পাথরকুচি বা ( বৈজ্ঞানিক নাম: Bryophyllum pinnatum) হচ্ছে ক্রাসুলাসি পরিবারের ব্রায়োফাইলাম গণের একটি ঋজু, বহুবর্ষজীবী রসালো বিরুত। পাথরকুচি ছাড়াও এটি বিভিন্ন নামে পরিচিত; যেমন – পাষানভেদী, শিলাভেদ, অশ্মঘ্ন, কোপ্পাতা, শ্বেতা, গাত্রচুরি, কফপাতা ইত্যাদি।
ভারতীয় উপমহাদেশের নাতিশীতোষ্ণ ও উষ্ণ অঞ্চলে পাথরকুচি একসময়ে ছিল অতিসহজলভ্য একটি অমূল্য ভেষজ। আজকাল এটির ভিনদেশীয় নানা প্রজাতিকে আমরা টবে সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখি। এদিকে আসল পাথরকুচি গাছকে সমূলে ধ্বংস করে দিতে আমাদের এতটুকু হাত কাঁপে না। অথচ, অসাধারণ ভেষজগুণের পাশাপাশি সমগ্র গাছ, বিশেষ করে পাথরকুচির ফুলও অত্যন্ত নয়নাভিরাম।
হাত-চেটোর মতো পুরু পুরু শাঁসালো মসৃন পাতা, পাতার ধারগুলো খাঁজকাটা, শিরা একটু লালচে। কান্ড গোলাকৃতি নরম। বহুবর্ষজীবী ঝোপাকৃতি গাছের উচ্চতা ৩-৪ ফুট। শীতকালে ফিকে লাল-গোলাপী রঙের ফুল ফোটে। পূষ্পমঞ্জরী দেখতে অনেকটা আগেকার দিনের কার্বাইড গ্যাসের ঝাড়-বাতির মতো, ফুলগুলো নিচেরদিকে মুখ করে ঝুলে থাকে।
এই গণের (Genus) কয়েকটি প্রজাতি বর্তমানে এখানে পাওয়া যায়। ভারতের উষ্ণ অথবা নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে এটি জন্মে। তবে দেখা যায় কাঁকুরে মাটিতে গাছগুলি ভাল হয়। এর সংস্কৃত নাম পাষাণভেদ, বাংলায় প্রচলিত নাম কফপাতা ও হিন্দীতে জ্যাকমহায়াৎ নামে পরিচিত। বোটানিক্যাল নাম Kalanchoe pinnata Pers. পরিবারের নাম Crassulaceae. ব্যবহার্য অংশ— পাতা।
গুণাগুণ:
লাল পাথরকুচি পাতার রসে তিক্ত, পিচ্ছিল, কোমলতাকারক, ক্ষতনিবারক ও কীটনাশক। পাতার রস চা-চামচের দু’ চামচ ও তার সঙ্গে এক চা-চামচ পরিমাণ ঘি মিশিয়ে খেলে আমাশায় রোগের উপশম হয়ে থাকে। তাছাড়া এই রস ঘি ও রসুন সহযোগে খেলে কাসরোগের প্রশমন হয়। বাহ্য প্রয়োগার্থ ব্রণ ও ক্ষতে, মাংসপেশী থেতলে গেলে ও বিষাক্ত কীটাদির বিষনাশে পাতা আগুনে ঈষৎ গরম করে লাগালে উপকার পাওয়া যায়। এছাড়া দেহের কোন স্থানে কাটা গেলে তজ্জনিত ব্যথা-বেদনায় ও ফলায় উক্ত পাতার সেঁক ফলদায়ক। হাড় ভেঙ্গে গেলে পাতা বেটে তথায়, ব্রণস্থানে ও দূষিত ক্ষতে বেধে দিলেও সুফল পাওয়া যায়। কোন কোন প্রদেশে চোখের যন্ত্রণায়ও এর বাহ্য প্রয়োগ দেখা যায়।
লাল পাথরকুচি-এর ভেষজ উপকারিতা:
১. মেহ রোগে: যদি মধুমেহ ও প্রমেহ না হয়ে থাকে তবে পাষাণভেদ পাতার রস এবেলা ওবেলা এক চা-চামচ করে খেয়ে দেখুন, ৫-৭ দিনের মধ্যেই বিশেষ উপশম হবে।
২. সদিতে: যে সর্দি পুরনো হয়ে গিয়েছে, সেই ক্ষেত্রেই এটি বিশেষ উপযোগী। নিঃসঙ্কোচে বলা যায়, সর্দি মানে কফ, ঠাণ্ডা লেগে শ্লেষ্ম। কফবিকারে (পুরাতন) পাথরকুচি পাতা রস করে সেটাকে একটু গরম করতে হবে এবং গরম অবস্থায় তার সঙ্গে একটু, সোহাগার খৈ মেশাতে হবে (৩ চা-চামচ রস হ’লে অন্ততঃ ২৫০ মিলিগ্রাম) তা থেকে ২ চা-চামচ নিয়ে সকালে ও বিকালে ২ বার খেতে হবে, এর দ্বারা পুরনো সর্দিটা উঠে যাবে, শুধু তাই নয়, সর্বদা কাসির হাত থেকে বাঁচা যাবে।
