বায়ুরন্ধ্র বা লেন্টিসেল বা ল্যানটিসেল (ইংরেজি: lenticel) হচ্ছে একটি ঝাঁঝরের মতো টিস্যু যা কোষ দিয়ে গঠিত। এটি ছিদ্র হিসাবে কাজ করে, ছালের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ টিস্যু এবং বায়ুমণ্ডলের মধ্যে গ্যাসের সরাসরি বিনিময়ের জন্য একটি পথ সরবরাহ করে, নতুবা গ্যাসের পক্ষে দুর্ভেদ্য হত। ল্যানটিসেলের আকার গাছ সনাক্তকরণের জন্য ব্যবহৃত বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে একটি।[১]
গাছের শক্তির চাহিদা পূরণের জন্য চিনি বা শর্করাকে বিশ্লিষ্ট করতে হয়, আর এই কাজ করার জন্যে দরকার হয় অক্সিজেনের। সাধারণভাবে চিনি ফলের ভেতরেই জমা থাকে কিন্তু অক্সিজেন নিতে হয় বাইরে থেকে। এই অক্সিজেন ঢোকার জন্যে ফলের শরীরে থাকে এককপ্রকার রন্ধ্রবা ছিদ্র যার নাম লেন্টিসেল (Lenticel) বা বায়ুরন্ধ্র। শক্তি উৎপাদনের সময় যে উপজাত কার্বন ডাই অক্সাইড ও জলীয় বাষ্প তৈরি হয় সেসব নিষ্কাশনের জন্যেও ব্যবহৃত হয় এই বায়ুরন্ধ্র।
কোনো গাছ থেকে যখন ফলগুলোকে ছিঁড়ে ফেলা হয় তখন সেই ফলকে আমরা জীবিত না কি মৃত বলব তা নিয়ে সমস্যা তৈরি হতে পারে। আর সেই ফলের ভেতরে আছে যে শক্ত কাষ্ঠল বীজ, তাও কি তবে মৃত হিসেবে ধরা হবে, নাকি জীবিত হিসেবে বিবেচিত হবে। যদি বীজ মৃত হয় তবে বীজ থেকে জীবিত গাছের অঙ্কুরোদ্গম হবে কিভাবে!
গাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হলেও আম, আপেল, বরই, নাশপাতি ইত্যাদি মৃত নয়, মৃত নয় তাদের বীজও। তবে ফলের এই রকমের বৃন্তচ্যুত জীবন একটি সীমিত সময় পর্যন্ত স্বাভাবিক থাকে, অর্থাৎ যতদিন গাছের সান্নিধ্য ছাড়া তারা টিকে থাকতে পারে ততদিন পর্যন্ত। আর না টিকে থাকতে না পারলে সেই তাজা ফল আর তাজা থাকে না। পরের প্রশ্নটি হচ্ছে কীভাবে বেঁচে থাকে এসব বৃন্তচ্যুত ফল? আমরা হয়ত জানি, বেঁচে থাকার জন্যে শক্তির প্রয়োজন হয়।
বায়ুরন্ধ্রের গঠন ও বিকাশ
লেন্টিকেলগুলি কাণ্ড ও শিকড়ের উত্থিত বৃত্তাকার, ডিম্বাকৃতি বা প্রসারিত হিসাবে পাওয়া যায়। কাষ্ঠল গাছগুলিতে, ল্যানটিসেলগুলি সাধারণত নতুন শাখায় রুক্ষ, কর্ক জাতীয় কাঠামো হিসাবে দেখা যায়। তাদের নীচে, ছিদ্রযুক্ত টিস্যু কোষগুলির মধ্যে প্রচুর পরিমাণে আন্তঃকোষীয় স্থান তৈরি করে। এই টিস্যু ল্যান্টিসেলটি পূরণ করে এবং ফেলোজেন বা সাবটোমেটাল গ্রাউন্ড টিস্যুতে কোষ বিভাগ থেকে উদ্ভূত হয়। ল্যানটিসেলগুলির বিবর্ণকরণ এছাড়াও ঘটতে পারে, যেমন আমের মধ্যে, এটি কোষের দেয়ালে লিগিনিনের পরিমাণের কারণে হতে পারে।[২]
