ইলিশ বাংলাদেশের জনপ্রিয় ও জাতীয় মাছ

মাছ

ইলিশ

বৈজ্ঞানিক নাম: Tenualosa ilisha (Hamilton, 1822) সমনাম: Claupanodon ilisha Hamilton, 1822 Fishes of the Ganges, p. 243; Claspea ilisha Day, 1878, Fishes of India, p. 640; Hilsa ilisha Regan, 1917, Anon. Mag. Nat. Hist. 19:306; Macrura ilisha Fowler, 1941, Bull. U.S. Nat. Maas. 100: 633; Tenualosa ilisha Munro, 1955, Marine and Fres/rwater Fishes of Ceylon, p. 25. ইংরেজি নাম: River Shad, Hilsa Shad. স্থানীয় নাম: ইলিশ, ইলশা (সমগ্র বাংলাদেশ)
জীববৈজ্ঞানিক শ্রেণিবিন্যাস
জগৎ: Animalia পর্ব: Chordata শ্রেণী: Actinopterygii বর্গ: Clupeiformes পরিবার: Clupeidae উপ পরিবার: Alosinae গণ: Tenualosa প্রজাতি: Tenualosa ilisha

বর্ণনা: দেহ দৃঢ়ভাবে চাপা। পৃষ্ঠ এবং অংকীয় দেশ সমান উওল। উর্ধ্বচোয়াল মাঝখানে স্পৃষ্ট খাঁজযুক্ত, মুখ দৃঢ়ভাবে এ বন্ধ থাকা অবস্থায় নিম্নচোয়াল ভিতরে ঢুকে যায়। ম্যাক্সিলা চোখের মধ্য পশ্চাতের নিচ পর্যন্ত প্রসারিত। অনাবৃত অংশ ত্বকে ঢাকা এবং কোনো অনুদৈর্ঘ্য কিনারা নেই। মাথার পৃষ্ঠতল ত্বকে আবৃত, কোনো পশ্চাৎ কপাল অস্থির রেখা (frontoparietal striae) নেই। ফুলকা দন্তিকা সোজা বা কিছুটা বাঁকা, সূক্ষ এবং বহু সংখ্যক, প্রথম খিলানের নিচের অংশে প্রায় ১৫০ থেকে ২০০টি। দাঁত থাকে না।

মাথার দৈর্ঘ্য এবং দেহের উচ্চতার মোট দৈর্ঘ্যের এক চতুর্থাংশ। চোখের ব্যাস বয়সের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়। কম বয়সী মাছের চোখ অপেক্ষাকৃত বড়। বক্ষপাখনা, শ্রোণীপাখনা অপেক্ষা অনেকটা ক্ষুদ্রতর। পার্শ্বরেখা অঙ্গের মধ্য সারিতে ৪৫ থেকে ৪৭টি আঁইশ থাকে, অনুপ্রস্থ সারিতে ১৭ থেকে ১৯ সারি আঁইশ বিদ্যমান। আঁইশের অনাবৃত অংশে অসংখ্য অনুদৈর্ঘ্য রেখা বিদ্যমান ও আঁইশের কিনারাগুলি পেক্টিনযুক্ত। পুচ্ছপাখনা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আঁইশযুক্ত। বক্ষপাখনা এবং শ্রোণীপাখনায় কাক্ষিক (axillary) আঁইশ থাকে। মোট স্কুট সংখ্যা ৩০ থেকে ৩২টি; প্রাক শ্রেণীতে ১৭ থেকে ১৮ টি; পশ্চাৎ শ্রেণীতে ১২ থেকে ১৪ টি। হেমাল কাটা (haemal spine) ছাড়া মোট কশেরুকার সংখ্যা ১০ থেকে ১৪ টি কিন্তু নিউরাল স্নায়ু কাটা সহ ১৯ থেকে ২২ টি। পৃষ্ঠীয় পাখনা, পুচ্ছপাখনার গোড়া অপেক্ষা তুন্ড শীর্ষের অধিক নিকটবর্তী। শ্রোণীপাখনা পুচ্ছপাখনার প্রথম থেকে চতুর্থ শাখান্বিত দন্ডের নিচ থেকে উৎপন্ন হয়। পুচ্ছপাখনা দৈর্ঘ্যে মাথার সমান বা কিছুটা ছোট, লোব প্রায় সমান বা নিচেরটা কিছুটা বড়।

আরো পড়ুন:  রুই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও আফ্রিকার জনপ্রিয় মাছ

