বন্যপ্রাণ রক্ষায় অনুপ সাদি এবং ‘জীববিচিত্রা’ আন্দোলন

  • রকিবুল হক সুলভ, লেখক ও সাংবাদিক

অনুপ সাদি প্রকৃতিপ্রেমী একজন লেখক। যদিও রাজনৈতিক বিশ্লেষণ এবং কবিতা লেখায় তার আগ্রহ বেশি, তদুপরি তিনি প্রকৃতি বিষয়েও অনেক কাজ করছেন। বন্য প্রাণীর প্রতি তার ভালোবাসা শৈশব থেকেই। তবে পাখির প্রতি তার কাজ করার আগ্রহ জন্মে ২০০৯ সালে। সেই আগ্রহ জন্মেছিল সৌরভ মাহমুদের এক প্রতিবেদন পড়ে। সে বছর অক্টোবরে প্রথম আলোতে ছাপা হয় “পদ্মার চরে বিরল ‘বাংলা বাবুই’ পাখির বাসা” শিরোনামের এক প্রতিবেদন। সেই প্রতিবেদন তাকে তীব্রভাবে আলোড়িত করে।

তাৎক্ষণিকভাবে অনুপ সাদি প্রথম আলো থেকে সৌরভের ফোন নম্বর সংগ্রহ করেন এবং তার সাথে কথা বলেন। ২০০৯ সালের অক্টোবরের ২৩ তারিখে তাদের প্রথম সাক্ষাৎ হয় জাতীয় প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে। ফলস্বরূপ তার অনেক কাজের ভেতর পাখিদের বাঁচানোর কাজটিও ঢুকে পড়ে। তিনি পাখি বিষয়ক বই কিনতে থাকেন, বুনো পাখি বিক্রি-শিকার-হত্যা প্রতিরোধ করতে থাকেন, বন্য পাখি উদ্ধার চালাতে থাকেন, পাখি সংক্রান্ত কোনো কিছু জানার প্রয়োজন পড়লে শরীফ খান, ইনাম আল হক ও সৌরভ মাহমুদকে ফোন করে জেনে নিতে থাকেন। 

প্রাণকাকলি নামে একটি ব্লগ তৈরির পর লেখা প্রকাশের একটি ঠিকানা তৈরি হলে অনুপ সাদি ২০১২ সালের জানুয়ারি মাস থেকে প্রাণ ও প্রকৃতি বিষয়ক লেখা একের পর এক সেখানে প্রকাশ করতে থাকেন। সেই ধারাবাহিকতায় প্রাণকাকলিতে আগস্ট ২০১৪ পর্যন্ত ১৫০টি পাখির পরিবার ও গণের নামসহ সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরেন। বাংলাদেশের পাখিদের তালিকাটিকে তিনি প্রথম অনলাইনে সহজলভ্য করে দিয়েছিলেন ২০১২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর। এরপর বাংলাদেশের বন্যপ্রাণীর একটি তালিকাও প্রকাশ করেন তিনি।

বাংলাদেশের পাখির তালিকার কাজটি অনুপ সাদি করেছিলেন পাখিদের বাঁচাতে পাখিদের প্রতি ভালোবাসা থেকেই। তার সেই প্রাণকাকলি সাইটে যেসব প্রাণের ছবি ছিল, সেগুলো ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছেন তার অনেক বন্ধু। সেসব বন্ধুর কাছে তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। ২০১২ সাল থেকে তিনি ব্যবহার করেছেন সৌরভ মাহমুদের তোলা বেশ কিছু আলোকচিত্র। এ ছাড়া ব্যবহার করেছেন কিরণ খান, রেজাউল হাফিজ রাহী এবং ফিরোজ আল সাবাহর বেশ কিছু আলোকচিত্র। তিনি তার এই বন্ধুদের কাছে কৃতজ্ঞ শুধু তাদের চিত্রগুলোর জন্যই নয়, তারা প্রতিনিয়ত বন্যপ্রাণ ও প্রকৃতি রক্ষার জন্য চেষ্টা করছেন সেই অসামান্য অবদানের জন্যও।

