তরকারির রাজা আলু। ভাত খাওয়ার মতো আলুও হলো আমাদের প্রতিদিনের খাবার। শাক-সবজির খাদ্য তালিকায় আলু বাদ দেওয়াই যায় না। বাড়িতে সবজির ঝুড়িতে যদি শুধুই আলুই পড়ে থাকে তাহলেও রান্নার ব্যাপারে কোনো চিন্তা থাকে না। বলতে গেলে হাজারও পদ রান্না করা যায় আলু দিয়ে। সেইজন্যে আলুকে গৃহস্থের বন্ধু বলা যায়। ধনী দরিদ্র সকলেরই প্রিয় আলু।
সারা পৃথিবীতেই আলু পাওয়া যায় এবং কোনো কোনো দেশে যেমন আয়াল্যান্ডে আমাদের দেশের ভাত-রুটির মতো আলুই প্রধান খাদ্য। আলু এসেছে দক্ষিণ আমেরিকা থেকে। সেখান থেকে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে।
ঝোলে বা ঝালের তরকারিতে আলুর ব্যবহার এখন কে না জানে? কিন্তু আলুর খাদ্যগুণ অনেকেরই জানা নেই তবে আলু খাওয়া সম্বন্ধে ভয়-ভ্রান্তি বেশ কিছু লোকের আছে।
সুস্থ থাকতে আলুর ব্যবহার:
১. আলুতে শ্বেতসার (কাবোহাইড্রেট), পটাশ, ক্ষারজ লবণ থাকায় আলু খেলে শরীরের পুষ্টি হয়।
২. আলু, পাতিলেবু, পেঁয়াজ, কপি ইত্যাদি খেলে স্কার্ভি (এক রকমের চর্মরোগ তাজা শাক-সবজি না খেলে যা হয়) হয় না।
৩. কোনো কোনো বিখ্যাত পুষ্টিতত্ত্ববিদদের মতে শুধু আলু ও তার সঙ্গে মাখন বা উদ্ভিজ্জ মাখন (মাজারিন) খেয়ে বেঁচে থাকা যায়।
খোসা ছাড়িয়ে রান্না করলে আলুর খাদ্যগুণ কমে যায় কারণ আলুর খোসায় শরীরে পুষ্টি জোগানোর মতো অনেক খনিজ লবণ আছে।
৫. খোসা ছাড়ানো আলু আর ভাজা আলু হজম করতেও অনেক সময় লাগে। সেইজন্যে খোসাসুদ্ধ আলু সেদ্ধ করে বা আগুনে পুড়িয়ে খাওয়াই স্বাস্থ্যের পক্ষে ভাল।
৬. আলু সেদ্ধ করা জলের মধ্যেও অনেক ভিটামিন থেকে যায়। সেইজন্যে আলু সেদ্ধ করা জল ফেলে না দিয়ে ডাল বা অন্য কোনো তরকারির মধ্যে দিয়ে দেওয়া উচিত।
৭. আলুতে শ্বেতসার ও পটাশ তো আছেই তা ছাড়াও আছে অল্প বা বেশি মাত্রায় ফসফরাস, গন্ধক, তামা ও লোহ এবং অল্প মাত্রায় ভিটামিন এ ও সি।
আলুর ঔষধি গুনাগুণ
হাকিমি মতে আলু রুক্ষ, শীতল, কামোত্তজক, বীর্যবর্ধক, হজম হতে বেশি সময় লাগে। আয়ুর্বেদের মতে আলু বীর্যবর্ধক, মধুর রস, গুরু, মূত্রনিঃসারক রুক্ষ, দুষ্পাচ্য, রক্তপিত্তনাশক, কফ ও বায়ুবর্ধক, বলকারক, স্তন্যবর্ধক।
ডায়বেটিসের রোগীদের আলু খাওয়া: ডায়বেটিসে আলু খেতে অনেক সময় বারণ করা হয়। কিন্তু এ ব্যাপারে নানা মত আছে। কেউ কেউ বলেন আলুর শ্বেতসার চাল বা গমের চেয়ে উঁচুমানের বলে ডায়বেটিসে অল্প পরিমাণে আলু খেলে কোনো ক্ষতি হয় না।
পুড়ে গেলে আলু বাটা ও আলুর পাতা বাটার প্রয়োগ: কোনো জায়গা পুড়ে গেলে আলু বেটে সেই জায়গায় লাগালে জ্বালা কমে এবং ফোস্কাও পড়ে না। যেখানে আলুর চাষ হয় সেখানে আলুর পাতাও পাওয়া যায়। এই আলুর পাতা বেটে নিয়ে লাগালে বাতের ব্যথা ও শূল ব্যথা সারে।
