বাংলাদেশে রেলওয়ে উনিশ ও বিশ শতকে বিকশিত হয় এবং বাংলাদেশ রেলওয়ে গড়ে ওঠে স্বাধীনতার পরে। ব্রিটিশরা বাষ্পচালিত লোকোমোটিভের বিকাশ করলে অষ্টাদশ ও উনিশ শতকে রেল পরিবহণ শিল্পবিপ্লবের প্রধান উপাদান হয়ে দাঁড়ায়। রেল জাহাজী পরিবহণের খরচকে কমিয়ে দেয় কারণ জাহাজডুবার ফলে মাঝেমাঝেই পণ্য-জাহাজ ডুবে মালিকের ক্ষতি হতো। খালপথ থেকে রেলপথ বৃদ্ধির ফলে একটি জাতীয় বাজার গড়ে ওঠে যেখানে একই রাষ্ট্রের এক শহর থেকে অন্য শহরে পণ্যের দাম প্রায়ই একই রকম রাখা যায়। সেই রেল দুই শতকের নানা পথ পরিক্রমায় এক বহুমুখী যোগাযোগ ব্যবস্থা হিসেবে গোটা দুনিয়ায় গ্রহণযোগ্য হয়েছে। স্ট্যান্ডার্ড গেজ, ব্রডগেজ, মিটারগেজ, ন্যারোগেজ ইত্যাদি পথের সাথে এসেছে নানারকমের ট্রাম, মনোরেল, ম্যাগলেভ ইত্যাদি। বাষ্পীয় ইঞ্জিনের আবিষ্কারের পরে নানা রকমের ট্রেনের ভিতরে এসেছে বাষ্পীয় ট্রেন, ডিজেল ট্রেন, ডিজেল-বৈদ্যুতিক ট্রেন, বৈদ্যুতিক ট্রেন, যাত্রীবাহী ট্রেন, কার্গো বা কন্টেইনার বা ওয়াগন বহনকারী ফ্রেইট ট্রেন। এসব ট্রেন সাথে করে এনেছে ট্র্যাক বা রেলপথ, স্টেশন, সিগন্যাল, বৈদ্যুতায়ন, মালিকানা ও কোম্পানির পুঁজি ব্যবসাকে কেন্দ্র করে কোটি মানুষের কর্মযজ্ঞ। যদিও রেলের নানান রূপ ও ব্যবহারে বৈচিত্র্য বাড়লেও জনশোষণ কমেনি। এই রেল সম্পর্কে ৬ জুলাই, ১৯২০ সালে ভি. আই. লেনিন লেখেন,
“রেলপথ নির্মাণকে সরল, স্বাভাবিক, গণতান্ত্রিক, সাংস্কৃতিক ও সভ্যতাসাধক উদ্যোগ মনে হয়। পুঁজিবাদী গোলামিকে চটকদার রঙে আঁকার জন্য দক্ষিণা পাওয়া বুর্জোয়া অধ্যাপকদের কাছে এবং ক্ষুদে-বুর্জোয়া কূপমণ্ডূকদের চোখে এটা তাই-ই। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যে সব পুঁজিবাদী সূত্র সহস্রপাকে এইসব উদ্যোগকে সাধারণভাবে উৎপাদনের উপায়ের ওপর ব্যক্তিগত মালিকানার সংগে বেঁধে রেখেছে_ তা এই রেলপথ সাধারণত নির্মাণকে পরিণত করেছে শত কোটি মানুষকে (উপনিবেশে ও আধা উপনিবেশে) অর্থাৎ পৃথিবীর জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি যারা পরাধীন দেশে বাস করে, এবং যারা ‘সভ্য’ দেশের পুঁজির মজুরি-গোলাম—তাদের উৎপীড়িত করার যন্ত্রে।”[১]
অর্থাৎ রেলপথ পুরো ঊনবিংশ শতাব্দীতে পুঁজিবাদকে মোটাতাজা করেছে। ভারতে রেল এনেছিল ব্রিটিশরা লুট-বাণিজ্যের স্বার্থে। ১৮৫৩ সালে কার্ল মার্কসের চোখে ধরা পড়েছিলো যে ব্রিটিশ কারখান মালিকেরা ‘ভারতের ওপর রেলওয়ের এক জাল বিস্তার’ করবে; ‘এবং সে কাজ তারা করবেই। তার ফল অপরিমেয় হতে বাধ্য’। কার্ল মার্কস ভারতের রেলওয়েকে যথাযথভাবে কীভাবে ব্যবহার করা যায়, সেই সম্পর্কেও তিনি চিন্তা করেছিলেন। তিনি লিকেছিলেন,