২০০৯ সালের ১৫ অক্টোবর অনুপ সাদি গড়ে তোলেন ‘জীববিচিত্রা’ নামে প্রাণ, প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষায় নিয়োজিত একটি স্বেচ্ছাসেবী সামাজিক সংগঠন। সংগঠনের শুরুতে আহ্বায়ক কমিটি করা হলেও পরবর্তীতে তাকে সংগঠনের সভাপতি করা হয়। এর কর্মপরিধি সারা দেশে বিস্তৃত ছিল। শুরুতে এর সদস্য সংখ্যা ছিল ২৬ জন। শুরু থেকেই সংগঠনটি নানা কাজকর্ম সযত্নে করে যেতে থাকে।

যারা শহুরে মধ্যবিত্ত তারা নিজের পাতে ঝোল নিতে, কৃতিত্ব নিতে মওকা পেলেই নানা সংগঠন করে ফেলে। কিন্তু ‘জীববিচিত্রা’ মনে করে তারা প্রকৃত প্রস্তাবে বিশেষ কিছুই করেনি। বরং যে কৃষক তার ফসল বাঁচাতেই জমিতে পুঁতে দিচ্ছেন কাকতাড়ুয়া, নিজের বাঁশের ঝাড়ে দিচ্ছেন পাখির নিশ্চিন্ত আশ্রয়, পাশের ঝোপটিতে অবচেতনে পুষে রাখছেন বন্য শিয়ালটি, যে ছেলেটি লুঙ্গি কুচা দিয়ে পাখি থাকবে বলে গাছে বেঁধে দিচ্ছে হাঁড়ি, নিজ মহল্লায় কিংবা পাশের বিলটিতে ঢুকতে দিচ্ছে না কোনো শিকারি, তাদের অবদান অনেক বেশি। ‘জীববিচিত্রা’ সাংগঠনিকভাবে তাদের উনুনে জ্বালানি যোগ করেছে।

‘জীববিচিত্রা’ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশি জাতের কয়েক হাজার বৃক্ষ ও গুল্মের চারা বিতরণ করেছে। এসব গাছ বিতরণের সময় খেয়াল করেছে পাখি খাদ্যবান্ধব বৃক্ষ, যেমন বট, অশ্বত্থ, ডুমুর ইত্যাদি দিতে। এ ছাড়া ‘জীববিচিত্রা’ জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বৃক্ষ-প্রাণী-পাখির ছবি ও পেপার কাটিং প্রদর্শনী করেছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়। পরিবেশবান্ধব দেশি তিন শতাধিক বৃক্ষের নামের তালিকা সম্বলিত একটি লিফলেটের কয়েক হাজার কপি বিতরণ করেছে, যাতে পরিবেশের শত্রু বিদেশি আমদানিকৃত গাছের একটি তালিকা দেওয়া হয়েছে। বিদেশি গাছ যাতে না লাগানো হয়, লিফলেটে লোকজনের প্রতি অনুরোধ করা হয়েছে। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঘুরে জনসচেতনতা তৈরি করা, ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সঙ্গে কথা বলা, সেমিনার করা, বন্যপ্রাণি ও পাখি উদ্ধারে প্রয়োজনে প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার মতো কাজগুলো বারবার করে আসছে।

আরো পড়ুন:  পরিকল্পনা ও উন্নয়ন একাডেমী আয়োজিত প্রথম আন্তর্জাতিক কনফারেন্স অনুষ্ঠিত

