মাখনা কাঁটাযুক্ত মিঠা পানির শাপলা পরিবারের একটি জলজ উদ্ভিদ

ভূমিকা: মাখনা বা কাটাঁপদ্ম, মাকানা, কাটাঁমাখনা হচ্ছে শাপলা বা (ইংরেজি: Nymphaeaceae) পরিবারের ইউরালি গণের একটি জলজ বীরুত জাতীয় উদ্ভিদ। Euryale গণে এইটিই একমাত্র প্রজাতি।[১]

মাখনা বা কাটাঁপদ্ম, মাকানা, কাটাঁমাখনা, বৈজ্ঞানিক নাম: Euryale ferox Salisb. in Kon. & Sims., Ann. Bot. 2: 74 (1806). সমনাম: Anneslia spinosa Roxb. ex Andr. (1811), Euryale indica Planch. (1853). সাধারণ নাম: Fox nut, foxnut, gorgon nut, makhana, বাংলা নাম: মাখনা বা কাটাঁপদ্ম, মাকানা, কাটাঁমাখনা, অন্যান্য নাম: makhana in Hindi and Punjabi, thangjing in Meitei, nikori in Assamese, onibasu in Japanese, gasiyeon in Korean জীববৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাস জগৎ/রাজ্য: Plantae বিভাগ: Angiosperms বর্গ: Nymphaeales পরিবার: Nymphaeaceae গণ: Euryale প্রজাতি: Euryale ferox Salisb.

মাখনা গাছের পরিচিতি

মাখনা কাটাঁযুক্ত শালুকের মতো উদ্ভিদ যার শিকড় ও কন্দ পানির নিচে মাটিতে সন্নিবিষ্ট থাকে। পাতা প্রায় গোলাকার, পানির উপরে ভেসে থাকে। মাখনার কাটাঁযুক্ত পাতার উপরের রং সবুজ। আমাজন লিলির পর এটির পাতা দ্বিতীয় বৃহৎ। কাটাঁ আছে ডাটার সাথেও। এদের ফুল গোলাপি, আকারে শাপলার চেয়ে ছোট। ফুল ফোটে শীতের শেষে, মার্চ থেকে নভেম্বরের মধ্যে। কাঁটাভরা ফলে অনেকগুলো বীজ এবং বীজগুলো খাবার যোগ্য। ফুলগুলো ১-২ ইঞ্চি লম্বা, ভিতের উজ্জ্বল লাল রং, বাইরের দিকে সবুজ ও উজ্জ্বল বেগুনি রংয়ের। ফল গোলাকার বা ডিম্বাকৃতির। প্রতিটি ফলে ২০ টি পর্যন্ত বীজ থাকে। বীজ দেখতে মটরের মত।[২]

মাখনার ফল কচি এবং পক্ক উভয় অবস্থাতেই খাওয়া যায়। এই ফলের বাইরের অংশ কাঁটাযুক্ত। ভিতের ফল ছোলার দানার মত। স্বাদও কাঁচা ছোলার স্বাদের। ফুলের পাপড়ি ঝরে গেলে থেকে যায় কাপ আকৃতির ফল। এর ভেতরে ছোট ছোট বিচি থাকে; খোসা ছাড়িয়ে পাওয়া মিষ্টি স্বাদের এই মাখনা।

