ভূমিকা: হাতিশুঁড় (বৈজ্ঞানিক নাম: Heliotropium indicum ইংরেজি: Indian heliotrope, Indian Turnsole) বোরাগিনাসি পরিবারের হেলিওট্রপিয়াম গণের সোজা বিরুত। এটি বাড়িতে বা বাগানে লাগানো হয় না এবং আগাছা হিসেবে যত্রতত্র জন্মায়।
বর্ণনা: ঋজু, খররোমাবৃত, অর্ধসরস বর্ষজীবী বীরুৎ, প্রায় ৬০ সেমি উঁচু। কান্ড দৃঢ়, নিম্নাংশ কাষ্ঠল, ঘন খররোমশ, শাখা আরোহী। পত্র সরল, মূলীয় অংশে প্রতিমুখ, উপরের দিকে অর্ধপ্রতিমুখ থেকে একান্তর, দৈর্ঘ্য ৪.৫-৮.০ ও প্রস্থ ২.৫-৫.৫ সেমি। দেখতে গাঢ় সবুজ, ডিম্বাকার থেকে ডিম্বাকৃতি-দীর্ঘায়ত, সূক্ষ্মাগ্র, প্রান্ত তরঙ্গিত, মূলীয় অংশ হৃৎপিন্ডাকার বা ক্রমান্বয়ে সূক্ষ্ম, পৃষ্ঠীয় তল ঘন রোমশ এবং অঙ্কীয় তল রোমশ, বৃন্ত ৩-৮ সেমি লম্বা, পক্ষল, সবুজ।
পুষ্পবিন্যাস ৫-১৫ সেমি লম্বা, বক্র, শীর্ষীয় বা শীর্ষের নিচে জন্মে, বৃশ্চিকাকার স্পাইক, একপার্শ্বীয়, নিচের পুষ্প প্রথমে প্রস্ফুটিত হয়। পুষ্প সাদা বা মলিন বেগুনি-নীল, অবৃন্তক, ঘন সন্নিবিষ্ট। বৃতি ২ মিমি লম্বা, বৃত্যংশ ৫টি, অসম, রৈখিক বা ভল্লাকার, বহির্ভাগ রোমশ। দলমন্ডল নালিকাকার, প্রায় ৫ মিমি লম্বা, ফিকে নীল থেকে প্রায় সাদা, নিচের দিকটা নালীকাকার, নালী ৩ মিমি লম্বা, বহির্ভাগ রোমশ, পাপড়ি ৫ টি, খাটো, গোলাকার দীর্ঘায়ত, ব্যাস ৩.০ থেকে ৩.৫ মিমি।
পুংকেশর ৫ টি, দলনালীর মধ্যাংশে সন্নিবিষ্ট, পুংদন্ড অতিশয় ছোট, পারগধানী ডিম্বাকার। গর্ভাশয় মসৃণ, গর্ভদন্ড খাটো, গর্ভমুন্ড কোণাকৃতি, রোমশ। ফল ৪-৫ মিমি লম্বা ও ২ টি ডিম্বাকার, গভীর খন্ডিত ও ঠোঁট যুক্ত নাটলেটের সমন্বয়ে গঠিত। প্রতিটি খন্ড চাপা, ৪ টি স্থুল খাঁজ বিশিষ্ট। ফুল ও ফল ধারণ প্রায় সারা বর্ষব্যাপী।
ক্রোমোসোম সংখ্যা: 2n = ২২, ২৪, ৬৪ (Kumar and | Subramaniam, 1986),
আবাসস্থল: উন্মুক্ত পতিত জমি, বালুকাময় নদীতট, খাল, নর্দমা, ডোবা ইত্যাদির পাশ্ববর্তী জায়গা, জলাশয়ের তীরবর্তী স্থান, পথপার্শ্ব, গ্রামের ঝোপ এবং ধানক্ষেত। বংশ বিস্তার হয় বীজ দ্বারা।
বিস্তৃতি: আমেরিকার উষ্ণাঞ্চল এই প্রজাতির আদিনিবাস। বর্তমানে বিশ্বে সব উষ্ণমন্ডল ব্যাপক বিস্তৃত। বাংলাদেশের সর্বত্র জন্মে।
