শীতকালীন মৌসুমী ফুলের মধ্যে চন্দ্রমল্লিকা এদেশে বেশ সুপরিচিত ও সমাদৃত। বাগানের জন্যে অত্যন্ত উপযোগী এই ফুল জমিতে, টবে কিম্বা ছাদে সর্বত্রই চাষ করা যায়। চন্দ্রমল্লিকা সাধারণত: শীতকালে অগ্রহায়ণ মাস থেকে পৌষ মাস পর্যন্ত ফুটে থাকে। এই ফুলের আদিবাস সম্ভবত: জাপান ও চীনদেশ। চন্দ্রমল্লিকাকে লক্ষ্য করে জাপানীরা প্রতি বছর একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকেন। শীতকালে অগ্রহায়ণ মাস হতে পৌষ মাস চন্দ্রমল্লিকার গাছে ফুল ফোটে। খ্রিস্ট মাসের সময় এই ফুল ফোটে বিধায় ইহাকে ক্রিসেন্সিয়াস বলা হয়। এই ফুল টব ও জমি উভয় স্থানেই চাষ করা যায়।
চন্দ্রমল্লিকার জাত:
চন্দ্রমল্লিকা নানা আকৃতির সিঙ্গল ও ডবল হয়ে থাকে। উদ্ভিদতত্ববিদ পণ্ডিতগণের প্রচেষ্টায় বহু উন্নত জাতের জাত উদ্ভাবিত হয়েছে। হেয়ারী, কেদারী, জাপানীজ ইনকার্ভড, এনিমোন, পোমপোন, রিফ্লেক্সড, কাসকেড ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য জাতের চন্দ্রমল্লিকা দেখা যায়। বাংলাদেশে ৩ ধরণের চন্দ্রমল্লিকা বেশি দেখা যায় মালী’র চন্দ্রমল্লিকা, তোড়া চন্দ্রমল্লিকা, তিন রঙা চন্দ্রমল্লিকা।
জমি প্রস্তুত:
১. চারা উৎপাদনের বীজতলা প্রস্তুত: সূর্যালোকিত জায়গায় উচু দো-আঁশ বা বেলে মাটিই বীজতলার জন্যে উপযোগী। ৭৫ সেঃ মিঃ থেকে ১ মিঃ প্রস্তুত, ১.৫ মিঃ থেকে ৩ মিঃ বা তারও বেশি দৈর্ঘ্য এবং ভূমি থেকে ১০-১৫ সেঃ মিঃ উচু জমি বাছাই করে তার চারপাশে ২০-৩০ সেঃ মিঃ চওড়া ও ১০-১৫ সেঃ মিঃ গভীর সেচনালা রাখতে হবে। বীজতলা প্রস্তুতির কাজগুলি যথাক্রমে ব্যবস্থা করতে হবে।
ক. মাটি কুপিয়ে নরম ও ঝুরঝুরে করতে হবে।
খ. কোপানো মাটির সাথে ঝুরঝরে মাটির ১০ ভাগ এর সাথে ১ ভাগ পচা পাতা সার বা শুষ্ক গোবর সার মিটাতে হবে।
গ. উপরোক্ত আয়তনের জমিতে ২০০ থেকে ২৫০ গ্রাম এস এস পি ও ৫০ থেকে ৬০ গ্রাম পটাশ প্রয়োগ করে মিশানোর পর মাটি সমান করে দিতে হবে।
ঘ. এই সময় ব্রাসিকল ৭৫ এবং বি সি ৫০ এর ০.৪% স্প্রে দ্বারা ৪-৬ সেঃ মিঃ গভীর পর্যন্ত মাটি ভিজিয়ে মাটি শোধন করতে হবে।
ঙ. মাটি সোধন করার ৪/৫ দিন পর মাটির উপর স্তর আলগা করে জমিতে বীজ বা কাটিং লাগাতে হবে।
