কালোজিরা প্রয়োগের ১০টি রোগের ভেষজ চিকিৎসা

এটি ছোট ও নরম গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ। উচ্চতায় এরা কিঞ্চিদধিক ২০ ইঞ্চি পর্যন্ত হতে দেখা যায়। পত্রদণ্ডের উভয় দিকে যুগ্ম পত্র হয়। পাতার বর্ণ সবুজ, এর গঠন ও আকার দেখতে অনেকটা ধনে (coriandrum sativum) পাতার মত। পুষ্পদণ্ডের অগ্রভাগ থেকে সাদা, নীল ও ঈষৎ পীত বর্ণের ফল হয়। ফল গোলাকার ও ফলগাত্রে বীজকোষের ৫/৬টি লম্বালম্বি খাঁজের দাগ আছে। প্রত্যেক বীজকোষে ত্রিকোণাকার কালো বর্ণের অনেকগুলি বীজ থাকে। সাধারণতঃ কাতিক-অগ্রহায়ণ মাসে ফল ও তৎপরে ফল এবং সেটা পাকে পৌষ-মাঘের দিকে।

এর আদি জন্মস্থান দক্ষিণ ইউরোপে হলেও বর্তমানে সারাভারতে অল্পবিস্তর এর চাষ করা হচ্ছে। বিশেষতঃ পাঞ্জাব ও বিহার প্রদেশে, বর্তমানে বাংলায়ও চাষ হচ্ছে।

এর সংস্কৃত নাম কৃষ্ণজীরা, বাংলা নাম কালজীরা ও হিন্দীতে কালোঞ্জি নামে পরিচিত। বোটানিক্যাল নাম Nigella sativa Linn., ও ফ্যামিলি Ranunculaceae.[১

কালোজিরা-র গুণাগুণ:

পুরনো পেটের অসুখে কালোজিরে আয়ুর্বেদ মতে কালোজিরে উষ্ণবীর্য বা গরম-কড়া, কটু-তিক্ত রস (তেল), রুচি ও বল বৃদ্ধি করে, মেধা বৃদ্ধি করে, অগ্নিদীপক (খিদে বাড়িয়ে দেয়), পাচক (খাবার হজম করায়), ধারক (মল রোধ করে), গর্ভাশয় বিশোধক অর্থাৎ মেয়েদের গভাশয়ের পক্ষে ভাল। কালোজিরে বদহজম, পেটের অসুখ, বাতের জন্যে পেট ফাঁপা, গুম, রক্তপিত্ত বা পিত্তের জন্য রক্তাধিক্য-অবমন), কৃমি, কফ, বায়ু, আমদোষ, পুরনো পেটের অসুখ, বাত, ব্রণ ও শূল রোগে ব্যবহার করা হয়। ঔষধার্থ ব্যবহার্য অংশ বীজ।[২]

সুস্থ থাকতে কালোজিরের প্রয়োগ :

১. কফ দূর করে: বঙ্গসেনের মতে, নতুন কফ রোগে কালোজিরের চূর্ণ নস্যের মতো নাকে টানলে উপকার হয়।

২. বুকের দুধ বাড়ে: পেটে আমদোষ থাকলে অর্থাৎ শুকনো আম অথবা রসধাতু শুকোতে থাকলে স্তন্য কমে যায়। ওই সময় কালজীরা কাঠখোলায় একটু ভেজে নিতে হবে; তারপরে চূর্ণ করতে হবে। সেই চূর্ণ ৫০০ মিলিগ্রাম ৭। ৮ চা-চামচ দুধে মিশিয়ে প্রত্যহ সকালের দিকে এবং বৈকালের দিকে দু’বার খেতে হবে। এক সপ্তাহ ব্যবহারে উল্লেখযোগ্যভাবে উপকার পাওয়া যাবে। এছাড়া প্রসবের পরে কালোজিরের ক্বাথ খেলে গর্ভাশয়ের দ্বার সঙ্কুচিত হয় এবং স্তনের দুধ বেড়ে যায়।

৩. পেটের অসুখে: পেটের অসুখে, খিদে হলে, বদহজম হলে পুরনো পেটের অসুখে চিতামূলের (কবিরাজ্ঞি দোকানে পাওয়া যায়) সঙ্গে কালোজিরা খেলে উপকার পাওয়া যায়।

আরো পড়ুন:  সোয়া বা সালফা হচ্ছে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার ঔষধি বিরুৎ

৪. মাসিক বা ঋতুস্রাবজনিত সমস্যায়: কালোজিরা মেয়েদের ঋতু স্রাব করায়, সেইজন্যে ঋতু ঠিক মতো না হলে (রজঃকৃচ্ছ্র), ঋতু রোধে (রজরোধে) বা বিলম্বিত ঋতুতে (বিলম্বিত রজে) অল্প পরিমাণে খেলে ফল পাওয়া যায় বেশি মাত্রায় খেলে গর্ভস্রাব হয়।