অর্থনৈতিক ব্যবহার ও গুরত্বের: বাংলাদেশে এটি সাধারণ আগাছারূপে চিহ্নিত হলেও বিভিন্ন দিক থেকে এদের ভেষজগুণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এতে আছে পাইরো লিজিডিন, র্যাপোনন ও লুপেল (Cliulil, 2003)। শক্ত অবস্থাকে কোমল করতে মুত্র বর্ধক রূপে এই উদ্ভিদের ব্যবহার প্রচলিত। পাতার নির্যাস নেত্র পীড়ায় উপকারী, ক্ষত, আহত স্থান, মাঢ়ীতে উদগত ফোড়া, চর্মপীড়া ইত্যাদি। নিরাময়ে এই উদ্ভিদের ব্যবহার গুরত্বপূর্ণ। পাতা ও তরুণ বিটপের কাথ বাতরোগ, দাদ, প্রমেহ, গলবিল ও টনসিলের প্রদাহে ব্যবহার করা হয়। মূলে আব সৃষ্টিকারী নেমাটোড, মরিচা রোগ সৃষ্টিকারী ছত্রাক, পাতার দাগ সৃষ্টিকারী ছত্রাক এবং পাতা নেতিয়ে পড়া রোগ সৃষ্টিকারী ছত্রাক এই উদ্ভিদে বসবাস করে। (Pancho and Obein, 1983)
জাতিতাত্বিক ব্যবহার: বাংলাদেশের গ্রামের অধিবাসীরা ফুলের রস চোখ পরিষ্কারের জন্য ব্যবহার করে এবং পাতা লেই তৈরী করে রক্ত পড়া রোধ করতে কাটা জায়গায় প্রলেপ দেয়। পাতার ক্বাথ ইন্দোনেশিয়ায় শিশুদের মুখ ও গলার ক্ষত নিরাময়ে ব্যবহৃত হয়। ফিলিপাইনে মূল রজ:স্রাব বৃদ্ধির জন্য ব্যবহারের প্রচলন আছে, পাতা পানিতে ভিজিয়ে সেই পানি দ্বারা শত ও ঘা পরিষ্কার করা হয়। থাইল্যান্ডে বিটপের উপরের অংশের ক্বাথ জ্বর ও ফুলা নিরাময়ে এবং মূল নেত্র পূড়ায় ব্যবহার করা হয় (de Padua et al., 1999) । ভারতে পাতা কীট পতঙ্গের হুল ফোটানা ও সরীসৃপের থাবা জণিত যন্ত্রনা উপশমে ব্যবহার করা হয় (Chopra et al., 1956)। রাতকানা রোগে মূল্য উপকারী (Ghani, 2003)।
অন্যান্য তথ্যঃ বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষের ৮ম খণ্ডে (আগস্ট ২০১০) হাতিশুঁড় প্রজাতিটির সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, এদের শীঘ্র কোনো সংকটের কারণ দেখা যায় না এবং বাংলাদেশে এটি আশঙ্কামুক্ত হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশে হাতিশুঁড় সংরক্ষণের জন্য কোনো পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি। প্রজাতিটি সম্পর্কে প্রস্তাব করা হয়েছে যে এই প্রজাতিটির বর্তমানে সংরক্ষণের প্রয়োজন নেই।[১]
আলোকচিত্রের ইতিহাস: ব্যবহৃত ছবি উইকিমিডিয়া কমন্স থেকে নেওয়া হয়েছে। আলোকচিত্রীর নাম: Dinesh Valke
তথ্যসূত্র
১. বি এম রিজিয়া খাতুন (আগস্ট ২০১০)। “অ্যানজিওস্পার্মস ডাইকটিলিডনস” আহমেদ, জিয়া উদ্দিন; হাসান, মো আবুল; বেগম, জেড এন তাহমিদা; খন্দকার মনিরুজ্জামান। বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ ৭ (১ সংস্করণ)। ঢাকা: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। পৃষ্ঠা ৪৭-৪৮। আইএসবিএন 984-30000-0286-0
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।