জিরা খাওয়ার উপকারিতা ও ১২টি রোগের ভেষজ চিকিৎসা

শরীর ঠাণ্ডা করতে জিরা (বৈজ্ঞানিক নাম: Cuminum cyminum) ব্যবহার করা হয়। জিরা অর্থাৎ শুকনা জিরে আমাদের প্রতিদিন ব্যবহারের একটি রুচিকর ও সুস্বাদু মশলা। ওষুধেও জিরার খুব ব্যবহার হয়। জিরা শীতল তাই শরীরে যদি কোনো কারণে গরম বা উষ্ণভাবে বেড়ে যায় তাহলে জিরা খেলে গরম কমে।  সেইজন্যেই একটি লোকোক্তি প্রচলিত আছে

শরীর ঠাণ্ডা করতে জিরা

শরীর গরম করতে হীরা।

জিরা শূল ব্যথা সারিয়ে দেয়। সুশ্রুতের অভিমতে জিরা উদ্দীপিত করে, বাত, কফ ও অরুচি নাশ করে। গুল্ম শূল ও বায়ু উপশম করে।

আয়ুর্বেদ মতে, জিরা কটু, তিক্ত, মধুর, সুগন্ধযুক্ত, কিঞ্চিৎ উষ্ণবীর্য বা একটু কড়া, লঘু, পাচক বা হজম করায়, মল সংগ্রাহক বা মলরোধ করে, দীপক অর্থাৎ উদ্দীপনা বৃদ্ধি করে, চোখের পক্ষে ভাল, রুচি বৃদ্ধি করে, গভাশয় শোধন করে, রুক্ষ, বল বৃদ্ধি করে। বমি, রক্তের দোষ, পেটের অসুখ, কৃমি, গুল্ম, কুষ্ঠ, ক্ষয়রোগ, বিষের দোষ, বাতের জন্যে যে পেট ফাঁপা (উদরাময়) ইত্যাদি অসুখে জিরে খাইয়ে বা জিরে প্রয়োগ করে উপকার পাওয়া যায়।

ভাবপ্রকাশ মতে, প্রসবের পরে সূতিকা রোগে, যোনির অসুখে শ্বাস রোগে, কাশি, জ্বর ও বাত ব্যাধিতে জিরে উপকার দেয়।

হাকিমি বা ইউনানি মতে, জিরে সুগন্ধী, এবং মলরোধক। হাকিমি পদ্ধতিতে চোখ ধোওয়ার জন্যে জিরে মেশানো জল তৈরি করা হয়। এই জল চোখের জ্যোতি বাড়িয়ে দেয় বলে মনে করা হয়। হাকিমি মতে জিরে অধিক মাত্রায় প্রস্রাব করিয়ে দেয় এবং পেটের কৃমি বের করিয়ে দেয়। হৃদ রোগের চিকিৎসাতেও হাকিমেরা জিরে ব্যবহার করেন।

হকিমি মতে জিরে পেটের বায়ু ও পেট ফাঁপা উপশম করে, যকৃৎ (লিভার) স্টমাক (পাকস্থলী), অন্ত্রমণ্ডল (ইন্টেসটাইন) ফুলে ওঠা বা স্ফীতি কমিয়ে দেয়। কফ বের করে দেয়, কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে, রতি বর্ধন করে।

সুস্থ থাকতে জিরের প্রয়োগ:

১. জ্বর সারাতে: চক্র দত্তের মতে জিরের গুঁড়া পুরোনো গুড়ের সঙ্গে মিশিয়ে খেলে পুরানো জ্বর (বিষম জ্বর) বা ম্যালেরিয়া সারে। জিরার গুড়ায় পুরনো গুড় মিশিয়ে গুলি বা বটি বা বড়ি পাকিয়ে রাখুন। এই গুলি খেলে ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে যাবে।  জিরা পুরনো গুড়ে মিশিয়ে সকালে বা রাত্তিরে একুশ দিন ধরে খেলে পুরনো জ্বর (জীর্ণ জ্বর) সেরে যায়। এছাড়া গরুর দুধে সেদ্ধ করে জিরা পিষে নিয়ে। এই রকম ভাবে পেষা জিরে চিনি মিশিয়ে খেলেও পুরনো জ্বর (জীর্ণ জ্বর সেরে যাবে) ও শরীরে বল বা শক্তি আসবে।  এক চা চামচ জিরা গুঁড়া ২ চা চামচ করলার রসে মিশিয়ে নিয়ম করে খেয়ে শীতজ্বর বা ম্যালেরিয়া সেরে যায়। জীর্ণ বা পুরনো জ্বরের জন্যে যদি ঠোঁটে ফুস্কুড়ি হয় তাহলে জিরা জল দিয়ে পিষে তাতে লাগালে তা সেরে যায়।

আরো পড়ুন:  হলুদ বাংলাদেশে জন্মানো জনপ্রিয় ও ভেষজ গুণসম্পন্ন মসলা

২. বিছের কামড়ে: ভাবপ্রকাশের মতে বিছের কামড়ে জিরের চল্ক বা জিরের বাটা সৈন্ধক লবণ ও ঘিয়ের সঙ্গে মিশিয়ে প্রলেপ দিলে জ্বালা কমে।