“যেখানে রেলপথ বাঁধার প্রয়োজনে মাটি দরকার সেখানে পুকুর খুঁড়ে এবং বিভিন্ন লাইন বরাবর জল সরবরাহ করে রেলওয়র প্রবর্তনকে সহজেই কৃষি উদ্দেশ্যের সহায়ক করে তোলা সম্ভব। এইভাবে প্রাচ্যের চাষ ব্যবস্থার যা অপরিহার্য শর্ত সেই সেচ ব্যবস্থা প্রভূত পরিমাণে বিস্তৃত করা যেতে পারে এবং জলাভাবে বারবার দেখা দেওয়া স্থানীয় দুর্ভিক্ষগুলিকে রোধ করা সম্ভব। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে রেলওয়ের সাধারণ গুরুত্ব স্পষ্ট হবে যদি মনে রাখি এমন কি … … সেচহীন জমিগুলি তুলনায় সেচ দেওয়া জমিগুলির কর তিন গুণ, কর্মসংস্থান দশ বারো গুণ এবং মুনাফা বারো থেকে পনেরো গুণ বেশি।”[২]
অর্থাৎ আর মার্কস তখন ভারতের ও প্রাচ্যের সব দেশগুলোর সেচব্যবস্থাকে রেলওয়ের সাথে সমন্বয় করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশ বাস্তবে মার্কসের উল্টা পথে গেছে, মার্কস সেচ ও কৃষি বিষয়ে যা বলেছিলেন, তা একেবারেই বাস্তবায়িত হয়নি। এখানে সাম্রাজ্যবাদনির্ভর শ্যালো নলকূপ এবং গভীর নলকূপ দিয়ে ছেয়ে ফেলা হয়েছে। মার্কস আরো লিখেছিলেন এই রেলই একদিন ব্রিটিশ তাড়াবে। রেল না হলে মোহনদাস গান্ধির পক্ষে অসম্ভব ছিলো সত্যাগ্রহের উদ্ভাবন।
১৯৭২ সালে বাংলাদেশে রেল জাতীয়করণ হলে এর লুট-বাণিজ্য প্রক্রিয়া কিছুটা খর্ব হয়। বাংলাদেশ রেলওয়েতে অজস্র মানুষ যাতায়াত করতো, দ্রব্য ও পণ্য পরিবহণ করতো। রেলের বর্তমান ভূমিকা ব্যক্তিগত গাড়ি, বাস, ট্রাক ও অন্যান্য ছোট যানবাহনের চেয়ে কম দূষণমূলক। রেল পুঁজিবাদের উত্থানের যুগের সাথে মিলিয়ে মৈত্রীসুলভও বটে। রেলগাড়িতে একজনের সাথে অন্যজনের সাক্ষাত হতো, তারা পরস্পরের সাথে কথা-ভাব-চিন্তা বিনিময় করতো। অথচ এহেন রেলপথকে বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়াশীল শাসকগোষ্ঠী সাম্রাজ্যবাদের সহযোগিতায় ১৯৭১-এর পর থেকে ধীরে ধীরে ধ্বংস করে দেয়। রেলপথের সস্তায় পরিবহণ ও যোগাযোগের পরিবর্তে নিপীড়িত বাংলাদেশে গড়ে তোলা হয় সড়ক ও আকাশ যোগাযোগ। সড়কপথে ও আকাশপথে ছুটতে থাকে কর্পোরেট পুঁজির দৌরাত্ম্য। ব্যক্তিগত গাড়ি, বাস, ট্রাক ও অন্যান্য ছোট যানবাহন বিক্রির নামে