আমাদের দেশের মিষ্টি আলু: আমাদের দেশে মিষ্টি আলুর চলন আছে। বাঙালিদের কাছে রাঙা আলু বিশেষ পরিচিত এটির খোসা লাল। উত্তর ভারতে সাদা খোসার মিষ্টি আলুকে শকরকন্দ বলে। আয়ুর্বেদ মতে শকরকন্দ বলকারক, স্নিগ্ধ, গুরুপাক ও কফনাশক। এই আলু খুব পুষ্টিকর ও কাঁচাই খাওয়া যায়। অনেকে বলেন খাদ্য হিসেবে এর গুণ ভাতের মতোই। অনেকের মতে রাঙা আলু খেলে মস্তিষ্কের স্নায়ু বৃদ্ধি হয় অর্থাৎ মেধা বাড়ে।
মোটকথা সব মিলিয়ে আমকে যেমন ফলের রাজা বলা হয় আলুকেও তেমনই তরকারির রাজা বলা যায়।
ঝোল ভাত আলু ভাতে: এই প্রসঙ্গে বলে রাখা যায় আলু পরিশ্রমী, অধিক পরিশ্রম করবার জন্যে যারা দুর্বল এবং যাঁদের অত্যন্ত বেশি খিদে পায় তাঁদের পক্ষে খুবই উপযুক্ত আহার। ঝোল-ভাত প্রিয় বাঙালিদের কাছে রোজকার ভাতের সঙ্গে আলু পটোল দিয়ে মাছের ঝোলের তুলনা নেই। এমনকী ভাতে-ভাত খেতে যাঁরা ভালবাসেন তারা ভাতে বলতে সাধারণত আলু-ভাতেই বোঝেন।
শকরকন্দ বা মিষ্টি আলু: এই প্রসঙ্গে শকরকন্দ বা মিষ্টি আলুর কথা আরও একটু বলে নেওয়া যাক। রাঙা আলু বা সাদা শকরকন্দের তরকারি বেগুন দিয়ে রান্না করলে মিষ্টি আলু খেলে যে বায়ুর দোষ হয় তা কমে যায় এবং গুরুপাক বা গরিষ্ঠতা ভাবও কমে। শকরকন্দ বা রাঙা আলু আগুনে পুড়িয়ে পোড়া হিসেবে, সেদ্ধ করে দুধের সঙ্গে মিশিয়ে কিংবা সেদ্ধ করে দুধ না মিশিয়েও খাওয়া চলে। রাঙা আলুর পুলি বা পান্তুয়া তো আমাদের পৌষ পার্বণের বলতে গেলে সবচেয়ে প্রিয় খাবার। শিকরকন্দ ও রাঙা আলু হজমের দিক থেকে ভারী, শরীরের পক্ষে শীতল, বলদায়ক কিন্তু একটু কোষ্ঠকাঠিন্য করায়।
বৈজ্ঞানিক মতে, মিষ্টি আলুতে স্টার্চ ও শর্করার মাত্রা বেশি। এছাড়াও আছে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, সোডিয়াম, পটাশিয়াম, লোহ, ভিটামিন এ এবং অল্পমাত্রায় ভিটামিন সি। সাধারণ আলুর চেয়ে এতে কার্বোহাইড্রেট, ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন এ বেশি আছে! এই সব তত্ত্ব থাকার জন্যে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাধারণ আলুর চেয়ে রাঙা আলু বা শকরকন্দের গুণ বেশি।
তথ্যসূত্রঃ
১. সাধনা মুখোপাধ্যায়: সুস্থ থাকতে খাওয়া দাওয়ায় শাকসবজি মশলাপাতি, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, নতুন সংস্করণ ২০০৯-২০১০, পৃষ্ঠা, ৭৪-৭৬।
জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ সম্মান ও এমএ পাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। বিভিন্ন সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রোদ্দুরে ডট কমের সম্পাদক।