থীদের পার্টির নাম হয় পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি মার্কসবাদী লেনিনবাদী এবং মনি সিংহ, খোকা রায়, অনিল মুখার্জির পার্টির নাম হয় পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি। এছাড়াও ১৯৬৮ সালে দেবেন শিকদার, আবুল বাশার, আলাউদ্দিন আহমেদ এবং আবদুল মতিনের পার্টির নাম হয় পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি মার্কসবাদী লেনিনবাদী। ভাগাভাগির প্রথমদিকে মস্কোপন্থীরা সংখ্যা বেশি ছিলো। মনি সিংহ, নেপাল বাগ, খোকা রায়, বারীন দত্ত, অনিল মুখার্জী, অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদসহ অনেকেই ছিলেন ওই গ্রুপে। আর পিকিংপন্থীর নেতৃত্ব দেন সুখেন্দু দস্তিদার, আবদুল হক, মোহাম্মদ তোয়াহা, অমল সেন, দেবেন শিকদার, শান্তি সেন, শরদিন্দু দস্তিদার, আবদুল মতিন, আলাউদ্দিন আহমেদসহ অনেকেই। ৭৫ সালের পটপরিবর্তনের পরে আবদুল হকের নেতৃত্বাধীন অংশের নাম হয় পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি মার্কসবাদী লেনিনবাদী এবং মনি সিংহের পার্টির নাম হয় বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি। উল্লেখ্য আবদুল হক, তোয়াহা, সুখেন্দু দস্তিদার, দেবেন সিকদার, সিরাজ সিকদার এবং এসব সংগঠনের নেতাকর্মীদের অনেকেই জনগণের প্রশংসা পেয়েছেন।
১৯৬৬ সালের জুন মাসে কমরেড সুখেন্দু দস্তিদার, মোহাম্মদ তোয়াহা, আবদুল হক, নজরুল ইসলাম, শরদিন্দু দস্তিদার ও দেলোয়ারকে নিয়ে কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক কমিটি গঠিত হয় এবং পার্টির নাম হয় পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি মার্কসবাদী লেনিনবাদী। এই অংশ ক্রুশ্চেভ সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে এবং দলটি পরে পিকিংপন্থী হিসেবে পরিচিতি পায়। এ সময়ে বিশ্ব শ্রমিক শ্রেণী, সাম্রাজ্যবাদ তথা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের আহ্বানের সাথে সাথে সংশোধনবাদী ক্রুশ্চেভ চক্রের বিরুদ্ধে মতাদর্শগত সংগ্রামের মৌলিক গুরুত্বকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে কমরেড আবদুল হক “যত রক্ত তত ডলার” নামক গ্রন্থটি প্রকাশ করেন। কমরেড আবদুল হক গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক সংগ্রাম পরিচালনা করার জন্য আলাউদ্দিন আহমেদ, দেবেন শিকদার, আবুল বাশার, আবদুল মতিনদের “জাতীয় অর্থনীতিতে পুঁজিবাদ প্রধান” বক্তব্যকে খণ্ডন করে কমরেড আবদুল হক রচনা করেন “পূর্ব বাংলা আধা ঔপনিবেশিক আধা সামন্তবাদী” পুস্তিকা। চীনপন্থীদের প্রথম কংগ্রেসের পূর্বেই তাঁদের মধ্যে গ্রুপিং শুরু হয়। প্রথম কংগ্রেসের পূর্বেই দেবেন শিকদার, আবুল বাশার, আলাউদ্দিন আহমদ, আবদুল মতিন, হাবিবুর রহমান প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ এক গোপন বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেন যে, কংগ্রেসে কেন্দ্রীয় কমিটি ও গণসংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব তাঁদের দখল করতে হবে। এই গোপন বৈঠকের খবর ফাঁস হয়ে যায়। কার্যত প্রথম কংগ্রেসের পরেই পার্টিতে অন্তত ছয়টি গ্রুপ গড়ে উঠে। এই সময় আদর্শগত ও রাজনীতিগত প্রশ্নে সমগ্র পার্টিকে প্রস্তুত করার জন্য কমরেড আব্দুল হকের “ক্ষুধা হইতে মুক্তির পথ” ও “ইতিহাসের রায়ই সমাজতন্ত্র” পুস্তক দু’টি প্রকাশিত হয়। এই পুস্তক দু’টি দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনে কর্মীদের শিক্ষিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ও অবদান রাখে। ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত দলের নামের আগে “পূর্ব পাকিস্তান” ব্যবহার করতে থাকে। ১৯৭৮ সালে জানুয়ারী মাসে দীর্ঘ আলোচনার পর পার্টির পাকিস্তান নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশের বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি নাম গ্রহণ করে। ১৯৮৬ সালের কংগ্রেসে দলটি মাওসেতুংকে বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী এবং মাওবাদকে সংশোধনবাদ হিসেবে চিহ্নিত করে আলবেনিয়ার কমিউনিস্ট নেতা এনভার হোজ্জাকে মহান মার্কসবাদী লেনিনবাদী নেতা হিসেবে চিহ্নিত করে। সময় যত গড়াতে থাকে দলটির কার্যক্রমও তত সংকীর্ণ হতে থাকে।
অনেক মতাদর্শিক পার্থক্য সত্ত্বেও ভারত ও বাংলাদেশের সাম্যবাদী আন্দোলনে নকশালবাড়ী কৃষক অভ্যুত্থান অনেক ক্ষেত্রে মডেল হিসেবে কাজ করেছে। ১৯৬৭ সালে চারু মজুমদার নকশালবাড়ী কৃষক আন্দোলন করে গোটা দুনিয়ার সাম্যবাদীদের নজর কাড়তে সক্ষম হন। তিনি ১৯৪২ সালে ভারত ছাড়ো আন্দোলন, ১৯৫১ সালে নির্বাচনে অংশ নেয়া, আবার জেলে যাওয়া সহ বিভিন্ন চড়াই উৎরাই পেরিয়ে ১৯৬৫ সালে চারু মজুমদার ‘সশস্ত্র যুদ্ধই মুক্তির পথ’, ‘সোভিয়েত সংশোধনবাদ বর্জন করো’, ‘শ্রেণী শত্রু খতম করো’, ‘অস্ত্র সংগ্রহ করো’, ‘সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম গড়ে তোলো’ এমন নানা স্লোগান তুলে এক পর্যায়ে নকশালবাড়ী আন্দোলন গড়ে তোলেন। পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং জেলার একটি গ্রাম নকশালবাড়ী। কলকাতা থেকে ২৫০ মাইল ও বাংলাদেশের পঞ্চগড় সীমান্ত থেকে ২৪ কিলোমিটার দূরে নকশালবাড়ী। ওই নকশালবাড়ী আন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়েছিলো বাংলাদেশে।
পরবর্তীকালে ভারত, বাংলাদেশ, নেপালসহ উপমহাদেশের মাওবাদীদের তৎপরতার ক্ষেত্রে জোরালো গতি সৃষ্টি করে নকশালবাড়ী কৃষক আন্দোলন। একুশ শতক শুরুর আগেই সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার পরেও মার্কসবাদের প্রভাব দুনিয়ায় তেমন একটা কমেনি। বরং ১৯৯১ সালেও পেরুতে মার্কসবাদী লেনিনবাদী ও মাওবাদীগণ তাঁদের শক্তি বাড়িয়েছেন। একুশ শতকে ফিলিপাইন এবং নেপালে গণযুদ্ধ চালিয়েছেন মার্কসবাদী এবং মাওবাদীগণ। ফলে মার্কসবাদকে বাস্তবে উপেক্ষা করার মতো সময় এখনও আসেনি। এখনও অন্তত আমাদের চারদিকে মার্কসবাদের প্রবল প্রভাব বিরাজ করে। নেপালে মার্কসবাদ ও মাওবাদ সবচেয়ে প্রবল রাজনীতির ধারা। ভারতের পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতেও মার্কসবাদীদের প্রচণ্ড দাপট। বস্তুত সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙা ছাড়া বিগত দেড়শ বছরে মার্কসবাদ কখনো পেছনে হাঁটেনি।