সাম্রাজ্যবাদী লগ্নি পুঁজি, কর্পোরেট পুঁজির চলে অবাধ লুণ্ঠন। সাম্রাজ্যবাদ দ্বারা নিপীড়িত দেশসমূহে উচ্চবিত্তদের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম করা হয় ব্যক্তিগত গাড়িকে। পরে এই ব্যক্তিগত গাড়িকে মধ্যবিত্তের ক্রয়ের নাগালে আনা হয়। চলতে থাকে নিপীড়িত ও অনুন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলোতে ছোট ছোট পরিবহণ ব্যবসার মচ্ছব। এইসব ব্যবসার সাথে চলে সড়ক তৈরির ব্যবসা, বর্ষাপ্রধান বাংলায় প্রতি বছর সড়ক নষ্ট হয় আর ফিবছর চলে সেই সড়কের নির্মাণ, পুনর্নির্মাণ। সড়ক ও জনপথ, সেতু বিভাগ এবং পরিবহণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে চলে জাতীয় বাজেটের টাকার দুর্ধর্ষ লুটপাট। ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ ও মেরামতে চলে টেন্ডারবাজি, ডাকাতি। এসবের সাথে যুক্ত হয় সড়কের ঘাটে, ফুটপাতে, মোড়ে, কিনারে পুলিশ মাস্তান চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য। আর এসবের পৃষ্ঠপোষকতা করেছে গত চার দশকের বাংলাদেশের নির্বাচিত-অনির্বাচিত গণশত্রু প্রতিক্রিয়াশীল শাসকগোষ্ঠী।
সড়কপথের এইসব সমস্যার বিপরীতে ছিল রেলসড়কের ঘনঘন নষ্ট না হবার বা ঘনঘন মেরামত না করার এক দারুণ সুবিধাজনক দিক। একটি রেলরোড ১০-১৫ বছর পরপর কিছুটা মেরামতের প্রয়োজন পড়ে। রেলের ছিলো একটি কেন্দ্রীভূত যৌথ যোগাযোগ প্রক্রিয়া। আর যত্রতত্র রেলকে দাঁড় করিয়ে চাঁদাবাজির বিষয়ও ছিলো নগণ্য। রেলে জনমানুষের যাতায়াত ছিল আরামদায়ক এবং সেইসাথে দারুণ সাশ্রয়ী। যেমন, ১৮৮২ সালের ১লা মে ডিব্রু-ছৈখোয়া রেল পথের কাজ শুরু হয়। বছর দশেক পরে আসাম বাংলা রেলওয়ে (ABR) কোম্পানি গড়ে উঠে। আরো এক দশক পরে, ১৯০৩ সালের ১লা মার্চে, এই কোম্পানি চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে ডিব্রুগড় তথা আসামকে জুড়ে দিল। অসমের শতাব্দি প্রাচীন প্রথম রেলপথই এটি। বদরপুর থেকে সিলেট, আখাউড়া হয়ে চলে গেছিল চাটগাঁ পর্যন্ত। সেকালে খুব অল্প দামে টিকিট কেটে তিনসুকিয়া থেকে চেপে বসলে চট্টগ্রাম গিয়ে পৌঁছানো যেতো বলে, লোকে আদর করে এর নাম দিয়েছিল, ‘আমার বাবার রেল’। এ বি আর নামেও সরকারিভাবে জনপ্রিয় ছিল এই রেল।[৩] আর একুশ শতকের গোড়ার বছরে বাংলাদেশে লোকাল রেলগুলোতে ৫০-১০০ কিমি যাওয়া যেত কুড়ি টাকা ব্যয় করেই। সেই সাশ্রয়ী রেল এখন বেঁচে আছে শুধুই স্মৃতিতে।
