লাক্ষা এক জাতীয় ক্ষুদ্র কীটের দ্বারা তৈরী হয়। কুসুম, পলাশ, অশ্বথ, বট, পাকুড়, বেল, অড়হর, বদর (কুল) প্রভৃতি গাছে সাধারণতঃ লাক্ষা জন্মে। এর মধ্যে কুসুম, পলাশ, অশ্বথ প্রভৃতি গ থেকে প্রস্তুত করা লাক্ষা গুণে শ্রেষ্ঠ।
লাক্ষা কীট এর পরিচয়
লাক্ষা কীট যে গাছের ডালে আশ্রয় নেয়, সেই গাছের রস পান করে জীবনধারণ করে। এই সময় কীটেরা শরীর থেকে যে লালস্রাব বের করে, তা গাছের ডালে পর পর লেগে গিয়ে চাপড়ার সৃষ্টি হয়। মাসখানিকের মধ্যে পুরুষ কীট বড় ও পক্ষযুক্ত হয়। এরপর স্ত্রী কীটের গর্ভাধান হলে তারা প্রচুর পরিমাণে গাছের রস পান করে এবং তখন অধিক লালাস্রাব নির্গত করে লাক্ষার সৃষ্টি করে। ২ থেকে ৩ মাসের পর পুনরায় ডিম হয়। এভাবে লাক্ষা কীট এক গাছ থেকে অন্য গাছে তাদের বংশ বিস্তার করে। বৎসরে ২ বার লাক্ষা উৎপন্ন হয়।
জুন-জুলাই এবং ডিসেম্বর-জানুয়ারী মাসে লাক্ষা পাওয়া যায়। গাছের ডাল থেকে লাক্ষা ভালভাবে পৃথক করে নিলে সেটাই ঔষধার্থে কাজে লাগে। এই লাক্ষা থেকে প্রস্তুত হয় গালা। বিহারের রাঁচি ও উত্তর প্রদেশের মিরজাপুরে লাক্ষার কারখানা আছে। বিদেশে বিশেষ উৎপন্ন না হওয়ায় ভারতীয় লাক্ষার অনেকটাই বিদেশে রপ্তানি করা হয়ে থাকে।
অন্যান্য নাম
লাক্ষাকে বাংলায় লাক্ষা, লাহা, গালা; হিন্দীতে লাখ, লাহ; সংস্কৃতে জতু, লাক্ষা প্রভৃতি নামে ডাকা হয়। লাক্ষার ইংরেজী নাম Lac, এই Lac তৈরী করে Lac insect. ভারতবর্ষে ১৪ প্রকারের লাক্ষা কীট পাওয়া যায়। এই ১৪ প্রকার insect-এর মধ্যে যেটির ভূমিকা মুখ্য, অর্থাৎ বর্তমানে প্রাপ্ত লাক্ষা যে প্রজাতির কীট তৈরী করে, তার ল্যাটিন নাম Laccifer lacca (Kerr), ফ্যামিলী Lacciferidae., ঔষধার্থে ব্যবহার্য অংশ- লাক্ষা।
লাক্ষা কীট এর বিবিধ ব্যবহার
বহু প্রাচীন কাল থেকে ভারতে লাক্ষার ব্যবহার চলে আসছে। মেয়েদের প্রসাধনের কাজে বেশি ব্যবহৃত হতো। লাক্ষা থেকে তৈরী হত আলতা বা অলক্ত, লাক্ষার আর এক নাম অলক্তক। এটি মেহেদীর পরিবর্তেও ব্যবহার হয়ে থাকে। হাতের চেটো, আঙ্গুল প্রভৃতির উপর চিত্র-বিচিত্র নক্সা তৈরীর জন্যও ব্যবহৃত হয়। বর্তমানে লাক্ষা থেকে আলতা তৈরী হয় না।
পূর্বে লাক্ষা থেকে তৈরী করা আলতা পায়ে দিলে হাজা বা পাকুই, কোন প্রকার চুলকানি হতো না। বর্তমানের কেমিক্যাল আলতাতে সে উপকার হয় না, কোন কোন ক্ষেত্রে চুলকানি বা এলার্জি হয়ে থাকে। লাক্ষা থেকে তখনকার দিনে পুঁথি প্রভৃতি লেখার জন্য অতি উজ্জ্বল কালি তৈরী হতো, তাই এর আর এক নাম মুদ্রণী।
প্রাচীন আয়ুর্বেদীয় চিকিৎসা গ্রন্থসমূহে দেখা যায় যে, এটি নানা প্রকার রোগের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে। লাক্ষাকে নানাপ্রকার কাজে লাগালেও এটির ঔষধি-গুণ নিয়ে বিশেষ কিছু সমীক্ষা হয়েছে বলে মনে হয় না। বর্তমানে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে নানা রকমের দ্রব্য তৈরী হয়। গ্রামোফোন রেকর্ড তৈরীর জন্য এটির ব্যাপক ব্যবহার ছিল। বর্তমানে অন্য পদার্থ (synthetic substitutes) দিয়ে তৈরী হচ্ছে। বৈদ্যুতিক শিল্পের বহু কাজে এর প্রয়োগ পরিলক্ষিত হয়। বার্নিশের জন্য এর ব্যবহার সর্বজনবিদিত। লাক্ষা থেকে গালা তৈরী হয় এবং তা নানাবিধ কাজে লাগে। চক্চকে জেল্লাদার কাগজ, দামী কালি, নখ পালিশ, চশমার ফ্রেম, দাঁতের প্লেট প্রভৃতি। প্রস্তুতের কাজে এবং অলঙ্কার শিল্পে ব্যবহৃত হয়। এই রকম ছোট বড় নানা কাজে লাক্ষার ব্যবহার হচ্ছে।
সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।
তথ্যসূত্র:
১. আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য: চিরঞ্জীব বনৌষধি খন্ড ১০, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, চতুর্থ মুদ্রণ ১৪০৭, পৃষ্ঠা, ৫০-৫১।
বি. দ্র: ব্যবহৃত ছবি উইকিমিডিয়া কমন্স থেকে নেওয়া হয়েছে। আলোকচিত্রীর নাম: Shyamal
জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ সম্মান ও এমএ পাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। বিভিন্ন সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রোদ্দুরে ডট কমের সম্পাদক।