দেশি পেটারি গুল্মের বিবরণ ও দশটি ভেষজ ব্যবহার

দেশি পেটারি গুল্মের উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম- Abutilor indictini (Linn.) sweet. গোত্রের নাম মালভেসী। পেটারির সমগ্ৰ অংশই ওষুধে ব্যবহার করা অথর্ববেদে (৪/২/৭৮) অতিবলাকে অমিত শক্তিধর ওষুধি বলা হয়েছে। নামের উৎস যা-ই হোক এটি আমাদের দেশজ। অনাবাদি পতিত জমি থেকে হিমালয় এবং অন্যান্য পাহাড় ও টিলায় ১২০০ মিটার পর্যন্ত উচ্চতায় এর দেখা পাওয়া যায়।

অন্যান্য নাম:

বাংলা অভিধানে ‘পেটারি’ বলে কোনো শব্দ নেই। তাই এ নামের উৎস সম্বন্ধে জানা যায় না। কিন্তু এর সংস্কৃত নাম ‘অতিবলা’ রাখার যুক্তিসঙ্গত কারণ খুঁজে পাওয়া যায়। পেটারির আরও কয়েকটি নাম আছে- বালিকা, বল্যা, বিকঙ্কতা, বাট্যপুষ্পিকা, শীতপুষ্প, ভূরিবলা, বৃষ্যগন্ধিকা। এটি হিন্দিতে কাংঘি, ঝমলি; আরবিতে মস্তুলগোলা; ফারসীতে দরখতশান; মায়ানমার- ফা-ফা-চোক; আসামে- ঝাঁপা; সাঁওতাল- মিরুবাহা; ইংরেজিতে- Indian mallow, country mallow।

দেশি পেটারি গুল্মের বিবরণ:

দেশি পেটারি গাছ ওষুধি বা গুল্মজাতীয়, বর্ষজীবী বা বহুবর্ষজীবী ঝোপঝাড়সম্পন্ন গাছ। কোনো কোনো গাছের উপরের অংশ মরে গিয়েও গোঁড়া জীবিত থাকে এবং তা থেকে নতুন গাছ বেরোয় এবং এভাবে কয়েক বছর বেঁচে থাকতে পারে। গাছ ৩ মিটার পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। কাণ্ড গোলাকৃতি, পার্পল রঙের ছোপবিশিষ্ট। পাতা ডিম্বাকৃতি বা হৃদপিণ্ডাকৃতি, অগ্রভাগ সরু, কিনারা অসমভাবে খাজকাটা। পাতাসমৃদ্ধ গাছ দেখতে বেশ সুন্দর। কাণ্ডে সূক্ষ্ম শ্বেতাভ মখমলি রোমাবরণ থাকে।

ফুল হলুদ বা কমলা-হলুদ বা পীত-নারঙ্গী রঙের। এক একটি ফুল বা গুচ্ছে জন্মে, সন্ধ্যায় ফোটে। ফল রোমাবৃত, চক্রাকৃতি বা গোল, বাইরের দিক কাটা কাটা, প্রতি ফলে ৩ থেকে ৫টি বীজ থাকে, বীজ বৃক্কাকৃতি, গাঢ় খয়েরি বা কালো, ফল থেকে ফেটে গিয়ে আপনাআপনি বীজ ছড়িয়ে যায়। কার্তিক থেকে ফাল্গুনে ফুল ও ফল হয়, তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সারা বছর কমবেশি ফুল ও ফল হয়।

প্রাচীন শাস্ত্রে উল্লেখ:

পেটারি একটি আয়ুর্বেদ প্রমাণিত ওষুধি উদ্ভিদ, কেননা প্রায় প্রতিটি সংহিতা এবং চিকিৎসাগ্রন্থে পেটারির উল্লেখ দেখা যায়। চরকসংহিতার সূত্রস্থানে বল্য দশমানির মধ্যে অতিবলাকে বলবীর্য রক্ষাকারী হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ সংহিতারই চিকিৎসাস্থানের ৪০ শ্লোকে অতিবলায়। রসায়ন গুণের উল্লেখ আছে। সুশ্রুত সংহিতার গ্রন্থে উল্লেখ আছে, বাত সংশমনীয় দ্রব্যগুলোর মধ্যে অতিবলার উল্লেখ রয়েছে। অষ্টাঙ্গহৃদয় সংগ্রহ গ্রন্থে অশ্মরী রোগ চিকিৎসায় এবং রসায়ন হিসাবে এর ব্যবহারের উল্লেখ দেখা যায়। চক্রদত্তে অতিবলার ক্বাথ মূত্রকৃচ্ছে ব্যবহারের উল্লেখ রয়েছে। ধন্বন্তরি নিঘণ্টতে গুণ বর্ণনায় তিনটি বলার অর্থাৎ বলায়ম যথা বলা, নাগবলা এবং অতিবলা একত্রে গুণ বর্ণনা করা হয়েছে- এগুলো বাতপিত্তনাশক, সংগ্রাহী, বলবর্ধক এবং শুক্রজনন। ভাবপ্রকাশে গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে যে এটা শীতবীর্য, মধুর, বলকর, কান্তিবর্ধক, স্নিগ্ধ, মল-সংগ্রাহক, বায়ু-পিত্ত-রক্তদুষ্টি এবং ক্ষতনাশক।

আরো পড়ুন:  লিচু ফল-এর আটটি ভেষজ গুণাগুণ

দেশি পেটারি গাছের ভেষজ ব্যবহার:

১. উদরাময় সমস্যা সারাতে: পেটারির পাতা স্নিগ্ধ, বলকর, কৃাথ মূত্রল, ঘি-সহযোগে এটি উদরাময় নিরাময়ে ব্যবহার্য।

২. দাঁতের সমস্যায়: দাঁতের ব্যথা বা মাড়ির প্রদাহে পাতার ক্বাথকে মাউথওয়াশ হিসাবে ব্যবহার করা হয়।

৩. ঘা ও ক্ষত সারাতে: এর পাতা গনোরিয়া, মূত্রথলির প্রদাহে উপকারী। পাতা সেদ্ধ পানি দ্বারা ঘা বা ক্ষত ধোয়া যায়, বিরেচনা এবং যোনি ধোয়ার জন্য ডুস হিসাবে ব্যবহার করা যায়।

৪. অর্শ রোগে: অর্শের রক্তপাত বন্ধের জন্য এর পাতা রান্না করে খেলে উপকার হয়।

৫. নাকের সমস্যায়: গাছের রস শিশুদের নাকের ক্ষতে ত্বক কোমলকারী হিসাবে ব্যবহার করা হয়।

৬. শ্বেতীতে: চন্দন ঘষা, চালমুগরা তেল এবং মধুসহ এর শিকড় বাটা শ্বেতীতে লাগালে কাজ হয়।

৭. ফোঁড়া সারাতে: কাঁচা ফুল খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করা হয়। এটি শীতল এবং ফোঁড়া ও ক্ষতে ব্যবহার করা হয়।

৮. প্রস্রাবের সমস্যায়: মূত্রকৃচ্ছ্বতায় প্রস্রাব কম, তলপেটে টানটান ভাব, দাহ, যন্ত্রণার সঙ্গে বারেবারে অল্প প্রস্রাব। এ অবস্থা প্রোস্টেট গ্রন্থির বিবৃদ্ধি, অত্যধিক টানা ঠাণ্ডা গরম প্রভৃতি কারণে হতে পারে। অণুজীবঘটিত কারণেও হতে পারে। এ অবস্থায় পেটারি গাছের শিকড় শুকনো ৫ গ্রাম বা কাঁচা হলে ১০ গ্রাম থেঁতলিয়ে ৩ কাপ পানিতে সেদ্ধ করে ১ কাপ থাকতে নামিয়ে ছেকে ঠাণ্ডা হলে সারদিনে ২-৩ বারে ভাগ করে খেতে হয়। পরপর কয়েকদিন ঐভাবে খেলে প্রস্রাবের ঐ অসুবিধা চলে যাবে।

৯. পাথুরের সমস্যায়: পাথুরী জন্মানোর জন্য মূত্রকৃচ্ছ্বতা হলে পেটারি শিকড়চূর্ণ ২ গ্রাম-এর সঙ্গে ৩ থেকে ৪ চা-চামচ পাথরকুচি পাতার রস এবং আধ চা-চামচ মধু মিশিয়ে সকাল-বিকাল খেলে পাথুরী চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে প্রস্রাবের সঙ্গে বেরিয়ে যায়।

১০. কফ ও বমি সারাতে: রক্ত-বমি ও কফে ফুল চূর্ণ ঘি-সহযোগে খেলে উপকার হয়।

আরো পড়ুন:  লাল পাতা চুকাই বা লাল পাতা মেস্তা হচ্ছে হিবিস্কাস গণের সপুষ্পক উদ্ভিদ প্রজাতি

গাছের অংশ বিশেষের ব্যবহার:

দেশি পেটারির বাকল প্রদর, প্রমেহ, গনোরিয়া এবং গ্রহণী রোগে ব্যবহার্য। গাছের মূল বা মূলের ছাল জ্বর, মূত্রকৃচ্ছ্বতা, অর্শ, অশ্মরী, গলিত কুষ্ঠ, রক্তপ্রদর প্রভৃতিতে ব্যবহার্য। এছাড়া গাছের শিকড়ের ফান্ট শীতল এবং জ্বরম্ন, মূত্রাঘাত ও রক্তমূত্রে হিতকর। শিকড়ের ক্বাথ মূত্রাশ্মরীনাশক।

ফলের বীজের ফান্ট বা শরবত ঠাণ্ডা পানীয় হিসাবে ব্যবহৃত হয়। এটি শীতল, পিচ্ছিল এবং মৃদু বিরেচক। বীজ অর্শরোগে বিরেচনের জন্য ব্যবহৃত হয়। বীজ বেদনানাশক এবং কামোদ্দীপক, বাজীকরণে ব্যবহার করা হয়।

বাংলাদেশ জাতীয় আয়ুর্বেদিক ফর্মুলারী ১৯৯২-তে কেবল একটি ওষুধে অতিবলাকে মূল উপাদান হিসাবে ‘কুমারী আসব’-এ ব্যবহারের উল্লেখ করা হয়েছে যার কার্যকারিতা অগ্নিমান্দ্য, পিত্ত, পরিণামশূল, উদাবর্ত, অশ্মরী, মূত্রকৃচ্ছু রক্তপিত্ত প্রশমক।

সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।

তথ্যসূত্রঃ

১. ড. সামসুদ্দিন আহমদ: ওষুধি উদ্ভিদ (পরিচিতি, উপযোগিতা ও ব্যবহার),  দিব্যপ্রকাশ, বাংলাবাজার, ঢাকা, জানুয়ারি ২০১২, পৃষ্ঠা, ৩৪-৩৫।

বি. দ্র: ব্যবহৃত ছবি উইকিমিডিয়া কমন্স থেকে নেওয়া হয়েছে। আলোকচিত্রীর নাম: Dinesh Valke

Leave a Comment

error: Content is protected !!