উদ্ভিদ ও প্রাণীর প্রজাতিসমূহের পরস্পর নির্ভরশীলতা (ইংরেজি: Interdependency between animal and plant species) হচ্ছে খাদ্য, শ্বসন, নাইট্রোজেন, পরাগায়ন, বীজ বিস্তারণ, আবাসস্থল ইত্যাদি ক্ষেত্রে একে অপরের উপর পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া।
পরিবেশের জীবগুলোকে একটু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে এরা একে অপরের উপর নির্ভরশীল। আকৃতি ও প্রকৃতিগতভাবে উদ্ভিদ ও প্রাণী দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের জীব তবু পৃথিবীতে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে এরা একে অন্যের সাথে ঘনিষ্টভাবে সম্পর্কযুক্ত। এ সম্পর্কে নিচের আলোচনা থেকে আপনার অভিজ্ঞতাকে মিলিয়ে দেখুন।
সবুজ উদ্ভিদ সালোক সংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় নিজের খাদ্য নিজে প্রস্তুত করে। হরিণ, খরগোস, গরু, ছাগল ইত্যাদি প্রাণী এসব সবুজ উদ্ভিদ যেমন- তৃণ, লতা-পাতা, ঘাস ইত্যাদি খেয়ে বেঁচে থাকে। এরা হলো তৃণভোজী প্রাণী। বাঘ, শিয়াল, মানুষ, কুকুর, বিড়াল ইত্যাদি নানা রকম প্রাণী এসব তৃণভোজী প্রাণীদের খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। এদেরকে মাংসাশী প্রাণী বলে। এসব প্রাণীর মৃত্যুর পর ব্যাক্টেরিয়া এদের দেহকে পচিয়ে মাটিতে মিশিয়ে দেয়। ফলে এদের দেহের উপাদানসমূহ বিশ্লিষ্ট হয়ে মাটিতে মিশে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করে। উদ্ভিদ এসব উপাদান মাটি থেকে মূলের সাহায্যে শোষণ করে নিজ দেহ গঠনে কাজে লাগায়। এ থেকে আমরা জানলাম— শ্বেতসার খাদ্য উদ্ভিদ দেহ থেকে পর্যায়ক্রমে প্রাণী দেহে যায়। প্রাণীর মৃত্যুর পর খাদ্যের উপাদানগুলো আবার উদ্ভিদ দেহে ফিরে আসে। প্রকৃতিতে এ ঘটনা চক্রাকারে ঘটছে। একে বলা হয় খাদ্য চক্র। প্রকৃতিতে খাদ্য শৃঙ্খলের এই ধারাবাহিকতা না থাকলে কোনো জীবই বেঁচে থাকতে পারতো না।
কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও অক্সিজেনের ভারসাম্য রক্ষায় নির্ভরশীলতা
সবুজ উদ্ভিদ সালোক সংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় কার্বন-ডাই-অক্সাইড এবং পানি থেকে শ্বেতসার খাদ্য প্রস্তুত করে এবং অক্সিজেন বায়ুমন্ডলে ছেড়ে দেয়। ফলে বায়ুমন্ডলর CO২ এর অনুপাত কমে যায় এবং O২ এর অনুপাত বেডে যায়। প্রাণীরা আবার শ্বসনের সময় O২ গ্রহণ করে এবং CO২ ত্যাগ করে। এ কারণেই বায়ু মন্ডল কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও অক্সিজেনের অনুপাতের ভারসাম্য রক্ষা হয়। এ জন্যই পৃথিবীর পরিবেশ সমস্ত জীবকুলের বসবাস উপযোগী রয়েছে।
নাইট্রোজেন আদান প্রদানে পরস্পর নির্ভরশীলতা
আমিষ একটি গুরুত্ব পূর্ণ খাদ্য উপাদান যা জীবের দেহ গঠন ও ক্ষয় পূরণে কাজে লাগে। এই আমিষ তৈরিতে নাইট্রোজেন অপরিহার্য। উদ্ভিদ ও প্রাণীর মাধ্যমে বায়ু মন্ডলের নাইট্রোজেন চক্রাকারে ব্যবহৃত হচ্ছে, যাকে নাইট্রোজেন চক্র বলে। নাইট্রোজেন চক্র সম্পন্ন না হলে জীবদেহের অতি প্রয়োজনীয় উপাদান আমিষ তৈরি সম্ভব হতো না?