যেসব মেয়েদের অনিয়মিত অথবা স্বল্প বা অধিক স্রাবের জন্য কষ্ট পেয়ে থাকেন, তাঁদের ঋতু হওয়ার ৫/৭ দিন আগে থেকে ৫০০ মিলিগ্রাম মাত্রায় ঈষদুষ্ণ জলসহ সকালে ও বৈকালে দু’বার খেতে হবে। যদি দেখা যায় যে, সে অসুবিধেটা র’য়ে গেল, তাহলে পর পর দু-তিন মাস ওই ৫।৭ দিন আগে থেকেই খেতে হবে।

৫. পা ফোলা কমাতে: কালোজিরে জলে বেটে প্রলেপ দিলে হাত পা ফোলা (হস্ত ও পায়ের শোথ) কমে। এছাড়া কালোজিরে বিষ নাশ করে। কালোজিরে বাঁটা লাগালে সব রকল্পে ফুলো কমে।

৬. কৃমি নাশ করে: সিকা বা ভিনিগারে দিয়ে বেটে কালোজিরে খেলে কৃমি নষ্ট হয়।

৭. ব্যথা কমায়: কালোজিরা সিকতে ভিজিয়ে শুকলে মাথা ব্যথা সারে। গরম জলে কালোজিরে দিয়ে কুল্লি করলে দাঁতের ব্যথা কমে। কালোজিরে বেটে প্রলেপ দিলে মাথা ব্যথা, সন্ধির ব্যথা, বা জয়েন্টের ব্যথা বা গটি ব্যথা উপকার হয়।

. মুখ উজ্জ্বলতা বাড়ায়: ঘিয়ের সঙ্গে মিশিয়ে খেলে মুখ উজ্জ্বল হয় এবং রং ফরসা বা বর্ণ পরিষ্কার হয়।

 ৯. ক্ষত শুকায়: কালোজিরা মোমে পুড়িয়ে এবং মোমের সঙ্গে মিশিয়ে ক্ষতস্থানে লাগালে ক্ষত শুকিয়ে যায় ।

১০. মাথার চুল গজায়: দীর্ঘকাল মাথায় (বেটে নিয়ে) মালিশ করলে নতুন চুল গজায়।

১১. বাধক দোষে: মেয়েদের এমন রোগ হয় যেটা শরীরের জরায়ুর রক্তজ গ্রন্থির সঙ্গে অন্যান্য রক্তবহ স্রোতের যেন সংগ্রাম চলতে থাকে। এর ফলে তাঁদের মনের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়, কেউ বা আত্মসুখেই তৎপর হয়, কেউ বা শুচিবায়ুগ্রস্তা, কারও কারও বা দেহটা স্থুল হয়ে যায়, কখন বা তাও হয় না। আবার সকলেই যে কৃশ হবে তাও নয়, কিন্তু মনের উপর এ রোগের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে; যার ফলে কেউ কেউ কামজ উন্মাদ রোগেও আক্রান্ত হন; আবার এই দোষে কোন কোন রমণী জননগ্রন্থির ক্রিয়াশক্তি হারিয়েও ফেলেন, এভিন্ন আরও অনেক উপসর্গ এসে জুটতে পারে।

আরো পড়ুন:  লিচু চাষ ও পরিচর্যা করার পদ্ধতি

যাহোক, কোন অপারেশন করার পূর্বে এই ভেষজটি প্রয়োগ করে দেখতে দোষ কি; কালজীরে একটু ভেজে নিয়ে গুঁড়া করে রেখে দিতে হবে এবং সকাল সন্ধ্যায় ঈষদুষ্ণ জলসহ ৭৫০ মিলিগ্রাম মাত্রায় খেতে হবে। মাসিক ঋতু হলেও এটা খাওয়া বন্ধ করার দরকার নেই, যন্ত্রণা যদি একটু হয়ও তা হ’লেও খাওয়া বন্ধ করার দরকার নেই। এর দ্বারা জননগ্রন্থির ক্রিয়াশক্তিটা ফিরে আসবে। অন্ততঃ ২। ৩টি মাস খেতে হবে। এ পদ্ধতিটি মুসলমান ফকির এবং অবধৌতিক চিকিৎসকদের বলে প্রসিদ্ধি।

১২. মাথায় সর্দি বা শ্লেষ্মা বসে গেলে: কালজীরে বেটে কপালে প্রলেপ দিলে এবং মিহি চূর্ণের নস্য নিলে শ্লেষ্মা তরল হয়ে ঝরে পড়বে।