মার্কসবাদ একাধিক শতক জুড়ে দুনিয়ার মানুষকে প্রভাবিত ও পরিবর্তিত করে চলেছে। আমাদের দেশেও তার প্রভাব গভীরতর। ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, এ অঞ্চলের মার্কসবাদী লেনিনবাদী মাওবাদী দলসমূহ, সমাজবাদী বা সমাজতান্ত্রিক দলসমূহ এবং প্রগতিশীল ও বামপন্থি রাজনৈতিক দলসমূহ কোনো না কোনোভাবে বিভিন্ন মাত্রায় মার্কসবাদী আদর্শকে অনুসরণ করেন। দুনিয়াজোড়াই বিশেষত সাম্রাজ্যবাদ দ্বারা নিপীড়িত দরিদ্র দেশগুলোর রাজনৈতিক দলসমূহের অভ্যন্তরে মার্কসবাদের প্রভাব আজো গাঢ়। ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়া, উত্তর কোরিয়ার মুক্তির লড়াই বা কিউবার মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোতে মার্কসবাদী রাজনীতির প্রবল প্রভাব রয়েছে। ইন্দোচীনের মুক্তি সংগ্রামে মার্কসবাদ ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলেছে।
১৯৭০-এর দশককে মুক্তির দশক ঘোষণা করা হয়। বাংলাদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলন নকশালবাড়ী আন্দোলনের রূপরেখায় প্রণীত হয়। নকশালবাড়ীর লাইন অনুযায়ী পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী লেনিনবাদী) তাঁদের কর্মনীতি ও কর্মকৌশল প্রণয়ন করেন চারু মজুমদারের নীতি অনুসরণ করে। ভারতেও একই নীতিতে লড়াই চলতে থাকে। চারু মজুমদারের অনুসারীগণ অন্ধ্র, বিহার, মহারাষ্ট্র, পশ্চিমবঙ্গ, মধ্যপ্রদেশ, উড়িষ্যা, ঝাড়খণ্ড ও উত্তর প্রদেশে সশস্ত্র গেরিলা লড়াই চালাচ্ছে এখনও। সেই থেকে বাংলাদেশেও এর বেশ প্রভাব এখনও টিকে আছে।
ভারত, নেপাল ও ভুটানে মাওবাদী আন্দোলন চলছে এখনও। ইতোমধ্যে ভারতীয় গোয়েন্দা রিপোর্টে প্রকাশিত হয়েছে ভারতের ১৩টি রাজ্যে মাওবাদীদের সশস্ত্র তৎপরতা ক্রমেই বাড়ছে। নেপাল থেকে অন্ধ্র প্রদেশ পর্যন্ত নিবিড় বিপ্লব অঞ্চল গঠন করতে তারা সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশের কিছু অঞ্চলেও এর তৎপরতা লক্ষণীয়। বিশ্ববিপ্লবের অংশ হিসেবে গোটা দুনিয়ার মার্কসবাদী লেনিনবাদী মাওবাদী লড়াকুগণ এখন ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ভারত ও বাংলাদেশের মাওবাদীগণ এই ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন নন।
এই বিপ্লবী ধারার বিপরীতে ভারতে সংশোধনবাদের চর্চা করে নেহেরু ইন্দিরা কংগ্রেসের পেছনে থেকে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের নীতিকে বাস্তবায়ন করে গেছে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি এবং ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) নামক দুটি সমাজ গণতন্ত্রী ক্ষুদে মালিকদের রাজনৈতিক দল। এই রাজনৈতিক দল দুটি ভারতের আমলা মুৎসুদ্দি বুর্জোয়া শ্রেণি এবং সামন্তবাদের সেবা করে চলেছে গত পাঁচ দশক। ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, আধিপত্যবাদ এবং সামন্তবাদের সেবা করে ২০১০ সালে মারা যায় সিপিআই (এম) এর সবচেয়ে পরিচিত কংগ্রেসের পদলেহনকারী জ্যোতি বসু।