এদের দেহ মূলত রূপালী বর্ণের এবং দেহ হতে সোনালি বা লাল বর্ণের প্রতিফলন দেয়; পরিণত মাছে কোনো দাগ থাকে না কিন্তু অপরিণত মাছে দেহের উপরের তৃতীয়াংশ বরাবর এক সারি দাগ বিদ্যমান (Pillay and Rosa, 1963)। ৩১ থেকে ৫৩ সেমি দৈর্ঘ্যের ১০৬ টি ইলিশের গড় ডিমের সংখ্যা ২,৫৪,৫৬০ থেকে ১৫,৭৭,৬০০ টি (Rahman, 1989)। পরিণত ডিমের ব্যাস ০.৭ থেকে ০.৯ মিমি পর্যন্ত হয়। ইলিশ মাছ স্থির পানির তলদেশে ডিম পাড়ে এবং সেখানেই নিষেক ঘটে। এই মাছের ডিমের ঘনত্ব পানির ঘনত্বের খুব কাছাকাছি থাকে যাতে তারা সহজেই অল্প স্রোতে ভেসে বেড়াতে পারে। (Kulkarni, 1950)। চাঁদপুরে এই মাছের সর্বোচ্চ মোট দৈর্ঘ্য ৫৩ সেমি পর্যন্ত পাওয়া গিয়েছিল (Rahman, 1989)। রিভার স্যাড (River Shad) একটি নদী গামী ক্লুপিড় মাছ।

এরা প্রজননের জন্য মিঠা পানির নদীতে মোহনা থেকে নদীর উজানে অভিপ্রায়ন পদ্ধতি অনুসরণ করে। প্রধানত দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু প্রবাহের সময় এরা প্রজনন ঘটায়। জানুয়ারী থেকে ফেব্রুয়ারী এই অল্প সময়ের মধ্যে তারা প্রজনন ঘটায়। এই মাছের মুক্ত ভাসমান ডিম থেকে ফোটা পোনা এবং অপ্রাপ্ত বয়স্ক মাছ নদী বা স্রোত যুক্ত জলাধারে বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয় এবং খাদ্য গ্রহণ, বৃদ্ধি বা পরিপক্কতার জন্য সমুদ্রের দিকে যেতে থাকে। পরবর্তীতে এরা প্রজননের জন্য আবার মিঠাপানিতে ফিরে আসে।

বাংলাদেশে মেঘনা নদীতে এবং মোহনায় কয়েকটি স্থান ডিম ছাড়ার ক্ষেত্র হিসেবে সনাক্ত করা হয়েছে। ইলিশ মাছ বিভিন্ন সময়ে নিবিড় মৎস্য আহোরণ পদ্ধতিতে ধরা হয়, যেমন পরিণত মাছ মে থেকে অক্টোবর মাসে যখন অভিপ্রায়ন করে তখন, আবার ফেব্রুয়ারী থেকে মে মাসের দিকে মােহনায় ও কিছু পরিমাণ জাটকা ধরা পড়ে। এছাড়া মেঘনা নদীর নিচের অংশ ও পদ্মার উপরিভাগেও এরা ধরা পড়ে।

স্বভাব ও আবাসস্থান: এরা প্রধানত সামুদ্রিক, পানির উপরিভাগ দিয়ে চলে এবং উপকূলে ঝাঁকে ঝাঁকে দেখা যায়। ইলিশ মাছ অধিক লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে, নদীগামী এবং নদীর উপরিভাগের দিকে সঁতরায় যেখানে কোন জোয়ার ভাটার প্রভাব নেই। এরা মিঠাপানিতে ডিম পাড়ে। ইলিশ মাছের ডিম ফুটে বাচ্চা বের হলে তাদের লার্ভা এবং তরুণ মাছগুলি বৃদ্ধি এবং পরিপক্কতার জন্য কয়েক মাসের জন্য সমুদ্রে অভিপ্রায়ন করে। এদেরকে উপকূলীয় অঞ্চল, মোহনা (কম লবণাক্ত পানি) এবং মিঠাপানির নদীতে যেখানে জোয়ার ভাটার প্রভাব একেবারেই নেই সেখানে পাওয়া যায়।

আরো পড়ুন:  থাই পাঙ্গাশ বাংলাদেশে আগ্রাসি প্রজাতির মাছ

বিস্তৃতি: উপসাগর থেকে আরব সাগরের মধ্য দিয়ে ভারত মহাসাগরের উত্তর অংশ, বঙ্গোপসাগর থেকে মায়ানমার পর্যন্ত এবং সংলগ্ন দেশের প্রধান নদী সমূহে এই মাছ পাওয়া যায়। বাংলাদেশে পদ্মা ও মেঘনা নদীর নিচের অংশে, রূপসা, শিবসা, বিশখালী, তেতুলিয়া, আড়িয়ালখা, গলাচিপা ও পায়রা নদী এবং উপকূলীয় কিছু নদীতে প্রচুর ইলিশ মাছ পাওয়া যায়।