গফরগাঁওয়ে গ্রাম সাহিত্য কেন্দ্রের উদ্যোগে জীববিচিত্রা প্রাণ, প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষার জন্য মাসব্যাপী প্রচারণা চালিয়েছিল। ২০১০ সালের ১৫ জুন থেকে ১৫ জুলাই পর্যন্ত উপজেলার ১৫টি ইউনিয়ন ও পৌরসভায় উদ্ভিদ ও প্রাণীরক্ষা, প্রকৃতি ও পরিবেশকে স্বাভাবিক রাখার জন্য প্রচারণা ও বিনা মূল্যে চার হাজার দেশি গাছের চারা বিতরণ করে সংগঠনটি। সে সময় উপজেলার ৩০টি হাট-বাজারে জীব-বৈচিত্র্য সংরক্ষণ, বন্যপ্রাণীর খাদ্য শৃঙ্খল সম্পর্কে ধারণা প্রদান, প্রকৃতি পরিবেশের ওপর পোস্টার ও পুস্তক প্রদর্শনী এবং বৃক্ষ রোপণে উদ্বুদ্ধকরণে বক্তব্যসহ তিন শতাধিক গাছের নামের তালিকাযুক্ত লিফলেট বিতরণ করা হয়। ‘দেশি গাছ লাগান, পরিবেশ বাঁচান’ শ্লোগানকে সামনে রেখে প্রতিটি বাজারে বৃক্ষসংলগ্ন স্থানে ক্যাম্পেইন স্পট স্থাপন করে গাছের চারা বিতরণ করে সংগঠন ‘জীববিচিত্রা’।

এসব কর্মসূচিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন লেখক, কবি ও প্রকৃতিবিদ অনুপ সাদি নিজেই। উনার সঙ্গে সে সময় আমি অনেকগুলো  প্রোগ্রামে অংশ নিয়েছি। গ্রাম সাহিত্য কেন্দ্রের উদ্যোক্তা হিসেবে একটি মোটর বাইকে করে গ্রামের পর গ্রাম, বাজারের পর বাজার ছুটে বেড়িয়েছেন অধ্যাপক শফিকুল কাদির। এছাড়াও সেসব কর্মসূচিতে অংশ নেন অধ্যক্ষ কায়ছার হোসেন ভূইয়া, সাংবাদিক এইচ কবির টিটু, সাংবাদিক ফকির এ মতিন, আতাউর রহমান মিন্টু, আব্দুল মান্নান পল্টন, আব্দুস ছালাম সবুজসহ বিভিন্ন পেশা ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের প্রতিনিধিরা। এছাড়া প্রতিটি কর্মসূচিতে বিভিন্নভাবে গোটা মাসজুড়ে সহযোগিতা করেন গ্রাম সাহিত্য কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহাদাৎ হোসেন মাস্টার, গফরগাঁও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার ইকবাল-ই-আলম কামালসহ কমান্ডার সেলিম আহম্মেদ প্রমুখ। গ্রাম সাহিত্য কেন্দ্রের উদ্যোগে ‘জীববিচিত্রা’ গফরগাঁওয়ে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টিসহ বনায়ন ও সামাজিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। সেই সময় উক্ত ঘটনায় বাংলাদেশ প্রতিদিনে একটি খবর প্রকাশিত হয় ২৯ আগস্ট ২০১০ তারিখে, এবং সেটি করে দেন সাংবাদিক আজহারুল হক

উপজেলার যেসব বাজারে ক্যাম্পেইন করা হয় সেগুলো হচ্ছে লঙ্গাইর ইউনিয়নের উটিয়ার বাজার, মশাখালী ইউনিয়নের শিলা বাজার ও স্কুলের বাজার, পাইথল ইউনিয়নের গয়েশপুর ও বলদি বাজার, উস্থি ইউনিয়নের কান্দিপাড়া বাজার ও ধাইরগাঁও বাজার, দত্তের বাজার ইউনিয়নের দত্তের বাজার ও পাগলা বাজার, টাঙ্গাব ইউনিয়নের বাশিয়া বাজার ও বাঘের বাজার, নিগুয়ারী ইউনিয়নের জয় বাংলা বাজার ও ত্রিমোহনী বাজার। এ ছাড়া গফরগাঁও ইউনিয়নের শিববাড়ি বাজার, তেঁতুলিয়া বাজার, পাঁচবাগ ইউনিয়নের গলাকাটা বাজার, গাভীশিমুল বাজার, সালটিয়া ইউনিয়নের হাতিখলা বাজার, গফরগাঁও পৌরসভার পাটমহল, ডাকবাংলো চত্বর, রসুলপুর ইউনিয়নের রসুলপুর বাজার, চৌরাস্তা মোড়, বারবাড়িয়া ইউনিয়নের পাকাটি বাজার ও আব্দুল্লাহর বাজার, যশরা ইউনিয়নের দৌলতপুর বাজার, বুলবুলের বাজার, রাওনা ইউনিয়নের শিবগঞ্জ বাজার ও বড়াইল বাজার, চর আলগী ইউনিয়নের ব্রিজের মোড় ও কাচারি বাজারে প্রদর্শনী ও প্রচারণা চালানো হয়।

