পানমৌরি এশিয়া জন্মানো জনপ্রিয় ভেষজ গুণসম্পন্ন মশলা

পানমৌরি

বৈজ্ঞানিক নাম: Foeniculum vulgare Miller, Gard. Dict. ed. S, no. 1 (1768). সমনাম: Anetun foeniculum L. (1753), Foeniculum capillaceum Galib. (1782), Foeniculum officinale Allioni (1785). ইংরেজি নাম: Fennel. স্থানীয় নাম: পানমৌরী।

পানমৌরি-এর বর্ণনা:

বৃহদাকার, সতেজ, বহুবর্ষজীবী, মসৃণ, চকচকে, গন্ধযুক্ত বীরুৎ, অনূর্ধ্ব ২ মিটার লম্বা। কাণ্ড খাড়া, প্রস্থেচ্ছেদে গোলাকার, লম্বভাবে সরেখ, প্রচুর শাখাবিশিষ্ট, পুরানো পর্বমধ্য ফাপা। পত্র একান্তর, বহুযৌগিক, আবরণযুক্ত, নিম্নাংশের পত্রসমূহ বৃহত্তর, পত্র আবরণ নিম্নাংশে কাণ্ড অন্তর্ভূক্ত করে একটি উন্মুক্ত বেলনাকার অঙ্গ তৈরী করে, ২-১৫ সেমি লম্বা, প্রান্ত সাদা শুষ্ক ঝিল্লিসদৃশ, পত্রবৃন্ত প্রস্থচ্ছেদে উপ-গোলাকার, আবরণকৃত অংশের তুলনায় অনূর্ধ্ব ১০ সেমি বৃহত্তর, লম্বভাবে সরেখ, ফলক প্রান্ত ত্রিকোণাকৃতি, ৩০ X ৫০ সেমি, ২-৬ পক্ষভাবে খন্ডিত হয়ে সূত্রাকার, সূক্ষ্মাগ্র, নীল-সবুজ খণ্ডে পরিণত হয়, খন্ড সমূহ ১-১৪ সেমি লম্বা, মুখ্য পক্ষ বিজোড় সংখ্যক, ৩-১৯টি।

পুষ্পবিন্যাস প্রান্তীয় যৌগিক ছত্রমঞ্জরী, পুষ্পদণ্ড অনুর্ধ্ব ১৬ (বিরলক্ষেত্রে অনূর্ব ২ সেমি) লম্বা, মুখ্য রে প্রতি ছত্রমঞ্জরীতে ৫-৩০ (অনূর্ধ্ব ৭০) টি, ০.৫-১২ সেমি লম্বা, দৈর্ঘ্য অসমান, খর্বতমগুলি কেন্দ্রে অবস্থিত, গৌণ রে (পুষ্পবৃন্তিকা) প্রতি ক্ষুদ্র ছত্রমঞ্জরীতে ১০-৩০টি, অনূর্ধ্ব ১ সেমি লম্বা, দৈর্ঘ্যে অসমান, মঞ্জরী পত্রাবরণ ও অনুমঞ্জরী পত্রাবরণ অনুপস্থিত। বৃতি গর্ভাশয়ের উপরে লুপ্তপ্রায়। দলসমূহ ৫টি, স্পষ্ট, প্রান্ত উপডিম্বাকর, ১.৫ x ১.০ মিমি, স্পষ্টতঃ অধোমুখী খাজকৃত শীর্ষবিশিষ্ট, হলুদ। পুংকেশর ৫টি, প্রায় ১.৫ মিমি লম্বা। গর্ভকেশর ১টি, গর্ভাশয় অধোমুখী, দ্বি-কোষ্ঠীয়, গর্ভদণ্ড ২টি, প্রতিটি নিম্নাংশে একটি গর্ভদন্ডপদ ও উপরে একটি গর্ভমুণ্ড বিশিষ্ট।

ফল ডিম্বাকার-বেলনাকার, সাধারণত ঈষৎ বক্র ভেদক ফল, ৩.০-৮.৫ x ২.০-২.৫ মিমি, হালকা সবুজ থেকে হলুদ-বাদামি, পূর্ণতা প্রাপ্তির পর দুইটি ফলাংশকে বিভক্ত হয়, প্রতি ফলাংশক ৫টি শিরা ও শিরা। মধ্যবর্তী স্থানে অয়েল-ভিটা বিশিষ্ট। বীজ ফলক লগ্ন বীজ বহিস্তৃক বিশিষ্ট।

ক্রোমোসোম সংখ্যা: ২n = ২২ (Fedorov, 1969)

চাষাবাদ:

বাড়ীর বাগান অনেকেই লাগিয়ে থাকে। এটা চাষ করা যায়। ধনিয়ার মতো যত্ন নিয়ে চাষ করলে ভালো ফলন পাওয়া যায়। ফুল ও ফল ধারণ নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস। যদিও মূল বা মুকুট বিভাজনের মাধ্যমে বংশ বিস্তার সম্ভব এরপরও সাধারণত বীজ দ্বারা বংশ বিস্তার হয়। ইন-ভিটু কালচারের মাধ্যমেও বংশ বিস্তার সম্ভব।

আরো পড়ুন:  কাঁচা মরিচ বা কাঁচা লঙ্কার খাওয়ার গুণাগুণ ও অপকারিতা

পানমৌরি-এর বিস্তৃতি:

