ভূমিকা: কেশরাজ বা কালকেশী হচ্ছে একধরনের ঔষধি গুণসম্পন্ন বিরুৎ। এটি স্যাঁতস্যাঁতে স্থান, রাস্তা বা ডোবার পাশে জন্মে। এর সঠিক ব্যবহার না জানায় আগাছা মনে করে অনেকে উপরে ফেলে।
কেশরাজ বা কালকেশী-এর বর্ণনা:
ব্যাপিত বা লম্বভাবে অবস্থিত, প্রচুর শাখা বিন্যাসিত বা বিরলক্ষেত্রে শাখা বিহীন, সর্বাংশে ঘন সন্নিবেশিত বা হালকাভাবে দৃঢ় শক্ত রোমাবৃত, বর্ষজীবী বীরুৎ, কাণ্ড লালচে বা ইট-লাল, ৫-৪৩ সেমি লম্বা, বিরলক্ষেত্রে অনূর্ধ্ব ৬৮ সেমি লম্বা, প্রায়শঃ অধিকতর নিচের পর্বসন্ধি থেকে শিকড় জন্মায়। পত্র উপবৃত্তাকার-বল্লমাকার বা ডিম্বাকারবিডিম্বাকার, অনূর্ধ্ব ৯.৬ X ২.৩ সেমি, অর্ধবৃন্তক, সুক্ষ্মাগ্র বা খবভাবে দীর্ঘাগ্র, নিম্নাংশের দিকে ক্রমান্বয়ে সরু, প্রান্ত অর্ধ-অখন্ড থেকে অখন্ড বা হালকাভাবে দর-কচ, পার্শ্ব শিরা অস্পষ্ট।
পুষ্পবিন্যাস শিরমঞ্জরী, উপগোলাকার, পুষ্পদন্ড ০.৫-৩.০ সেমি লম্বা, মঞ্জরী পত্রাবরণ ৫-৯ x ৪৬ মিমি। মঞ্জরীপত্র ৪.৫-৫.৫ x ২.৩ মিমি, ডিম্বাকার, বিরলক্ষেত্রে বিডিম্বাকার, সূক্ষ্মাগ্র বা খর্বভাবে দীর্ঘাগ্র, সর্বাংশে ঘন সন্নিবেশিত দৃঢ়, শক্ত, রোম দ্বারা আবৃত। প্রান্ত পুষ্পিকা সাদা, মূলীয় নল ০.৪ মিমি লম্বা, শীর্ষ ২-৪ টি ক্ষুদ্র রোম বিশিষ্ট, অণুফলক ২.০-২.৫ মিমি লম্বা, মধ্য পুষ্পিকা সাদা। দলমণ্ডল ২.০-২.৭ মিমি লম্বা। ফল সিপসেলা, । ১.৫-২.০ মিমি লম্বা, চাপা, শীর্ষ হালকাভাবে সূক্ষ্ম রোমশ, বৃতিরোম স্বল্প সংখ্যক অতি ক্ষুদ্র শল্কীয় দন্ত বিশিষ্ট।
ক্রোমোসোম সংখ্যা: ২n = ১৮, ২২ (Fedorov, 1969)।
আবাসস্থল ও বংশ বিস্তার: স্যাতসেঁতে পতিত জমি, পাহাড়ের ঢালু, আবাদী জমি, রাস্তার ধার ও নালা। ফুল ও ফল ধারণ সারা বৎসর জুড়ে। বীজ থেকে চারা জন্মে।
বিস্তৃতি: মধ্য ও উত্তর আমেরিকা, বর্তমানে উষ্ণমণ্ডলীয় দেশসমূহে সর্বজনীনভাবে জন্মে। বাংলাদেশে এটি দেশের সর্বত্র বিদ্যমান।
অর্থনৈতিক ব্যবহার ও গুরুত্ব:
উদ্ভিদটি প্রধানত বলকারক এবং ঈষৎ বিরেচক পদার্থ, যকৃত ও প্লীহা প্রসারিত হলে, বিভিন্ন ক্রমবর্ধমান চমড়ার অসুখে, জন্ডিস এবং জ্বরের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। গোদ রোগের ক্ষেত্রে তাজা উদ্ভিদটি তিলের তেলের সাথে মিশিয়ে প্রযোগ করা হয়। এটি কোষ্ঠবর্ধক হিসেবে বিবেচিত হয় এবং রক্তক্ষরণ ও আমাশয় রোধ করতে ব্যবহৃত হয়। এটি হাঁপানি ও ব্রঙ্কাইটিস নিরাময়ে, বক্ষঃ রোগের ঔষধ হিসেবে এবং হাঁপানি প্রতিরোধেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