বাংলাদেশে রেলপথের সাথে আরও ছিলো জলপথ। এই জলপথের ছিল তিনটি রূপ; খালপথ, নদীপথ ও সমুদ্রপথ। রেলপথের মতো জলপথেও দ্রব্য-পণ্য পরিবহণ করা যেত অতি সস্তায়। বাংলার যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম হতে পারত এই জলপথ। গত চার দশকে যে টাকা ব্যয় করে সড়ক তৈরি করা হয়েছে তার অর্ধেক খরচে গোটা দেশকে রেলপথ দিয়ে ছেয়ে ফেলা যেতো এবং প্রায় বিনা খরচে পরিবহণ ও জনযাতায়াতের ব্যবস্থা করা যেত জল ও রেলপথের সমন্বয় করে। কিন্তু সেটি না করে এদেশে এসেছে হানিফ, এস. আলম, সৌদিয়াসহ নানা রঙের পরিবহণ। যে হানিফ এন্টারপ্রাইজের মালিক ছিলো একদা একটি ট্রাকের মালিক সে হয়ে যায় ১২০০ বাসের অধিপতি।[৪] আর সেই বাস-ট্রাক-ট্রলি রপ্তানি করতে থাকে টয়োটা-টাটা ইত্যাদি নামধারী কর্পোরেট কোম্পানিগুলো। আমাদের ডাকাত শাসকগোষ্ঠী কর্পোরেটের উৎকোচে গত চার দশকে সুকৌশলে সচেতনভাবে জল ও রেলপথকে ধ্বংস করেছে। গত চার দশকের সকল শাসকেরাই যে স্বৈরতন্ত্রী গণবিরোধী দস্যু তার প্রমাণ তারা রেখে গেছে জল ও রেলপথকে ধ্বংস করে।[৫]
তথ্যসূত্র:
১. ভি. আই. লেনিন, সাম্রাজ্যবাদ পুঁজিবাদের শেষ পর্যায়-এর ভূমিকা; রচনা সংকলন, দ্বিতীয় ভাগ; প্রগতি প্রকাশন, মস্কো; তারিখহীন; পৃষ্ঠা-১৩।
২ কার্ল মার্কস, ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ভবিষ্যৎ ফলাফল, ২২ জুলাই, ১৮৫৩, ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ফলাফল প্রগতি প্রকাশন, মস্কো।
৩. সুশান্ত কর, আগস্ট, ২০১৪, “বদরপুর লামডিং রেল পথে” ফেসবুক ডট কম, ইউআরএল: https://web.facebook.com/sushanta.kar.9/media_set?set=a.10201402501423283.1073741862.1796943501&type=1&_rdc=1&_rdr
৪ কারেন্টনিউজ ডটকম ডটবিডি, “বাংলাদেশে কে এই লোক যে মাত্র ১টি ট্রাক থেকে ১২০০ হানিফ বাসের মালিক!”, ডিসেম্বর ১২, ২০১৭, সম্পাদক: রবীন সিদ্দিকী, http://www.currentnews.com.bd/bn/news/320139
৫. প্রবন্ধটি আমার [অনুপ সাদি] সম্পাদিত ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ, ঢাকা থেকে ২০১০ সালে প্রকাশিত বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা গ্রন্থে প্রথম প্রকাশিত হয়। রোদ্দুরে ডট কমে প্রকাশের সময় পরিবর্ধন করা হয়েছে। রচনাকাল জুন-জুলাই, ২০১০ এবং পরবর্তীতে লেখার সময় অনেক তথ্য সংযোজন করা হয়েছে।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।