ভূমিকা: ঘড়িয়াল (বৈজ্ঞানিক নাম: Gavialis gangeticus ইংরেজি নাম: Gharial বা Gavial) ক্রোকোডিলিয়া বর্গের সরীসৃপের একটি প্রজাতি। বাংলাদেশের সরীসৃপগুলোর যে তালিকা রয়েছে তাতে ঘড়িয়াল এক অনন্য বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন প্রানি। ঘড়িয়াল সম্পর্কে আমার সংগৃহীত তথ্যগুলো আপনাদের জ্ঞাতার্থে পেশ করছি। আমরা কী বাংলাদেশে মহাবিপন্ন এই প্রানিটিকে ফিরিয়ে আনতে পারি না।
পরিচিতি:
সরিসৃপ শ্রেণির কুমির বর্গের ঘড়িয়াল পরিবারের একমাত্র প্রজাতি ঘড়িয়াল। পূর্ণ বয়স্ক ঘড়িয়ালের গায়ের রঙ ঘন জলপাই-সবুজ। কুমির সাদৃশ্য প্রাণীটির চোয়াল সরু ও লম্বা, লেজ থেকে মাথা পর্যন্ত দৈর্ঘ্য পাঁচ মিটার এবং ওজন ৬৮০ কেজি পর্যন্ত হতে পারে। সাধারণত এর ওপরের পাটিতে ২৭ থেকে ২৯টি এবং নিচের পাটিতে ২৫ থেকে ২৬টি ক্ষুরধার দাঁত থাকে।
ঘড়িয়াল-এর বর্ণনা:
তুন্ড লম্বাটে, সরু এবং বয়স বাড়ার সাথে সাথে আকৃত বিভিন্ন ধরনের (আনুপাতিক হারে লম্বা ও সরু হয়)। পুরুষ ঘড়িয়ালের দেহের সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য ৬.৫ মিটার এবং স্ত্রী ঘড়িয়ালের সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য প্রায় ৪.৫ সেমি (Sharma, 2002)। প্রাপ্তবয়স্ক ঘড়িয়াল জলপাই রঙের, অপ্রাপ্তবয়স্ক ঘড়িয়াল হালকা রঙের এবং দাগযুক্ত বা গাঢ় বাদামী রঙের ব্যান্ড থাকে। দেহের মজবুত বর্ম, নুকাল প্লেট এবং পৃষ্ঠীয় স্কুট নিয়মিত সিরিজ তৈরী করে এবং ২১ বা ১২টি আড়াআড়ি সারি তৈরী করে বা কখনো সচচেয়ে বাহিরের সারি অস্পষ্ট স্কুট বা কাটার-এর মতো মনে হয়। সচরাচর দুইটি পোষ্ট-অক্সিপিটাল স্কুট থাকে। সামনের পা ও পিছনের পায়ের আঙ্গুল আংশিক লিপ্তপাদযুক্ত; সামনের পায়ের মধ্যের আঙ্গুল এক-তৃতীয়াংশে এবং বাহিরের আঙ্গুলের দুই-তৃতীয়াংশ লিপ্তপদ থাকে।
ঘড়িয়ালের পায়ের বাহ্যিক অংশে মজবুত দাঁতযুক্ত fringes থাকে। চোয়ালের প্রতিপার্শ্বে এক ডজনের বেশি ধারালো ও সুচালো দাঁত থাকে। এদের লেজ সুগঠিত এবং পাশ্বীয়ভাবে চ্যাপ্টা। প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ ঘড়িয়ালের তুন্ডের শীর্ষে স্কীত অংশ থাকে, যা ‘ghara’ নামে পরিচিত (ভারতীয় শব্দের মানে পট)। ঘাড়ার মাধ্যমে অনেক ধরনের কাজ সম্পন্ন হয়।
স্বাভাবিক আচরণের সময় ঘড়িয়াল ভোকাল সনেটর হিসেবে কাজ করে ফলে উচ্চস্বরে ভনভন শব্দ করতে পারে, যৌনমিলনের সময় স্ত্রী ঘড়িয়ালের জন্য দৃশ্যমান উত্তেজনা সৃষ্টি করে এবং যৌন মিলনের সময় বুদবুদ সৃষ্টি করতে পারে। এদের চোয়াল লম্বাটে, বেজার আকৃতির পরস্পর সংযুক্ত দাঁত থাক, যা খাদ্য হিসেবে শুধু মাছ গ্রহণকরে।
স্বভাব ও আবাসস্থল:
এই প্রজাতির ঘড়িয়াল শুধু গভীর ও দ্রুত প্রবাহমান পানিতে বাস করে তবে নদীতে যেখানে স্রোত কম সেখানে বাস করতে অধিকতর পছন্দ করে। (Whitaker and Basu, 1983)। এরা স্থলভাগে ভালভাবে খাপ-খাইয়ে চলতে পারে না; পানিতে ক্ষিপ্ত থাকে তবে প্রাপ্ত বয়স্ক ঘড়িয়ালের অন্যান্য কুমিরের মতো দেহ মাটি থেকে উঠাতে পারে না (Bustard and Singh, 1978)।
এরা স্থলভাগে পায়ের সাহায্যে দেহ উদর ও পেট ঘষে সামনের দিকে অগ্রসর হয়। প্রাপ্ত বয়স্ক ঘড়িয়াল খাদ্য হিসেবে প্রধানত মাছ গ্রহণ করে তবে এরা খাদ্য হিসেবে ব্যাঙ ও কীটপতঙ্গ গ্রহণ করতে পারে। এদের দাঁত যুক্ত চোয়াল শিকার পিচ্ছিল মাছ ধরতে সাহায্য করে।
এদের তুন্ড সরু হওয়াতে তুন্ডে তুলনামূলকভাবে কম পানি বাধা পায় এবং যা পানির নিচে দ্রুত নড়াচড়ার সহায়তা করে। স্ত্রী ঘড়িয়াল-এর বয়স ১০ বৎসর ও দৈর্ঘ্য প্রায় ৩ মিটার হলে যৌন পরিপক্কতা লাভ করে। পুরুষ ঘড়িয়াল কয়েকটি স্ত্রী ঘড়িয়াল-এর হারেম/আন্তঃপুর পাহারা দেয়।
এরা বালুযুক্ত স্থানে রৌদ্র পোহায় এবং বাসা তৈরী করে। এদের যৌন সঙ্গম নভেম্বর-জানুয়ারী মাসে সম্পন্ন হয়। শুষ্ক মৌসুমে মার্চ মাসে এরা বাসা তৈরী করে। স্ত্রী ঘড়িয়াল বালুতে তৈরী গর্তে (বাসা) ৩০-৫০টি ডিম পাড়ে এবং ডিমের আকৃতি কুমিরে প্রজাতিদের মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং গড় ওজন ১৬০ কেজি। ডিমের পরিস্ফুটনকাল ৩ মাস ঘড়িয়ালের চোয়ালের আকৃতি অস্বাভাবিক হওয়ার কারণে এরা অন্যান্য কুমিরের মতো মুখে বাচ্চা নিয়ে ঘুরে বেড়ায় না (Singh and Bustard, 1977)
বিস্তার:
বাংলাদেশ (প্রায় বিলুপ্ত, সম্ভবত ভারতের উজান থেকে আসা ঘড়িয়াল কদাচিৎ নদীতে দেখা যায়)। ভুটান, মিয়ানমার, (সম্ভবত সম্পূর্ণ বিলুপ্ত), নেপাল, পাকিস্তান, (সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হওয়ার পথে)। এই প্রজাতির ঘড়িয়াল ও বহ্মপুত্র নদীতে (ভারত ও ভুটান), সিন্ধু নদী, (পাকিস্তান) গঙ্গা নদী (ভারত ও নেপাল) এবং মহানদী (ভারত) এ পাওয়া যায় ।
ঘড়িয়াল-এর অবস্থান:
বিশ্বব্যাপী মহাবিপন্ন এবং ধারণা করা হয় যে, দুইশতের কম প্রজননে সক্ষম ঘড়িয়াল পৃথিবীতে রয়েছে। এছাড়াও ঘড়িয়াল CITES-এর পরিশিষ্ট-১ এ উল্লেখ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। মাছ ধরার সময় জেলে জালে আটকে গেলে জেলেরা এদের তুন্ড কেঁটে ফেলে বা মেরে ফেলার কারণে পৃথিবী থেকে ঘড়িয়াল ধ্বংস হয়ে যাওয়ার মূল কারণ। অতিরিক্ত মৎস্য আহোরনের ফলে শিকারি প্রজাতি হ্রাস পাওয়া এবং নদীর তীরে নিরাপদ আবাসস্থলের কারণে ঘড়িয়াল ধ্বংস হয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ।
তথ্যসূত্র:
১. সুপ্রিয় চাকমা (সম্পা.), বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ: উভচর প্রাণী ও সরীসৃপ, খণ্ড: ২৫ (ঢাকা: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ২০০৯), পৃ. ১৯৮-২০০।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।