বলা হয়ে থাকে যে, উদ্ভিদটি রক্ত পরিষ্কারক এবং এটি শীতলকারী পদার্থ হিসেবেও বিবেচিত হয়ে থাকে। এর প্রয়োগ ন্যাড়া মাথায় চুলের বৃদ্ধি বাড়াতে এবং চুল কাল করতে সাহায্য করে। উদ্ভিদটি বেদনাহর এবং শোষক ও মাথা ব্যথা নিরাময় করে। এর পাতা বৃশ্চিক দংশনে ব্যবহৃত হয়। এর মূল বমনোদ্রেককর ও বিশোধক পদার্থ এবং গবাদি পশুর ঘা ও ক্ষতে বহিঃস্থভাবে ব্যবহৃত হয়।
কেশরাজ বা কালকেশী-এর জাতিতাত্বিক ব্যবহার:
বাংলাদেশে এই উদ্ভিদটি বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠী দ্বারা বিভিন্নভাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। উদাহরণস্বরূপ ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল ও নেত্রকোনা জেলায় গারো ও মান্দি আদিবাসী জনগোষ্ঠী এই উদ্ভিদটি জ্বর, বৃশ্চিক দংশন, চোখের অসুখ ইত্যাদি নিরাময়ে ব্যবহার করে। তারা উদ্ভিদটি চুলের বৃদ্ধিতেও ব্যবহার করে থাকে এবং উদ্ভিদটির ক্বাথ লঙ্কার লেই এর সাথে ৫:২ অনুপাতে মিশিয়ে জ্বরের চিকিৎসায় ব্যবস্থাপত্র দেয়া হয়।
উদ্ভিদটির তাজা রস তারা বৃশ্চিক দংশনে এবং তাজা পাতার রস সাধারণ লবণের সাথে ২৪:১ অনুপাতে মিশিয়ে চোখের অসুখের চিকিৎসায় ড্রপ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তারা পাতার কাথ কোষ্ঠ পরিষ্কারক হিসেবে ব্যবস্থাপত্র প্রদান করে এবং ৪-৯টি পাতার লেই Srtychnos nux-vomica এর ৫-১০ সেমি লম্বা কাণ্ডের বাকলের লেই এর সাথে মিশিয়ে ছোট ফোঁড়ার পুঁজ গঠনের জন্য ব্যবহার করে থাকে।
অন্যান্য তথ্য: বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষের ৬ষ্ঠ খণ্ডে (আগস্ট ২০১০) কেশরাজ প্রজাতিটির সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, এদের শীঘ্র কোনো সংকটের কারণ দেখা যায় না এবং বাংলাদেশে এটি আশঙ্কামুক্ত হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশে কেশরাজ সংরক্ষণের জন্য কোনো পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি। প্রজাতিটি সম্পর্কে প্রস্তাব করা হয়েছে যে বিশেষত উদ্ভিদটির বিবিধ ওষধি গুণের জন্য আবাদের আওতায় আনা প্রয়োজন।
তথ্যসূত্র:
১. এ বি এম এনায়েত হোসেন (আগস্ট ২০১০) “অ্যানজিওস্পার্মস ডাইকটিলিডনস” আহমেদ, জিয়া উদ্দিন; হাসান, মো আবুল; বেগম, জেড এন তাহমিদা; খন্দকার মনিরুজ্জামান। বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ (১ সংস্করণ)। ঢাকা: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। খন্ড ৬ষ্ঠ, পৃষ্ঠা ৩২৭-৩২৮। আইএসবিএন 984-30000-0286-0
বি. দ্র: ব্যবহৃত ছবি উইকিমিডিয়া কমন্স থেকে নেওয়া হয়েছে। আলোকচিত্রীর নাম: Dinesh Valke
জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ সম্মান ও এমএ পাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। বিভিন্ন সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রোদ্দুরে ডট কমের সম্পাদক।