১৯৭৬ সালে কমরেড ননী গোপাল দত্ত, বিমল বিশ্বাস, নগেন সরকার প্রমুখগণ গঠন করেন বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী)। এই দলটি দীর্ঘদিন গোপনে কাজ করেছে। দলটি পর্যাস নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করে এবং দলটি বিপ্লবী আন্তর্জাতিক আন্দোলন এবং কম্পোসার সাথে সম্পৃক্ত। ১৯৭৬ সনে পার্টির প্লেনাম অনুষ্ঠিত হয়। এতে পার্টিকে গোপন রেখে একটি অংশকে প্রকাশ্য কাজের সুযোগ গ্রহণের জন্য চালিত করা হয়। সেই প্রেক্ষিতে ননী গোপাল দত্ত, তাঁর অন্য দুটি ছদ্মনাম হচ্ছে অজয় দত্ত ও মোস্তাক, কিছুকাল পার্টির সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮২ সনে দলের চতুর্থ কংগ্রেসে দত্ত ও তার অনুসারীরা যোগদানে বিরত থাকলে দলে ভাঙন দেখা দেয়। নগেন সরকার ও ননী গোপাল দত্তের মৃত্যুর পরে দল প্রায় নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। ১৯৮২ সালের ভাঙনে দিলিপ বড়ুয়ার নেতৃত্বে নতুন আরেকটি দল বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল গড়ে ওঠে। ১৯৯৫ সালে বড়ুয়ার সাম্যবাদী দলের ষষ্ঠ জাতীয় কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয় এবং দিলীপ বড়ুয়া দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। পুরোনো সাম্যবাদী পিকিংপন্থী দলের অনেক নেতাই ততদিনে পরলোক গমন করেন; তাঁদের মধ্যে নগেন সরকার, সুখেন্দু দস্তিদার, দেবেন শিকদার, মোহাম্মদ তোয়াহা, আলী আব্বাস, আবদুল হক প্রমুখ। ফলে দলটি তার লক্ষ্য আধা পুঁজিবাদী আধা সামন্তবাদী সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা নির্মাণের রাজনীতি আপাতত স্থগিত রাখে এবং দলের নেতা দিলীপ বড়ুয়া শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বুর্জোয়া দল আওয়ামী লীগ সরকারের শিল্পমন্ত্রী হিসেবে ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ব্যক্তিমালিকানাধীন শিল্পকারখানা বিকাশের দায়িত্ব পালন করে। দিলিপ বড়ুয়া আওয়ামি মন্ত্রীসভায় যোগদানের পর থেকে এই দলের কার্যক্রম শেষ হয়ে যায়। এছাড়া বাংলাদেশে নিষ্ক্রিয় হয়েছে শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল। সেটি ছিলো বাংলাদেশের একটি ক্ষুদ্র মার্কসবাদী লেনিনবাদী রাজনৈতিক দল। এটি ভারতের বিপ্লবী সমাজবাদী পার্টির সহানুভূতিতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৬৯ সালে গঠিত হয়। এই দলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন নির্মল সেন। পার্টি প্রকাশ করতো সমাজবাদী (The Socialist) পত্রিকা। এটি আরএসপি’র সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে চলতো। এই দল বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের এবং ১১ দলের সদস্য ছিল। এই দলের ছাত্র সংগঠন ছিল সমাজবাদী ছাত্র জোট এবং কৃষি শ্রমিক সংগঠন ছিল খেতমজুর সভা। ২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচনে এই দলের একমাত্র প্রার্থী ছিলেন নির্মল সেন।
বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি গঠিত হয় ১৯৮০ সালে। গঠনের সময় নেতা হিসেবে উল্লেখযোগ্য ছিলেন হায়দার আকবর খান রনো, রাশেদ খান মেনন, কমল এবং নজরুল ইসলাম। বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগ এবং অন্য একটি গ্রুপ থেকে সদস্য নিয়ে দলটি গঠিত হয়। অমল সেন ছিলেন এটির প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব। ১৯৮৪ সালে দলটি দুটি ভাগে বিভক্ত হয় এবং দুই পক্ষই একই নাম ব্যবহার করতে থাকে। তখন একটি গ্রুপের নেতৃত্ব দেন অমল সেন এবং অন্য গ্রুপের নজরুল ইসলাম। দলটি বাংলাদেশে ক্রিয়াশীল এবং সংশোধনবাদের