১৩. চুলকানি: কালজীরে ভাজা তেল গায়ে মাখলে চুলকণার উপশম হবে। ১০০ গ্রাম সরষের তেলে ২৫। ৩০ গ্রাম কালজীরে ভেজে সেই তেল ছেকে নিয়ে ব্যবহার করতে হবে।

১৪. বিছের হুলের জ্বালায়: কালজীরে বেটে সেখানে লাগিয়ে দিলে অল্পক্ষণ পরেই জ্বালার উপশম হবে।

১৫. মাথার যন্ত্রণায়: কাঁচা সর্দি হয়ে মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে, সেক্ষেত্রে কালজীরে পুটলী করে শুকতে হবে, শোঁকার সময় ওটা (পোঁটলাটা) একটু র’গড়ে নিয়ে শুকতে হবে। ওর তেলের গন্ধটাতে মাথার যন্ত্রণা সেরে যাবে।

১৬. গলা ফোলায়: সর্দি-কাসির দোষে গ্লান্ড (গলার পাশে) ফুলেছে; সেক্ষেত্রে কালজীরে, চালপোড়া এবং মুসব্বর সমান পরিমাণে নিয়ে, বেটে অল্প গরম করে গলায় প্রলেপ দিলে একদিনের মধ্যে ফুলা ও ব্যথা দুই-ই কমে যাবে।[১][২]

হাকিমি বা ইউনানি মতে: কালোজিরে খেলে শরীরে দৃষিত রস এবং ধাতুর শোধন হয়। কালোজিরে জলে সেদ্ধ করে খেলে সন্তানের প্রসব তাড়াতাড়ি হয়।

এছাড়া বায়ু কৃমিনাশক, পাচক অথাৎ হজম করায় তাড়াতাড়ি, প্রস্রাব বৃদ্ধি করে (মূত্রকারক), গলাভাঙা সারিয়ে দেয় (স্বরভঙ্গ নাশক)। বিষম জ্বর অথাৎ পুরনো জ্বর বা ম্যালেরিয়ায়, দাদ ধবল ও চুলকুনিতে উপকার হয়।

কালোজিরা পরিমাণ মত খেলে প্রস্রাব পরিষ্কার হয়, ঋতু পরিষ্কার হয় এবং গুনের দুধ বেশি পরিমাণে বেরোতে থাকে। কান থেকে পুঁজ পড়া, বমি ভাব, পিলে বড় হয়ে যাওয়া, খাস নিতে কষ্ট হওয়া সব কিছুতেই উপকার বা আরাম দেয়। এছাড়া সুরমা তৈরি করে চোখে দিলে ছানি সারে।

আরো পড়ুন:  জলধুনিয়া গুল্মের নানাবিধ গুণাগুণের বর্ণনা

কালোজিরার ঝাঝালোভাব উপকার দেয় যাদের সর্দির জন্যে নাক বন্ধ হয়ে গিয়ে যে কাশি হয়, বুকের ব্যথা, বমনেচ্ছা বা গা বমি ভাব, পাণ্ডু বা কামলা রোগে (জনডিসে) প্লীহা এবং বায়ুর জন্যে যে পেটে তীব্র ব্যথা হয় বা শূল রোগে। এক্ষেত্রে কালোজিরে বেটে বাইরে থেকে প্রলেপ লাগালে বা কালোজিরে বাটা খেলে উপকার পাওয়া যায়।

সর্দিতে নাক বন্ধ হয়ে গেলে কালোজিরে পাতলা কাপড়ের ছোট পুঁটলিতে বেঁধে শুকলে আরাম পাওয়া যায়। কালজিরে পুঁটলি করে বেঁধে শুকলে মাথা ব্যথা সেরে যায়।[২]

CHEMICAL COMPOSITION

Nigella sativa Linn.

Analysis of black cumin :- Volatile oil 1% (carvone, £-limonene and cymene); fatty oil 35% (stearic, palmitic and oleic); glycerides (trilinobin, dilinobin and oleidilinobin); saponin (melanthin and melanthigenin); total ash 3.8%; bitter principle (nigellin); nigellone; protein; tannin, reducing sugars and resin.[১]

সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।

তথ্যসূত্রঃ

১. আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য: চিরঞ্জীব বনৌষধি খন্ড ৫, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ ১৪০৩, পৃষ্ঠা, ৪৪-৪৬।

২. সাধনা মুখোপাধ্যায়: সুস্থ থাকতে খাওয়া দাওয়ায় শাকসবজি মশলাপাতি, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, নতুন সংস্করণ ২০০৯-২০১০, ২১০-২১২।

বি. দ্র: ব্যবহৃত ছবি উইকিপিডিয়া কমন্স থেকে নেওয়া হয়েছে। আলোকচিত্রীর নাম: TheGoblin~commonswiki

Leave a Comment

error: Content is protected !!