ফ্যানেল (পান-মৌরী) যথাসম্ভব দক্ষিণ ইউরোপ এবং ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল থেকে উদ্ভূত। এখন ইহা বিশ্বের সর্বত্র চাষ করা হয় এবং বহু স্থানের প্রকৃতিগত। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সর্বত্র এবং পূর্ব জাভার পর্বত সমূহে ইহা প্রায় স্বতস্ফূর্তভাবে জন্মানো হয়। বাংলাদেশে ইহা নোয়াখালী, জামালপুর, কুড়িগ্রাম ও পঞ্চগড় জেলায় চাষ করা হয়।

অর্থনৈতিক ব্যবহার ও গুরুত্ব:

কচি পাতা ও ফল খাবারের সুগন্ধিকারক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। পাতা কাচা খাওয়া হয় এবং বেশীরভাগ ক্ষেত্রে রান্না করা হয়। পাতা মাছের ঝোলের রুচি বর্ধনের জন্য পটহার্ব হিসেবে ব্যবহার করা হয়। উদ্ভিদের সকল অংশে সুগন্ধি এসেন্সিয়াল। অয়েলের উপস্থিতির কারণে ইহা সুগন্ধকারক রূপে। বিশেষতঃ সাবান, ক্রীম লোশন এবং বিলাসবহুল। পারফিউম এর মতো ডিটারজেন্ট ও প্রসাধনীতে ব্যবহার করা হয়। এসেন্সিয়াল অয়েল নিষ্কাশনের পরে উপজাত হিসেবে প্রাপ্ত ফলের অবশিষ্টাংশ গোখাদ্য হিসেবে খাওয়ান যেতে পারে।

ফল ব্যাপকভাবে কর্মশক্তিদায়ক, পাকস্থলীর উপকার সাধক ঔষধ, কফ নিঃসারক ঔষধ বিশেষ, বায়ুরোগহর ঔষধ এবং বহু ফ্যারম্যাকোপিইআয় (ঔষধ। প্রস্তুত করার প্রণালী সম্বন্ধে নির্দেশ সংবলিত পুস্তক) ব্যবহৃত হয়। চীনা ভেষজ ঔষধে ফ্যানেল (পান-মৌরী) পাকাশয় ও অন্ত্রের প্রদাহ, হার্নিয়া, অজীর্ণ এবং উদর সম্পর্কিত ব্যথার প্রতিষেধক হিসেবে, শ্লেষ্মর উপশম এবং দুগ্ধ নিঃস্বরন এর উদ্দীপক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আধুনিক পশ্চিমা ঔষধে পান-মৌরী ও পান-মৌরী তেল বায়ুরোগে প্রয়োগ করা হয় বা মৃদু বিরেচক এ সুগন্ধিকারক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। জার্মানীতে পান-মৌরী হজম ক্রিয়ার গোলযোগ রোধে, পাকাশয় ও অন্ত্রের প্রদাহ প্রতিসংকোচক, শ্লেষ্মার উপশম ও শিশুদের কফ নিরাময়ে ভেষজ ঔষধ হিসেবে ব্যবহার করা হয় (de Gazan and Siemonsma, 1999)

আরো পড়ুন: মৌরি দানার ১০টি ভেষজ গুণ ও অন্যান্য ব্যবহার

জাতিতাত্ত্বিক ব্যবহার:

জাভায় পান-মৌরী লালাব হিসেবে খাওয়া হয় এবং আমার সুগন্ধি করার জন্য ব্যবহার করা হয়। মজাদার স্বাদের জন্য কাণ্ডের টুকরা চর্বন করা হয়। ইন্দোনেশিয়ায় সনাতন ভাবে ঔষধে গ্রহনযোগ্য সুগন্ধ তৈরীর জন্য Alyxia প্রজাতির বাকলের সাথে পান-মৌরী ফল ব্যবহার করা হয়। ভারতে চোখের জ্যোতি বনের জন্য ফলের রস প্রয়োগ করা হয় এবং ফলের গরম দ্রবনীয়। আরক দুর্থ নিঃস্বরণ ও ঘাম প্রক্রিয়ার উদ্দীপক রূপে ব্যবহার করা হয় (de GuZman and Siemons]al, 1999)

আরো পড়ুন:  দারুচিনি বা দারচিনি খাওয়ার নানা ভেষজ উপকারিতা

অন্যান্য তথ্য: বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষের  ৬ষ্ঠ খণ্ডে (আগস্ট ২০১০) পানমৌরি প্রজাতিটির সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, এদের শীঘ্র কোনো সংকটের কারণ দেখা যায় না এবং বাংলাদেশে এটি আশঙ্কামুক্ত হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশে পানমৌরি সংরক্ষণের জন্য কোনো পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি। প্রজাতিটি সম্পর্কে প্রস্তাব করা হয়েছে যে এই প্রজাতিটির বর্তমানে সংরক্ষণের প্রয়োজন নেই। 

তথ্যসূত্র:

১. এম আমান উল্লাহ (আগস্ট ২০১০) “অ্যানজিওস্পার্মস ডাইকটিলিডনস” আহমেদ, জিয়া উদ্দিন; হাসান, মো আবুল; বেগম, জেড এন তাহমিদা; খন্দকার মনিরুজ্জামান। বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ (১ সংস্করণ)। ঢাকা: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। খন্ড ৬ষ্ঠ, পৃষ্ঠা ১৭৪-১৭৫। আইএসবিএন 984-30000-0286-0

বি. দ্র: ব্যবহৃত ছবি উইকিপিডিয়া কমন্স থেকে নেওয়া হয়েছে। আলোকচিত্রীর নাম: Parvathisri

Leave a Comment

error: Content is protected !!