একই সময়ে উপজেলার স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা ও প্রাইমারি স্কুলসহ ৬০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিরল প্রজাতির গাছের চারা উপহার দেওয়া হয়। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে গফরগাঁও সরকারি কলেজ, আব্দুর রহমান ডিগ্রি কলেজ, গফরগাঁও মহিলা কলেজ, ইসলামিয়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, রোস্তম আলী উচ্চ বিদ্যালয়, মাইজবাড়ি দাখিল মাদ্রাসা, আসকর আলী উচ্চ বিদ্যালয়, লামকাইন উচ্চ বিদ্যালয়, শাখচূঁড়া উচ্চ বিদ্যালয়, হাতেম তাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ঘাগড়া উচ্চ বিদ্যালয়, গয়েশপুর কলেজ, শিবগঞ্জ কলেজ, বি. দাস উচ্চ বিদ্যালয়, সাহেব আলী একাডেমি, দত্তের বাজার ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয় অ্যান্ড কলেজ, সাইদুর রহমান মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয়, মা ফাতেমা দাখিল মাদ্রাসা, চারিবাড়িয়া মাদ্রাসা, মশাখালী উচ্চ বিদ্যালয়সহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান।

এ ছাড়া ময়মনসিংহের বিভিন্ন জনবহুল স্থানে, যেমন হাটবাজার, স্টেশন, বাস স্টপ, পার্ক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি স্থানে সচেতনতা বৃদ্ধি, প্রাণী ও বৃক্ষ পরিচিতির নিমিত্তে প্রদর্শনীর আয়োজন করে ‘জীববিচিত্রা’। প্রতিটি প্রদর্শনীতে প্রাণী ও উদ্ভিদের বিবরণ সংবলিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সংগৃহীত দেশি বিদেশি কাগজ, বই, পত্রিকা, অনেক ছবি ও পেপার কাটিং প্রদর্শিত হয়। প্রতিটি প্রদর্শনেই বিতরণ করা হয় লিফলেট।

‘জীববিচিত্রা’ ময়মনসিংহ সদর এবং এর অন্যান্য উপজেলা ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রদর্শনীর আয়োজন করে। সাতক্ষীরা জেলার ঝাউডাঙা বাজার, কলারোয়া উপজেলা সদর, আখড়াখোলা বাজার, রায়পুর বাজার, কুষ্টিয়ায় মাধবকাঠি বাজার, রাজার হাট, কোর্ট স্টেশন প্লাটফরম; দিনাজপুরের ফুলবাড়ির উর্বশী মার্কেট, ফুলবাড়ি বাস স্ট্যান্ড, ফুলবাড়ি স্টেশন; ঠাকুরগাঁও জেলার হরিপুর, দামোল, যাদুরানী বাজারে প্রদর্শনীর আয়োজন করে। ২০১১ সালের ১৯ জুন চট্টগ্রামের ওমর গনি কলেজ ও চট্টগ্রাম মহিলা কলেজে ‘জীববিচিত্রা’ সেমিনারের আয়োজন করেছিল।