অর্থনৈতিক গুরুত্ব: বাংলাদেশে ইলিশ মাছ অর্থনৈতিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রজাতির উপর ভিত্তি করে আলাদা মৎস্য শিল্প গড়ে উঠেছে। এই মাছের অবদান মোট আহোরিত সামুদ্রিক মাছের প্রায় শতকরা ৪১ ভাগ এবং দেশের মোট উৎপাদিত মাছের ১২ ভাগেরও বেশি। ইলিশের বর্তমান উৎপাদন ২,০০,০০০ মেট্রিক টন। আহোরিত মাছের একটা বড় অংশ স্থানীয় বাজারে বিক্রি হয় এবং কিছু পরিমাণ ইলিশ ভারত ও অন্যান্য দেশে রপ্তানী হয়। প্রায় ৪,৫০,০০০ জেলে ইলিশ মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে। ইলিশ মাছ বাংলাদেশের জাতীয় মাছ হিসেবে পরিচিত।

বাস্তুতান্ত্রিক ভূমিকা: ইলিশ মাছের বিস্তৃতি ব্যাপক। এরা সমুদ্র, মোহনা এবং নদী বা মিঠা পানির পরিবেশে বাস করে। এই মাছ ময়লা বা তলানী খেয়ে পানি দূষণ নিয়ন্ত্রণ করে।

বর্তমান অবস্থা এবং সংরক্ষণ: সহজেই পাওয়া যায়। IUCN Bangladesh (2000) এর লাল তালিকায় আশংকাজনক মাছ হিসেবে চিহ্নিত নয়। নদীতে পলিজমাট, নদীর উপরিভাগ শুকিয়ে যাওয়া, নদীতে আড়াআড়ি বাঁধ নির্মাণ, ক্রমবর্ধমান মৎস্য আহোরণ এবং ব্যাপক হারে ঝাটকা নিধনই ইলিশ মাছের সংখ্যা বৃদ্ধির সম্ভাব্য অন্তরায় সমূহ। গঙ্গা নদীতে ফারাক্কা বাঁধ নির্মান ইলিশের সংখ্যা কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ। স্রোতের বিপরীতে উপরের দিকে ইলিশের অভিপ্রায়ণ নিশ্চিত করার জন্য পদ্মা ও মেঘনার উপরের অংশ পুনখনন প্রয়োজন। ইলিশ সম্পদ টিকিয়ে রাখতে জাটকা এবং ডিমওয়ালা ইলিশ রক্ষার্থে প্রণীত মৎস্য আইন সঠিকভাবে প্রয়োগ করা অতি জরুরী।

মন্তব্য: ইলিশ খুব দ্রুত সাঁতরাতে পারে। মাছের টেগিং (tagging) পরীক্ষায় দেখা গেছে একটি ইলিশ মাছ। একদিনে প্রায় ৭০.৮ কিমি পর্যন্ত সাঁতরাতে পারে (Pillay et al., 1963)। এরা নদীতে স্রোতের বিপরীতে প্রায় ১২০০ কিমি পর্যন্ত সঁতরাতে পারে তবে সাধারণত ৫০ থেকে ১০০ কিমি পর্যন্ত সাঁতরাতে দেখা যায়। বাংলাদেশে এ সরিষা ইলিশকে (সরিষা ও অন্যান্য মসলা দিয়ে জানা ইলিশ) সুস্বাদু খাবার হিসেবে বিবেচনা করে।

আরো পড়ুন:  থাই সরপুটি এশিয়ার দেশসমূহের বাণিজ্যিক মাছ

তথ্যসূত্র:

১. আতাউর রহমান, এ কে (অক্টোবর ২০০৯)। “স্বাদুপানির মাছ”। আহমেদ, জিয়া উদ্দিন; আবু তৈয়ব, আবু আহমদ; হুমায়ুন কবির, সৈয়দ মোহাম্মদ; আহমাদ, মোনাওয়ার। বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ। ২৩ (১ সংস্করণ)। ঢাকা: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। পৃষ্ঠা ২৩–২৪।

বি. দ্র: ব্যবহৃত ছবি উইকিপিডিয়া কমন্স থেকে নেওয়া হয়েছে। আলোকচিত্রীর নাম: BEDO (Thailand)

Leave a Comment

error: Content is protected !!