৩. মূত্র রোধে: সে যে কোন বয়সেই হোক আর যেকোন আকস্মিক কারণেই হোক, পাথরকুচি পাতার রস ২ চা-চামচ আধ কাপ ঈষদুষ্ণ জলে মিশিয়ে সকালের দিকে একবার এবং বিকালের দিকে একবার খেতে দিতে হবে। শিশুদের হ’লে ১৫ থেকে ৩০ ফোঁটা ২-৩ চা-চামচ জলে মিশিয়ে দিতে হবে এবং দেওয়ার পূর্বে রসটা গরম করে নিতে হবে।
৪. রক্তপিত্তে: এ রোগ দেখা দিলেই দু’বেলা এক চা-চামচ করে পাথরকুচি পাতার রস দিন দুই খাওয়ালেই ওটা ধীরে ধীরে কমে যাবে, তবে এ রোগ একেবারে বন্ধ করতে নেই।
৫. পেট ফাঁপায়: পেটটা ফুলে গিয়েছে, প্রস্রাব আটকে যাচ্ছে, অধোবায়ু, স’রছে না, সেই ক্ষেত্রে একটু চিনির সঙ্গে এক বা ২ চা-চামচ রস সিকি কাপ জলের সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়াতে হয়, তবে রস একটু গরম করে নিতে হয়। এর দ্বারা মাত্র সরল হবে, অধোবায়ুরও নিঃসরণ হবে, ফাঁপাটাও কমে যাবে।
৬. শিশুদের পেট ব্যথায়: অন্ততঃ দেড়-দুই বৎসরের শিশুও স্পষ্ট বলতে পারে না তার কি হচ্ছে, চিকিৎসক অথবা বাড়ির অভিভাবককে অনুমান করে নিতে হয়, শুধু তাই নয়, কোথায় হাত দিচ্ছে সেটাও লক্ষ্য করতে হয়। যাহোক, যদি অনুমান করা যায় যে পেটে ব্যথা হচ্ছে, এই অবস্থায় শিশুকে পাতার রস ৩০-৬০ ফোঁটা পর্যন্ত দেওয়া যায় কিন্তু গরম করে ঠাণ্ডা হ’লে দিতে হবে এবং ওই পাতার রসটা (কাঁচা) পেটে লাগিয়ে দিতে হবে। তবে বয়সানুপাতে কম ব্যবহার করাই উচিত।
৭. মৃগী রোগ: আমরা চলতি কথায় একে মৃগী রোগ বলে থাকি। ওই সময় (রোগাক্রমণের সময়) পাথরকুচি পাতার রস ২-১০ ফোঁটা করে মুখের মধ্যে দিতে হবে, একটু পেটে গেলেই রোগের উপশম হবে।
৮. আঘাতপ্রাপ্ত স্থানে প্রয়োগ: খুব জোরে আঘাত লাগার পর থ্যাঁতলানো ব্যথা হলে পাথরকুচি পাতা আগুনে সামান্য ঝলসে নিয়ে বেটে প্রলেপ লাগিয়ে কাপড়ের টুকরো দিয়ে বেঁধে রাখতে হবে একদিন। পরেরদিন আবার নতুন প্রলেপ দিতে হবে। এভাবে কয়েকদিন দিলেই ফোলা-ব্যথা সেরে যাবে।
৯. কীটের কামড়ে: পোকামাকড়ের কামড়ে খুব জ্বালা-যন্ত্রনা হলে এবং কেটে যাবার পর দ্রুত রক্তপাত বন্ধ করার জন্যও পাথরকুচিপাতা বেটে লাগানো হয়। দু-চারটে হলেও পাথরকুচি গাছ সংগ্রহে রাখুন, প্রয়োজনে ভীষণ উপকারে লাগবে।
CHEMICAL COMPOSITION
Kalanchoe pinnata (Lamk.) Pers.
Leaves contain:– Malic acid; isocitric acid and citric acid. Bergenia ciliata fa. ligulala Yeo Syn.-Bergenia ligulata Sensu Bailey
Root contains: — 1. Gallic acid 2. Tannic acid (14.2%) 3. Glucose (5.6%) 4. Mucilage 5. Wax.
সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।
তথ্যসূত্র:
১. আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য: চিরঞ্জীব বনৌষধি খন্ড ৪, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৩৮৩, পৃষ্ঠা, ১৭৬-১৭৯।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: ভুল করে অনেকে এটিকে পাথরচুর বললেও, পাথরচুর (Coleus amboinicus Lour.) সম্পূর্ণ আলাদা গাছ।
আলোকচিত্রের ইতিহাস: লেখায় ব্যবহৃত পাথরকুচি গাছের আলোকচিত্রটি তুলেছেন Ramon FVelasquez নামের আলোকচিত্রী ২ আগস্ট ২০১৩ তারিখে ফিলিপাইনের কারাঙ্গালান থেকে।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।