আরো পড়ুন:  বাংলাদেশের সুনামগঞ্জ শহরে বিক্রি হচ্ছে হরেক প্রজাতির বুনো পাখি

‘জীববিচিত্রা’ ২০১১-২০১২ সালে বাংলাদেশে মহাবিপন্ন প্রজাতির ছোট মদনটাক পাখি নিয়ে কাজ করে, যা এ পাখিকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষায় ভূমিকা রেখেছে। বন্য পাখি উদ্ধার ও পরবর্তী অবমুক্তকরণে জীববিচিত্রা বরাবরই বিশেষ ভূমিকা রেখে আসছে। ২০১২ সালের ৩০ জুন সন্ধ্যার আগে পাঁচটি সবুজ টিয়া ও চারটি তিলা মুনিয়ার বন্দিত্ব থেকে উন্মুক্ত আকাশে ছেড়ে দেওয়া হয় ময়মনসিংহ বৃক্ষমেলা থেকে। বৃক্ষমেলায় ৬ নম্বর স্টলে প্রকাশ্যে দেশের বন্য এ-দুটি প্রজাতির পাখি বিক্রি করা হচ্ছিল। জেলা বন বিভাগীয় কর্মকর্তাকে জানালে তিনি স্টল মালিককে পাখিগুলোকে সেখান থেকে সরানোর জন্য বলেন; কিন্তু তিনি অবমুক্ত করার জন্য কোনো দৃঢ় পদক্ষেপ নেননি। এরপর ‘জীববিচিত্রা’র পক্ষ থেকে বেশ কয়েকজনের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয়। নানা চেষ্টার পর পাখিগুলোকে মুক্ত করা হয়। একই বছরের ৮ আগস্ট আটটি সবুজ টিয়া ও ১০টি রং করা মুনিয়া অবমুক্ত করে ‘জীববিচিত্রা’।

১৭ অক্টোবর ময়মনসিংহ শহরে এক পাখি বিক্রেতা কিছু কোয়েলের সঙ্গে দুটো কালোমাথা মুনিয়া বেচার চেষ্টা করছিলেন। ‘জীববিচিত্রা’র সদস্যরা তার সাথে অনেক কথাবার্তা বলেও মুনিয়া দুটো অবমুক্ত করার জন্য রাজি করাতে না পেরে সবশেষে তাকে কোতোয়ালি থানায় নিয়ে গিয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সহায়তা নিয়ে মুনিয়া দুটো অবমুক্ত করেন। পরে বিভাগীয় বন কর্মকর্তার অফিসে গিয়ে নওয়াব আলী নামে একজন কর্মকর্তার সাথে কথা বলেন। এর দুদিন পরই অর্থাৎ ১৯ অক্টোবর শহরের গাঙ্গিনারপাড়ে আরেক পাখি বিক্রেতাকে দুটি কানি বক বিক্রি করতে দেখা যায়। আবার সেই লোকের সাথে চার-পাঁচ জন মিলে কথা বলা হয় ‘জীববিচিত্রা’র পক্ষ থেকে। পরে বন বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বক দুটো অবমুক্ত করা হয়।

অক্টোবর মাসেই ‘জীববিচিত্রা’ জানতে পারে, শহরের পাশে শ্যামগঞ্জের লোকজন পাখি শিকার করে। মুক্তাগাছা থানার পাশে সাহেববাজারে সকাল সাতটার সময় পাখি বিক্রি হয়। অর্থাৎ ময়মনসিংহে পাখি শিকার ও বিক্রি একটি সাধারণ বিষয়। সেসব এলাকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জীববিচিত্রা পাখি শিকার বন্ধের চেষ্টা করে।

২০১২ সালের ১ নভেম্বর আটটি কানিবকসহ এক পুরনো কানিবক বিক্রেতাকে আবার ধরা হয় যাকে প্রায় দুই বছর আগে ২০১০ সালেও একবার একই অপরাধে ধরা হয়েছিলো। তাকে গাঙ্গিনার পাড় এলাকার বারী প্লাজার সামনে আটকে রেখেই বন বিভাগে ফোনে যোগাযোগ করা হলে বন বিভাগের লোকজন এসে তাকে ধরে নিয়ে যান। পরে অফিসে মুচলেকা নিয়ে লোকটিকে ছেড়ে দেওয়া হয়। পরে বিকেলে পাখিগুলোকে শহরের জয়নুল আবেদীন পার্ক এলাকায় অবমুক্ত করা হয়। এদিন এ কাজে চমৎকার সহযোগিতা করেন বন্যপ্রাণি সংরক্ষণ কর্মকর্তা কামরুজ্জামান ও জীববিচিত্রার সদস্য রেজাউল করিম। সেই পুরোনো বক বিক্রেতা লোকটির কাছ থেকে আগেরবার ছয়টি কানিবক উদ্ধার করা হয় এবং সেগুলোকে বন বিভাগের অফিসের ভেতরের পুকুরে অবমুক্ত করা হয়েছিল। একই বছর অবমুক্ত করা হয় চারটি বাটান। ২০১৪ সালের ১৭ ডিসেম্বর শহরে অবমুক্ত করা হয় দুটি ছোট সরালি।

