বাংলাদেশে বনরুই খুবই কমে গেছে, নতুন গবেষণার ফলাফল

বাংলাদেশে বনরুই সংক্রান্ত গবেষণা খুব কম হয়েছে, যদিও এই স্তন্যপায়ী প্রাণীটির সুরক্ষা সারা পৃথিবীতেই ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। আবার বিশ্বের বিশ্বের সবচেয়ে পাচারকারী স্তন্যপায়ী প্রাণী বনরুই, ফলে দ্রুত পৃথিবী থেকে এরা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। তবুও, আমরা এই নিঃসঙ্গ প্রাণীদের সম্পর্কে খুব সামান্যই জানি। এমনকি বনরুইদের সংখ্যা সম্পর্কেও মৌলিক তথ্যের গুরুতরভাবে অভাব রয়েছে। বৈজ্ঞানিকরা বলছেন, এই প্রাণীদের সংখ্যা না জানার কারণে এদের সংরক্ষণের জন্য কর্ম পরিকল্পনা করা কঠিন হচ্ছে।

এখন, বাংলাদেশে মোরো আদিবাসীদের সহায়তায়, গবেষকরা জানতে পেরেছেন যে বনরুইরা দেশের অনেক বনভূমিতে হয়ত টিকে আছে, তবে খুবই ক্ষুদ্র আকারে, বিচ্ছিন্ন সংখ্যার মধ্যে। এই শক্ত খোলসযুক্ত স্তন্যপায়ী প্রাণীটি তাদের আলাদা শারীরিক গঠন ও শক্ত আইঁশের খোলসের দেহের কারণে বাংলাদেশে সংখ্যায় কমেছে, প্লস ওয়ান নামের জার্নালে এপ্রিল ২০১৭তে প্রকাশিত এক গবেষণায় তা বলা হয়েছে।

গবেষণার নেতৃত্বদানকারী লেখক, ঢাকা, বাংলাদেশের ক্রিয়েটিভ কনজার্ভেশন এ্যালায়েন্সের স্কট ট্রাজেসের বলেছেন যে তারা প্রথমে বনরুইয়ের সন্ধান শুরু করে যখন বাংলাদেশের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের একজন স্থানীয় মধু সংগ্রহকারী তাদের জানান যে “বড়, আঁশযুক্ত মাছ, ‘বন রুই’ বনে লুকিয়ে ছিল”।

ট্রাজেসের বলেন “লাউয়াছড়া ছিলো আমাদের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রধান গবেষণা এলাকা কিন্তু বছরজুড়ে জরিপের সময়ে আমরা কখনও কোনো বনরুই দেখিনি। ২০১৫ সালে আমাদের জন্য এই নতুন উৎসাহের তথ্য ছিল। তাই আমরা একটি জীবন্ত বনরুইয়ের সন্ধান শুরু করেছিলাম কারণ বাংলাদেশে তাদের সম্পর্কে কিছুই জানা ছিল না। আমরা যখন লাউয়াছড়ার বেশ কয়েকটি প্যাঙ্গোলিনের উপস্থিতি আবিষ্কার করলাম, তখন আমরা এক ধাপ এগিয়ে গেলাম এবং গবেষণা করার সিদ্ধান্ত নিলাম যে দেশের কোন বনভূমিগুলোতে এখনও বনরুই টিকে আছে।”

গবেষক দল বিস্মিত হয়েছেন গবেষণার কতিপয় ফল দেখে। উদাহরণস্বরূপ, কিছু গবেষকগণ আগে বলতেন যে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি যে প্রজাতির বিপন্ন বনরুই দেখা যায় তা হচ্ছে দেশি বনরুই (Manis crassicaudata)। গবেষকগণ এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে মহাবিপন্ন চীনা বনরুই (Manis pentadactyla) অত্যন্ত বিরল বা বিলুপ্ত হয়েছে।

চীনা বনরুই, বাংলাদেশে বিপন্ন, আলোকচিত্র: Nachbarnebenan

যাইহোক, ট্রাজেসারের দল গবেষণায় উল্টো ফল দেখেছেন। ফলাফলে দেখা যাচ্ছে চীনা বনরুই ছোট, বিচ্ছিন্ন সংখ্যার মধ্যে স্বল্প হলেও লাওয়াছড়া জাতীয় উদ্যান এবং এর পাশের সুরক্ষিত বনভূমি ও পার্শ্ববর্তী এলাকার চা বাগানগুলিতেও দেখা যায়। তার তুলনায় দেশি বনরুই সম্ভবত দেশের মধ্যে বিরল বা বিলুপ্ত। সামগ্রিকভাবে, এই দলটি বাংলাদেশে দেশি বনরুই বা জাভাদেশীয় বনরুইয়ের (Manis javanica) “সাম্প্রতিক বা ঐতিহাসিক প্রমাণ” খুঁজে পায়নি।