ফলের মধ্যে লেনটিসেলের সহায়তায় অবিরাম শক্তি উৎপাদন করতে করতে এক পর্যায়ে আম, আপেল বা অন্যান্য ফলের রঙ নষ্ট হতে থাকে, ঘ্রাণ আর স্বাদ অপ্রিয় হতে থাকে, দেহ শুকিয়ে যায়, পচে যায়, অর্থাৎ মরে যায় ফল। কিন্তু আঁটি থাকে তখনো জীবিত। বেশির ভাগ ফলের গায়ে লেন্টিসেল স্পষ্ট দেখা না গেলেও কিছু ফলের গায়ে তা বেশ স্পষ্ট। এমন একটি ফল হল শেব বা আপেল, লাল বা হলুদ আপেল। বায়ুরন্ধ্র নাশপাতির গায়েও দেখা যায় বেশ স্পষ্ট, আর নিত্যিকার আলুর গায়ে যে ফুটকি দাগ দেখা যায় তাও তো লেন্টিসেল-এর কারণেই।
ফলমূলে বায়ুরন্ধ্র
বাংলাদেশে ভারত থেকে কয়েক রকমের আপেল আসে যার মধ্যে দেখা যায় লাল আর হলুদ রঙের দুটি প্রজাতি, রেড ডেলিশিয়াস আর গোল্ডেন ডেলিশিয়াস, যেগুলি স্বাদে-গন্ধে সারা দুনিয়া জুড়ে খ্যাত। বিশ শতকের প্রথম থেকে কাশ্মীর, হিমাচল এবং উত্তর প্রদেশে এগুলোর ফলন শুরু হয়। এই আপেলের গায়ে শাদা বা কালচে রঙের যে ফুটকি দেখা যায় সেগুলোই লেন্টিসেল। এর ভেতর দিয়েই অক্সিজেন ভেতরে প্রবেশ করে, নির্গত হয় কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও পানি। তবে এই ছিদ্রপথ সরাসরি বহির্জগতের সাথে যুক্ত থাকার কারণে এর ভেতর দিয়ে ঢুকে পড়তে পারে ক্ষতিকর ব্যাক্টেরিয়া, ছত্রাক এবং ভাইরাস। যে কারণে ফল কখনো বিবর্ণ-বিস্বাদ হয়ে নষ্ট হতে পারে।
রেফ্রিজারেটর বা ফ্রিজে রাখলে ঠাণ্ডায় রন্ধ্র সঙ্কুচিত হয়ে গ্যাস বিনিময় কম হয়, বিপাক ক্রিয়া স্তিমিত হয়ে যায়, আবার লেন্টিসেলের ভেতর দিয়ে ক্ষতিকর জীবাণুও ঢুকতে পারে কম, তাই ফলও টিকে থাকে বেশিদিন। একটি ফলের ভেতর লেন্টিসেলের ব্যবহার থাকে সীমিত সময়ের জন্যে কিন্তু গাছের কাণ্ডে এবং শেকড়ে তাদের উপস্থিতি থাকে দীর্ঘকালব্যাপী যা গাছের জীবদ্দশার সঙ্গে সম্পৃক্ত। একটি গাছের বাকলের বাইরের দিকটা প্রায়শই থাকে মৃত এবং শোলা-ধর্মী যা জল এবং তাপ নিরোধক। কিন্তু ভেতরের দিকটা থাকে জীবন্ত যার ভেতর দিয়ে চলাচল করে শর্করার মতো কিছু প্রয়োজনীয় পুষ্টি। উপরিভাগে থাকলেও ক্ষুধার্ত প্রাণীরা এই ছাল খেতে পারে না কারণ এখানকার উদ্ভিদকোষগুলির স্বাদ থাকে তিক্ত ও বিষাক্ত। এই বাকলের ভেতর থাকে লেন্টিসেল যা আর কিছু নয় পত্ররন্ধ্রের মতো ছিদ্র বিশেষ, পার্থক্য হচ্ছে এই রন্ধ্রের আকার পত্ররন্ধ্রের মতো নিয়ন্ত্রিত নয়। যাবতীয় প্রাণির মতো গাছেরও জীবন ধারণের জন্যে দরকার হয় অক্সিজেনের। পত্র কাণ্ড শেকড়ে সর্বত্রই চাই অক্সিজেন। এই অক্সিজেন গাছ নিজেই তৈরি করে নিতে পারে সবুজ পাতা থেকে সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে। কিন্তু এই ঘটনা দিনের বেলার, যখন সূর্যরশ্মি থাকে। রাতের বেলা তাদের লেন্টিসেলের মাধ্যমে অক্সিজেন নিতে হয় বাইরে থেকেই।