মাখনা গাছের বিবরণ

মাখনার পাতা আলোকচিত্র: Jerzy Opioła

ঘন কন্টক যুক্ত বহুবর্ষজীবী বীরুৎ, মোটা মূলাকার কান্ডবিশিষ্ট। পাতা ভাসমান, বর্তুলাকার, ৩০-১২০ সেমি। ব্যাসবিশিষ্ট, একনজরে প্রায় বৃত্তাকার, উপরের পৃষ্ঠ সবুজ এবং শিরা বরাবর দুর্বল কন্টকবিশিষ্ট, কুঁচকানো, নিচের পৃষ্ঠ লাল বা বেগুনি এবং উত্তোলিত শিরা বরাবর শক্ত কন্টক বর্তমান। পুষ্প গর্ভশীর্ষ, ৩-৫ সেমি লম্বা, আংশিক নিমজ্জিত। বৃত্যংশ সংখ্যায় ৪টি, ২-৩ সেমি লম্বা, গর্ভপত্রের উপরে পুষ্পধারের প্রান্তে সন্নিবেশিত, সবুজ এবং বাইরের পৃষ্ঠ কন্টকিত, ভেতরের গাত্র মসৃণ, উপরিপন্ন। পাপড়ি অসংখ্য, ১-২ x ০.২-০.৭ সেমি, ৬টি শ্ৰেণীতে সজ্জিত, বাইরের শ্রেণী বেগুনি, মাঝের শ্রেণী বেগুনি সাদা এবং ভেতরের শ্রেণী কমবেশী সাদা। পুংকেশর অসংখ্য, ৫ মিমি (প্রায়) লম্বা, ৪-৬টি চক্রে সজ্জিত, তোড়া আকারে গুচ্ছিত, পুংদন্ডগুলো রৈখিক। গর্ভাশয় ৫ থেকে অনেক প্রকোষ্ঠবিশিষ্ট, পুষ্পধারের বিস্তৃত অগ্রভাগে নিমজ্জিত, গর্ভমুণ্ড চাকতি আকৃতির, অবতল, ডিম্বক অনেক, প্রাচীরগাত্রীয় অমরাবিন্যাসে। ফল স্পঞ্জতুল্য বেরী, ৬-১০ x ১০-১২ সেমি, নিরেট ডিম্বাকৃতি মোচাকৃতি, স্থায়ী বৃতি কর্তৃক মুকুটাকার এবং শক্ত কন্টকাবৃত। বীজ অনেক, শাঁসালো বীজোপাঙ্গোবিশিষ্ট, ৭ X ৪ মিমি (প্রায়), নিরেট ডিম্বাকার-উপলোকার, বীজতৃক অসমতল পৃষ্ঠবিশিষ্ট। ফুল ও ফল ধারণ ঘটে  মার্চ থেকে নভেম্বর মাসে। (Khan and Halim, 1979).

ক্রোমোসোম সংখ্যা:

2n = ৫৮ (Fedorov, 1969).

মাখনার চাষাবাদ ও আবাসস্থল

মিঠা পানির জলাধার, ঝিল এবং হাওড়। বিস্তৃতি ও কাষ্মির থেকে পূর্বদিকে আসাম, চীন, জাপান, তাইওয়ান, কোরিয়া এবং রাশিয়ার উশুরি পর্যন্ত বিস্তৃত।[১] আমাদের দেশি গাছ হওয়া সত্ত্বেও আমাদের দেশে এর তেমন কদর নেই। চীন, জাপান, বার্মা, কোরিয়া ভারতেও জন্মে এ জলজ উদ্ভিদ, চাষ ও করা হয় মাখনা। চীনে ৩০০০ বছর যাবৎ মাখনা চাষের রেকর্ড আছে।[২] বংশ বিস্তার হয় বীজ এবং রাইজোমের মাধ্যমে।

মাখনা পানিতে জন্মে, বিশেষভাবে উন্মুক্ত জলাভূমি বা বিলে। শাপলা, শালুক, পদ্ম, কিম্বা চাঁদমালার সাথে মিলেমিশে জন্মাতে পারে। এগুলো শহরে দূর্লভ হলেও গ্রামে গেলে পুকুর, খাল, বিলে এখনো দেখতে পাওয়া এই মাখনা। মাখনা আমাদের দেশে সিলেট ও কিশোরগঞ্জ এর বিল, ঝিলে পাওয়া যায়। পাওয়া যায় মৌলভিবাজার ও নওগার কিছু এলাকায়ও।

ব্যবহার:

মাখনার ফল

মূলত বীজ খাওয়া হয়। বীজে প্রচুর পরিমান কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, মিনারেল আছে। বীজের ক্যালোরিক ভ্যালু বেশি (৩.৬২ কিলোক্যালোরি/গ্রাম)।[২] বীজ পুষ্টিকর, টনিক, কোষ্ঠবদ্ধতাকারী এবং কাশির মাধ্যমে শ্লেষা নির্গতকারী। পুষ্প পুরুষের যৌন শক্তি বর্ধক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ইহার বীজে শর্করা, প্রোটিন, ভিটামিন এবং খনিজ লবণ বিদ্যমান (Ghani, 2003). ভারতের উত্তর বিহারে উদ্ভিদটি ব্যাপকভাবে চাষ করা হয়। বীজের শর্করা সহজে পরিপাক হয় এবং বৃদ্ধদের জন্য খুবই উপযোগী। জাতিতাত্বিক ব্যবহার হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, মাখনা বীজের ভেতরের সাদা উপাদান শিশুরা খুব পছন্দ করে বলে স্থানিয় বাজারে (বিশেষ করে পুরনো ঢাকায়) মাখনা বিক্রি হয়ে থাকে ।রাইজোম, কচি বৃন্ত এবং কচি পাতাও খাওয়া হয়ে থাকে (Begum, 1987).[১] আমাদের সবার প্রিয় ফুচকাতে এই মাখনা ব্যবহার হয়। মাখনার ব্যবহারে ফুচকা ভাল ফোলে ও মচমচে হয়। সুস্বাদু খেতে মাখনার মধ্যে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে আয়রন ও ফসফরাস। মাখনার বীজ ডায়রিয়া, ব্যাথা, কিডনির সমস্যা, লিউকোরিয়া সহ বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। এদের এ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও কার্ডিওপ্রটেকটিভ এ্যাকটিভিটি বৈঙ্গানিকভাবে প্রমাণিত। মাখনা ফল ও বীজ দিয়ে বিভিন্ন ধরণের মুখরোচক খাবার তৈরি হয়। বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় দেখা যায় যে সমস্ত গাছের ফুল, ফল বা পাতা কাঁটা প্রযুক্ত বা রোমশ হয়, তারা সাধারণত অত্যন্ত সুস্বাদু /সুমিষ্ট হয় ও ভেতরে কোমল হয়ে থাকে![২]

অন্যান্য তথ্য:

বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষের ৯ম খণ্ডে (আগস্ট ২০১০) মাখনা প্রজাতিটির সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, এদের সংকটের কারণ মাত্রাতিরিক্ত আহরণ এবং আবাসস্থল ধ্বংস এবং বাংলাদেশে এটির সংরক্ষণ ও বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে তথ্য সংগৃহিত হয়নি (NE), কিন্তু বিরল  প্রতীয়মান। বাংলাদেশে মাখনা সংরক্ষণের জন্য কোনো পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি। প্রজাতিটি সম্পর্কে প্রস্তাব করা হয়েছে যে এই প্রজাতিটির শর্করা সমৃদ্ধ ভক্ষনীয় বীজের জন্য জনসাধারণকে ইহা চাষাবাদে উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে।

তথ্যসূত্র:

১. এম এ হাসান (আগস্ট ২০১০)। “অ্যানজিওস্পার্মস ডাইকটিলিডনস”  আহমেদ, জিয়া উদ্দিন; হাসান, মো আবুল; বেগম, জেড এন তাহমিদা; খন্দকার মনিরুজ্জামান। বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ (১ সংস্করণ)। ঢাকা: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। পৃষ্ঠা ৩২১। আইএসবিএন 984-30000-0286-0

২. দ্বিজেন শর্মা, ফুলগুলি যেন কথা, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ডিসেম্বর ২০০৩, পৃষ্ঠা-৯৮।

আরো পড়ুন:  কাউফল বাংলাদেশের অপ্রচলিত এবং এশিয়ার চিরসবুজ ফলদায়ী বৃক্ষ

Leave a Comment

error: Content is protected !!