আরো পড়ুন:  ৬০টি সুন্দি কাছিম গোপালগঞ্জ জেলার বাঘিয়া নদীতে অবমুক্ত

ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন অ্যালায়েন্সের গবেষক সহ-লেখক অনিমেশ ঘোষ বলেন, “বাংলাদেশের উত্তরপূর্বাঞ্চলে এখনও দেশি বনরুই পাওয়ার একটি সম্ভাবনা থাকতে পারে, কিন্তু এই মুহূর্তে দেশবাসী এই দুটি প্রজাতির বেঁচে থাকার জন্য চেষ্টা করতে পারে। আমি বিশ্বাস করি আমরা বাংলাদেশে চীনা বনরুইদের একটি টেকসই জনসংখ্যা বজায় রাখার জন্য সাফল্য অর্জন করবো কিন্তু আমরা ভারতীয় বা জাভাদেশীয় বনরুইয়ের জন্য একই কাজ করতে পারব না।”

গবেষকরা আবিষ্কার করেছেন যে বনরুই শিকার ২০১০ সাল থেকেও বেড়েছে। বনরুইয়ের আইশযুক্ত খোলসের দাম বৃদ্ধির কারণে এটির শিকার বেড়েছে, দেশের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের পার্বত্য চট্টগ্রামের মোরো গোত্রের শিকারীদের সাথে সাক্ষাত্কারের পরিপ্রেক্ষিতে গবেষকরা সিদ্ধান্ত নেন। ২০০৮ বনরুইয়ের ১ কেজি (২.২ পাউন্ড) মূল্য ছিলো ১০০ ডলার বা ৮০০০ টাকার নিচে, যা জানুয়ারি ২০১৬তে দাম বেড়ে হয়েছে ৫০০ মার্কিন ডলার বা ৪০,০০০ টাকা।

গবেষকরা একজন বনরুই শিকারির সাক্ষাতকার নিয়েছিলেন, এবং সেই শিকারি সাক্ষাতকারে বলেছিলেন যে ২০১০ সাল থেকে তিনি ৩২টি বনরুইকে হত্যা করেছিলেন, তবে ২০১৪ সালে তিনি মাত্র ২টি শিকার করতে পেরেছিলেন। ফলে গবেষকরা বিশ্বাস করেন যে এই এলাকার বনরুইয়ের সংখ্যা তীব্রভাবে কমে এসেছে। এলাকাটিতে ক্যামেরা ফাঁদ জরিপের ফল দেখাচ্ছে উক্ত এলাকায় ১৯টি স্তন্যপায়ী প্রজাতি দেখা মিললেও কোনো বনরুইয়ের দেখা মেলেনি, যদিও ক্যামেরা ফাঁদের মাধ্যমে ১৬ হাজারেরও বেশি ছবি তুলে এই গবেষণা চালানো হয়।

গবেষক দলটি উপসংহারে পৌঁছেছেন যে প্রকৃতপক্ষে, মায়ানমারের মাধ্যমে চীনে ব্যবহারের জন্য বনরুইয়ের আঁশের বাণিজ্যিক সংগ্রহ – সম্ভবত পার্বত্য চট্টগ্রামের বেশীরভাগ এলাকা থেকে বনরুইকে নিশ্চিহ্ন করেছে। প্ররো মোরো পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত মোরো শিকারী এবং গবেষণার জানান যে তিনি এখন উপলব্ধি করেছেন যে তার গ্রামের কাছে কয়েকটি বনরুই এখনো অবশিষ্ট থাকতে পারে, যদিও আগে অনেক ছিলো। প্ররো মোরো এবং পাসিং মোরো, এই দুজনকে গবেষকগণ “প্যরাবায়োলজিস্ট” হিসাবে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন যাতে তারা বনরুইয়ের উপর তথ্য সংগ্রহ করতে সাহায্য করেন এবং এই বিপন্ন প্রাণীদের সংখ্যা ও প্রবণতা সম্পর্কে অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করেন।

আরো পড়ুন:  বাংলাদেশের নওগাঁ জেলার আত্রাই উপজেলা থেকে কচ্ছপ উদ্ধার, দুই জনের কারাদণ্ড

গবেষক দলটি এখনও তাদের জজরিপগুলো চালিয়ে যাচ্ছেন।

ট্রাজেসের বলেন যে “চীনা বনরুই মহাবিপন্ন অবস্থায় রয়েছে এবং যদি তাদেরকে বাংলাদেশ সংরক্ষণ করতে হয় তবে আমাদের নিবিড়ভাবে সাহায্যের প্রয়োজন। আমাদের প্রতিভাবান জীববিজ্ঞানী, অনিমেশ ঘোষ, বর্তমানে আমাদের প্যরাবায়োলজিস্ট প্ররো ম্রো’র মাধ্যমে ঐতিহ্যবাহী পরিবেশগত জ্ঞান ব্যবহার করে বাংলাদেশে বনরুইয়ের পরিসীমা এবং অবস্থা নির্ধারণ করছে। রুফোর্ড ক্ষুদ্র অনুদানের অর্থায়নে, তারা দেশের উত্তরপূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্বে অঞ্চলের বেশিরভাগ বনভূমি এলাকায় বনরুইয়ের অবস্থানের পরিমান নির্ধারণ চেষ্টা চালিয়ে যাবে।”

Leave a Comment

error: Content is protected !!