২০১৫ সালের ৮ মার্চ ‘জীববিচিত্রা’ সংগঠনের সদস্যগণ ময়মনসিংহের মেছুয়া বাজার থেকে তিনটি তিলা ঘুঘু উদ্ধার করেন। পরদিন ময়মনসিংহের বিভাগীয় বন কর্মকর্তার উপস্থিতিতে সেগুলোকে স্থানীয় বন বিভাগের অফিসের ভেতরের বাগানে অবমুক্ত করা হয়। উদ্ধারে সহযোগিতা করেন ময়মনসিংহের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা গোবিন্দ রায়, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কর্মকর্তা সুমন সরকার, জীববিচিত্রার সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক হাসান জামিল ও অন্যান্য সদস্যরা। একই বছরের ৩০ অক্টোবর ময়মনসিংহ শহরে উদ্ধার করা হয় বিভিন্ন প্রজাতির ১২টি পাখি এবং সেগুলোকে সেদিনই ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরে অবমুক্ত করা হয়।

আরো পড়ুন:  মাছ ধরার কারেন্ট জাল হত্যা করছে মাছ, পাখি, প্রকৃতির অন্যান্য জীবন্ত উপাদান
জহিরুল আমিন রুবেল ও অনুপ সাদি, আলোকচিত্র: হাসান জামিল, ৩০ অক্টোবর ২০১৫

২০১৮ সালের ২৭ ডিসেম্বর সকালে ‘জীববিচিত্রা’র সভাপতি নেত্রকোণা শহরের নিকটবর্তী ঘোষের বাজারে বিক্রেতাদের কাছ থেকে একটি সুন্দি কাছিম উদ্ধার করেন। উদ্ধারকৃত সুন্দি প্রজাতির কচ্ছপটি ৩১ ডিসেম্বর আনুমানিক বেলা ১১টার দিকে জারিয়া-জাঞ্জাইলের পার্শ্ববর্তী কংস নদীতে অবমুক্ত করা হয়। কচ্ছপটি অবমুক্তিকালে লেখক ও কবি দোলন প্রভা, রাজনীতিবিদ সজীব সরকার রতন ও লিপি সরকার, শিউলি আকতার সাজিয়া, গণিতের অধ্যাপক শাহীনুজ্জামান এবং অধ্যাপকের স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা উপস্থিত ছিলেন।

সুন্দরবনের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সুরক্ষার দাবিতে বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ফেডারেশনের উদ্যোগে দেশব্যাপী গণস্বাক্ষর ও জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি প্রদান কর্মসূচির অংশ হিসেবে ময়মনসিংহে ২০১৪ সালের ২১ ডিসেম্বর ‘জীববিচিত্রা’ জেলা প্রশাসক বরাবর ৩২৫টি স্বাক্ষর সম্বলিত স্মারকলিপি প্রদান করে। এ ছাড়াও বর্তমানে ‘জীববিচিত্রা’ ব্রহ্মপুত্র নদ রক্ষায় উচ্চকণ্ঠ।

পাখির প্রতি শৈশবে অনুপ সাদির আগ্রহ জন্মিয়েছিলেন তার মা শাহেরা খাতুন। প্রকৃতিকেও ভালবাসতে শিখিয়েছিলেন তার মা, যার প্রসঙ্গ হচ্ছে এক বিশাল গল্পের ক্যানভাস। প্রকৃতির নিয়ম যিনি চিনতেন, প্রকৃতির প্রতিটি অংশকে যিনি ভালোবাসতেন। যার গল্প প্রকৃতির সঙ্গে, তিনি থাকতেনও প্রকৃতির মাঝে। অনুপ সাদির মা শাহেরা খাতুন সব সময় শত গাছপালার মাঝে বিরাজ করতেন, পাখির প্রতি তার মায়ের ভালোবাসাও ছিল অনেক গাঢ়।