চর্চা করে চলেছে। বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি হচ্ছে অন্য আরেকটি বাংলাদেশের একটি রাজনৈতিক দল। এই দলটি বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি থেকে বিভক্ত হয়ে গড়ে ওঠে এবং তখন থেকে এই পার্টিও ‘বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি’ নামটি ব্যবহার করত। দলের সভাপতি ছিলেন খন্দকার আলী আব্বাস এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন সাইফুল হক। ১৪ জুন, ২০০৪ সালে এই গ্রুপটি ‘বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি’ থেকে বেরিয়ে আসে। এরা আওয়ামী লীগের সাথে ঐক্যবদ্ধ যৌথ কর্মসূচির কৌশলের বিরোধিতা করে। এই দলের গণসংগঠনসমূহ হচ্ছে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক ইউনিয়ন, বিপ্লবী কৃষক সংহতি এবং শ্রমজীবী নারী মৈত্রী। দলটি প্রকাশ করে জনগণতন্ত্র নামে একটি পত্রিকা।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী লেনিনবাদী) হচ্ছে বদরুদ্দীন উমর পরিচালিত বাংলাদেশের একটি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী পার্টি। এটি একসময় গণতান্ত্রিক বিপ্লবী জোট নামে একটি জোট গঠন করে এবং বর্তমানে জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল নামে একটি জোট পরিচালনা করে। ১৯৭৬ সালের ১৪ ও ১৫ আগস্ট পূর্ব বাংলার গণবিপ্লবী পার্টি, কমিউনিস্ট কর্মী সংঘ এবং বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী লেনিনবাদী) এক ঐক্য কংগ্রেসে মিলিত হয় এবং নতুন নাম ধারণ করে। সেই কংগ্রেস একটি কেন্দ্রীয় কমিটি নির্বাচন করে এবং গ্রহণ করে একটি রাজনৈতিক প্রতিবেদন। এই কংগ্রেসে নতুন পার্টির নেতা হিসেবে সামনে আসেন বদরুদ্দীন উমর, সিরাজুল হোসেন খান, আবুল বাশার ও ডা. সাইফ-উদ-দাহার প্রমুখ।
২০১৩ সালের এপ্রিল মাসে বাংলাদেশে বাংলাদেশের ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠিত হয়। গঠনের সময় এটি ২০১৩ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট লীগ এবং বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি পুনর্গঠনের সাথে সংযোগ ঘটায়। মোশাররফ হোসেন নাননু হচ্ছেন দলের সাধারণ সম্পাদক; এছাড়াও আব্দুস সাত্তার, আজিজুর রহমান, রণজিৎ চট্টোপাধ্যায় ও আফসার আলী দলের সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য নির্বাচিত হন। উদ্বোধনী সম্মেলনে ১৯ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি নির্বাচন করা হয়। এই দলটি বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের সাথে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে।
তথ্যসূত্র:
১. জয়নাল আবেদীন, উপমহাদেশের জাতীয়তাবাদী ও বামধারার রাজনীতি প্রেক্ষিত বাংলাদেশ; বাংলাপ্রকাশ, ঢাকা; ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, পৃষ্ঠা ৩৯৭, ১৯৮-২০৪, ৩৯০ ও ৪০৮
২. বাংলা উইকিপিডিয়ার বিভিন্ন পাতার তথ্য।
৩. প্রবন্ধটি আমার [অনুপ সাদি] লিখিত ভাষাপ্রকাশ থেকে ২০১৬ সালে প্রকাশিত মার্কসবাদ গ্রন্থের ১৪৪-১৫২ পৃষ্ঠা থেকে নেয়া হয়েছে এবং এখানে পুনরায় প্রকাশ করা হলো।
রচনাকাল ১২ ডিসেম্বর ২০১৫
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।