৩. পেটের অসুখে: চিকিৎসকদের মতে জিরে বায়ুনাশক, উষ্ণ ও পাচক। স্বরভঙ্গ, অজীর্ণ, পেটের অসুখ, পেটফাঁপা ও পুরানো পেটের অসুখে ওষুধের মতো উপকার করে। জিরে খেলে কোষ্ঠ পরিষ্কার হয়। শুকনা জিরা তাওয়ায় সেঁকে, গোলমরিচ, সৈন্ধব লবণের গুড়া ঘোলে মিশিয়ে খাওয়া-দাওয়ার পরে পান করলে পুরনো পেটের অসুখ, অর্শ ও পেটের অসুখের প্রকোপ কমে।

৪. চোখের সমস্যায়: জিরা জলে ভিজিয়ে সেই জল চোখে দিলে চোখের রোগের উপশম হয়। চিবিয়ে চোখে লাগালে চোখের রোগ সারে।

৫. শুক্র রোগে: কোনো কোনো ধরনের শুক্রমেহ রোগে জিরে উপকার দেয়।

৬. পাকস্থলীর পাথরে: পাকস্থলী বা মূত্রাশয়ে রক্ত বা পাথর জমলে নিয়মিত জিরে খেলে তা বেরিয়ে যায়।

৭. হেঁচকি থামাতে: সিকা যা ভিনিগারের সঙ্গে খেলে হেঁচকি থামে ও পাকস্থলীর কৃমি বেরিয়ে যায়।

৮. ক্ষত শুকতে: জিরা চূর্ণ করে ক্ষত স্থানে লাগালে ক্ষত তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যায়।  

৯. অম্লপিত্তে: সম পরিমাণে ধনে-জিরা গুঁড়া একটু চিনি মিশিয়ে খেলে অম্বলের (অম্লপিত্ত) জন্যে খাওয়ার পরে যে বুক জ্বালা করে তার উপশম হয়। জিরা আর সৈন্ধব নুন সম পরিমাণে নিয়ে পাতিলেবুর রসে সাতদিন ধরে ভিজিয়ে রাখুন। রোদে শুকিয়ে গুঁড়া করে নিন। এই চুর্ণ সকাল ও সন্ধেবেলা খেলে গ্যাস সারে এবং হজম শক্তি বেড়ে যায়।

১০. শূল ব্যথায়: জিরে খেলে গ্যাস, হেঁচকি আর শূল ব্যথা কমে। জিরে, হিং আর সৈন্ধব নুন পিষে মধু এবং ঘিয়ের সঙ্গে মিশিয়ে কিংবা শুধু ঘিয়ের সঙ্গে মিশিয়ে খেলে শূল (তীব্র ব্যথা) কমে যায়।

১১. শ্বেতপ্রদরে: জিরার গুঁড়া আর চিনি একটু ভাতের ফ্যানের সঙ্গে মিশিয়ে খেলে মেয়েদের শ্বেতপ্রদর ও রক্ত প্রদর রোগ কমে। মেয়েদের প্রদর রোগে জিরে অত্যন্ত উপকারী।

আরো পড়ুন:  কাঁচা মরিচ বা কাঁচা লঙ্কার খাওয়ার গুণাগুণ ও অপকারিতা

১২. অর্শ রোগে: জিরা পিষে সেই প্রলেপ লাগিয়ে বাঁধলে স্রাবমুক্ত অর্শ থেকে রক্তপড়া বন্ধ হয় এবং বাইরে বেরিয়ে থাকা অত্যন্ত পীড়াদায়ক অর্শ ও ভেতরে ঢুকে যায়।

এছাড়া জিরা খেলে বীর্য ও স্তন্য দুগ্ধ বৃদ্ধি পায়। রস বা ক্বাথ নাকে টানলে নানা রোগ সারে।  জিরা খেলে স্তনের দুধ বৃদ্ধি পায়। জিরে প্রতিদিন খেলে শরীর গরম হওয়া কমে যায় এবং রাতকানা রোগের উপশম হয়।

তবুও এতো গুণ থাকা সত্ত্বেও জিরে অত্যধিক না ব্যবহার করা উচিত। কারণ অতিরিক্ত জিরে খেলে শরীর ও মুখমণ্ডল হলুদ হয়ে যায়। শরীর রোগা বা কৃশ হয়ে যায়। ফুসফুস ও অস্ত্রমণ্ডলের অনিষ্ট হয়।

তথ্যসূত্রঃ

১. সাধনা মুখোপাধ্যায়: সুস্থ থাকতে খাওয়া দাওয়ায় শাকসবজি মশলাপাতি, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, নতুন সংস্করণ ২০০৯-২০১০, ২০৮-২১০।

বি. দ্র: ব্যবহৃত ছবি উইকিপিডিয়া কমন্স থেকে নেওয়া হয়েছে। আলোকচিত্রীর নাম: Caduser2003

Leave a Comment

error: Content is protected !!