পরাগায়ন ও মধু আহরণ পরস্পর নির্ভরশীলতা
সকল সপুষ্পক উদ্ভিদ বীজের সাহায্যে বংশ বিস্তার করে। পরগায়নের ফলে উদ্ভিদের এই বীজ উৎপাদন সম্ভব হয়। শিমুল, পলাশ প্রভৃতি ফুল পাখির মাধ্যমে পরাগায়ন ঘটায়। কদম ফুলের পরাগায়ন বাদুর-এর মাধ্যমে এবং কচু জাতীয় ফুলের পরাগায়ন শামুক-এর মাধ্যমে ঘটে। কাঠ বিড়ালী বা অন্যান্য প্রাণী যখন খাদ্যের অন্বেষণে ছুটে বেড়ায় তখন নিজের অজান্তেই কোনো কোনো ফুলের পরাগায়ন ঘটায়।
প্রাণীর সাহায্য ছাড়া কোনো কোনো উদ্ভিদের পরাগায়ন সহজে সম্ভব হতো না। ফুলের মধু প্রাণীর উত্তম খাদ্য, আর এই মধুর জন্যই প্রাণীরা পরাগায়ন ঘটায়।
ফল ভক্ষণ ও বীজের বিস্তরণ-পরস্পর নির্ভরশীলতা
বেশির ভাগ প্রাণী উদ্ভিদের ফল খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। অনেক সময় এসব ফলের বীজ প্রাণীর পেটে চলে যায় কিন্তু হজম হয় না। পরিপাকতন্ত্র থেকে এসব বীজ সজীব অবস্থায় বেরিয়ে আসে এবং ছড়িয়ে পড়ে। কাক এবং অন্যান্য পাখির মাধ্যমে নীম উদ্ভিদের বীজ এভাবে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। এ ছাড়া প্রাণী ফলের রসাল অংশ খেয়ে বীজ যেখানে সেখানে ফেলে দিলেও বীজের বিস্তরণ ঘটে। আমরা ভেবে দেখতে পারি পরিবেশের কোন কোন প্রাণী ফুল, পেয়ারা, আম, জাম, কাঁঠাল প্রভৃতি উদ্ভিদের বীজের বিস্তরণ ঘটায়?
ফলে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, খাদ্যের জন্য উদ্ভিদ ও প্রাণী একে অপরের উপর নির্ভরশীল। প্রকৃতিতে উদ্ভিদ ও প্রাণীর পরস্পর নির্ভরশীলতার ফলেই নাইট্রোজেন চক্র সম্পন্ন হয়। পরিবেশের কার্বন ও অক্সিজেন চক্র সম্পন্ন হওয়ার ব্যাপারে উদ্ভিদ ও প্রাণী পরস্পর নির্ভরশীল। উদ্ভিদ পরাগায়ন এবং প্রাণী মধু সংগ্রহের জন্য একে অন্যের উপর নির্ভর করছে। প্রাণী উদ্ভিদের ফল খেয়ে জীবন ধারণ করে এবং উদ্ভিদ বীজের বিস্তরনের জন্য প্রাণীর উপর নির্ভর করে।
এ ছাড়া প্রাণী বস্তু, বাসস্থান, ঔষধ ইত্যাদির জন্য উদ্ভিদের উপর নির্ভরশীল। যেমন সর্পগন্ধ্যা উদ্ভিদের শিকড়ের রস উচ্চ রক্তচাপ নিরাময় করে, পাথর কুচির পাতার রস চুনের পানির সাথে মিশিয়ে খেলে কৃমি উপশম হয়, তুলসী পাতার রস হাঁপানী ও কাশির উপশম করে। অন্যদিকে কোন কোন প্রাণী উদ্ভিদকে আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যবহার করে।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।