আমাদের মনে আরেকটি প্রশ্ন আসতে পারে, গাছ যদি নিজেদের জীবিত রাখার জন্য অক্সিজেন ব্যবহার করে ফেলে তবে প্রাণিজগতের জন্যে তারা অক্সিজেন সরবরাহ করে থাকে কি পদ্ধতিতে। এই প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে, গাছ যতোটা অক্সিজেন ব্যবহার করে রাতে, দিনের বেলা তৈরি করে দেয় তার দশগুণ। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বনে এই লেন্টিসেল আরো দেখা যায় ঠেশমূলে এবং শ্বাসমূলে। যখন ১০,০০০ বর্গ কিলোমিটার অঞ্চলে নদীবাহিত পলিমাটির কারণে চর জেগে ওঠে তখন প্রথমেই আস্তানা করে ঠেসমূল সম্বলিত গেওয়া গাছ, বনের মাঝখানে লবণাক্ততা কমে এলে সেখানে জন্ম নেয় সুন্দরী গাছ এবং মিঠা পানিতে থাকে অন্যান্য গাছপালা। গেওয়া গাছের শেকড় যদি জলের উচ্চতার ওপরে থাকে তবে তাতে লেন্টিসেলের পরিমাণ থাকে কম, কিন্তু জলমগ্ন গাছের শেকড়ের উপরিভাগে থাকে প্রচুর লেন্টিসেল। এর ভেতর দিয়ে বায়ু প্রবেশ করে পৌঁছে যায় গাছের সর্বত্র।
সাধারণত শ্বাসমূল দেখা যায় বহু ধরনের গাছেই তার মধ্যে বাইন গাছ অন্যতম। এদের জলমগ্ন শেকড় থেকে সরাসরি ওপরের দিকে মাথা বের করে মোচার আকৃতির শেকড় যার ওপরিভাগ থাকে লেন্টিসেল সমৃদ্ধ। পশ্চিমের দেশগুলিতে বিভিন্ন রকম লেন্টিসেল সমৃদ্ধ গাছগুলিকে অনেক সময় নির্বাচন করা হয় ল্যান্ডস্কেপিং-এর সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্যে। পাতা ঝরে যাবার পর লেন্টিসেলগুলি বেশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে চোখে। ছাত্রদের অনেক সময় নিয়ে যাওয়া হয় পত্রমোচী বৃক্ষের বনে যেখানে শুধু লেন্টিসেল দেখে গাছ সনাক্ত করার একটি মহড়া চলে।[৩]
তথ্যসূত্র
১. Michael G. Andreu; Erin M. Givens; Melissa H. Friedman what the. “How to Identify a Tree”. University of Florida IFAS extension. Archived from the original on 2013-05-14. Retrieved 2013-03-07.
২. Tamjinda, Boonchai (1992). “Anatomy of Lenticels and The Occurrence of Their Discoloration in Mangoes” (PDF). Natural Sciences. 26 (Suppl 5): 57–64.
৩. জায়েদ ফরিদ, “উদ্ভিদজগতে লেন্টিসেল-এর ভূমিকা”, ১৮ অক্টোবর, ২০১৪, এনভায়রণমেন্টমুভ ডট কম, https://environmentmove.com/2014/10/18/উদ্ভিদজগতে-লেন্টিসেল-এর/
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।