অনুপ সাদি বলেন, তিনি পাখি বিশারদ নন। পাখির প্রতি ভালোবাসা থেকেই তার এতো কিছু করা। তার কোনো বন্ধু হয়ত তার এ প্রকৃতিপ্রেম নিয়ে মাঝে মাঝে ঠাট্টাও করে। কিন্তু কী আর করা যাবে। তাদেরসহ জনগণের উদ্দেশে তিনি বলতে চান, আমরা মানুষ জন্মাতে পারি, কিন্তু পাখি জন্ম দিতে পারি না। শুধুমাত্র পাখিরাই তাদের ছানা জন্ম দিতে পারে। তাই একটি প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেলে সেটি আর প্রকৃতিতে ফিরে আসবে না। মানুষ এখনো বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া প্রাণকে ফিরিয়ে আনতে পারে না।

পাখি রক্ষা নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে অনুপ সাদি সবসময় একজন কর্মকর্তার সহযোগিতা পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন, যার নাম মোল্যা রেজাউল করিম, যিনি পাখি ও অন্যান্য বন্যপ্রাণ বাঁচাতে প্রতিনিয়ত খেটে চলেছেন। অনুপ সাদি উল্লেখ করেছেন যে, পাখি বাঁচাতে গিয়ে বন বিভাগের নানা অফিসে তিনি এতো সময় দিয়েছেন যে সেই কষ্টের কথাগুলো অন্যত্র বলার জন্য তিনি তুলে রেখেছেন। যারা পাখি বাঁচাতে চেষ্টা করেন, তারা মোল্যা রেজাউল করিমকে নির্দ্বিধায় জ্বালাতন করবেন। তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, মোল্যা রেজাউল করিম সেই জ্বালাতন সানন্দে সহ্য করবেন।

এছাড়া গফরগাঁও সরকারি কলেজে কর্মরত থাকাকালে অনুপ সাদি নিজেও ভিন্ন-ভিন্ন প্রজাতির অনেক গাছ রোপণ করেন। গাছের পরিচর্যাও করতেন নিজ হাতে। এসব গাছের মধ্যে রয়েছে কুম্ভি, নাগলিংগম, মুচকুন্দ, লোহাকাঠ, তমাল, মহুয়া, চামফল, নাগেশ্বর, পলাশ, ছাতিম, গোলাপজাম, দেশি আমড়া, কাঠ বাদাম, শরিফা, আতা, কেয়া, কৃষ্ণচূড়া, করমচা, গগন শিরীষ, জারুল, জয়তী, মনকাঁটা, বট ইত্যাদি। ঋতু বৈচিত্র্যে এসব গাছে এখন ফুল-ফল আসে। পাখিদের কলকাকলিতে মুখরিত হয় কলেজ প্রাঙ্গণ।

গফরগাঁওয়ে থাকার সময় অনুপ সাদি ব্রহ্মপুত্র নদের তীর ঘেঁষা বিভিন্ন জায়গাসহ উপজেলার বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি খুঁজে বেড়িয়েছেন, সেগুলো শনাক্ত করেছেন। বিলুপ্ত পাখিদের শনাক্তকরণ এবং সেগুলোর হিসাব রেখেছেন। পাশাপাশি ব্রহ্মপুত্রে শুশুকসহ বিলুপ্তপ্রায় জলজ প্রাণীর সন্ধান করেছেন। আমি নিজেও উনার সঙ্গে নদের আশপাশ ও বিভিন্ন স্থানে গিয়েছি এসব কাজে। 

১৪ সেপ্টেম্বর ২০২২, মগবাজার, ঢাকা।

বিশেষ দ্রষ্টব্য: অনুপ সাদি সম্পর্কিত এই মূল্যায়নটি এনামূল হক পলাশ সম্পাদিত সাহিত্যের ছোট কাগজ অন্তরাশ্রম-এর অনুপ সাদি সংখ্যা, সংখ্যা ৪, পৃষ্ঠা ৮১-৮৫, ময়মনসিংহ থেকে ৩০ নভেম্বর ২০২২ তারিখে প্রকাশিত এবং সেখান থেকে ফুলকিবাজ.কমে প্রকাশ করা হলো।

Leave a Comment

error: Content is protected !!