২. চারা লাগানোর জমি প্রস্তুত: চন্দ্রমল্লিকা ফুল চাষের জমি উর্বর, উঁচু, শুষ্ক ও সহজে জল নিষ্কাশন করা যায় এমন জমিই উত্তম। দক্ষিণ খোলা উর্বর হালকা দো-আঁশ। মাটি চন্দ্রমল্লিকা চাষে উপযোগী। তবে এটেল মাটি আরো ভালো।
ক. নির্বাচিত জমি লাঙ্গল বা কোদাল দিয়ে ৪/৫ বার গভীর ভাবে কর্ষণ করে মাটিকে ঝুরঝুরে করতে হবে।
খ. আগাছা, ইট, পাটকেল, পাথর, আবর্জনা ইত্যাদি পরিষ্কার করে প্রতি ১০০ মিটার জায়গায় ২০০ কেজি পাতা-পচা সার বা গোবর সার, ৬ থেকে ১০ কেজি কাঠের ছাই, ২-৩ কেজি এস এস পি সার মাটিতে মিশিয়ে দিতে হবে।
গ. এটেল মাটির জমিতে চাষের সময় সামান্য চুন মিশাতে হবে যা দো-আঁশ মাটিতে দরকার হবে না। মাটি শোষণের জন্যে সমগ্র মাটিতেই ৩০ গ্রাম অলড্রিন এবং ২৫০ গ্রাম ব্রাসিকল ২০ সামান্য গুড়া সারের সাথে মিশিয়ে দিতে হবে।
ঘ. এই অবস্থায় মাটি সমতল করে ৩/৪ সেঃ মিঃ বীজের ও ৪-৫ টি পাতার কলমের চারা রোপনের ব্যবস্থা করতে হবে।
চারা তৈরী ও লাগানো:
বীজ হতে হোক আর কাটিং বা তেউড় হতেই হোক যথাযথ নিয়মে চারা উৎপাদনের কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে এবং উৎপাদিত চারা সেপ্টেম্বর হতে অক্টোবর মাসে লাগানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। | প্রস্তুতকৃত জমির মাটি সমতল ও নরম করে ফলের চারা লাগানোর জন্যে ১ হতে ১.৫ ফুট দূরে দূরে জমিতে লাইন টানতে হবে । লাইনের উপর উৎপাদিত বা সংগৃহীত চারাগুলি ০.৭৫ হতে ১.০ ফুট দূরে দূরে লাগাতে হবে।
পরিচর্যা ও যত্ন:
গাছ লাগানোর সময় থেকে পরিচর্যার ব্যবস্থা নিতে হবে। নতুবা ভালো ফুল পাওয়া যাবেনা। চারা লাগানোর সময়ই সামান্য ফসফেট সার দিতে হবে এবং সামান্য জলসেচের দিতে হবে।
ক. পানি জমে যাওয়া বা পানি শূন্য হয়ে যাওয়া কোনটাই চন্দ্রমল্লিকা সহ্য করতে পারেনা বিধায় ফুল আহরণ পর্যন্ত প্রয়োজন মতো সেচ দিতে হবে।
খ. গাছ সামান্য বড় হলেই ছোট ছোট চিকন খুটির সাথে গাছগুলিকে বেঁধে দিলে ভালো হবে এবং অপ্রয়োজনীয় ডাল ছেটে দিতে হবে।
গ. গাছের চাহিদার অতিরিক্ত সার দেয়া হলে গাছ চেয়ে পাতা বড় হবে ও ডগা দুটি বেঁধে যাবে এবং ফুল ছোট হবে। এ অবস্থায় গাছের ডগা ছেটে দিতে হবে।
ঘ. চারা লাগানোর ১৫ দিন পর থেকে প্রতি ১৫ দিনে একবার পরিমাণ মতো তরল সার এবং মাসে একবার মাছের গুড়া চাপান সার হিসেবে দিতে হবে।
ঙ. গাছে কুড়ি আসার সময় একবার বা দুইবার অ্যামোনিয়াম সালফেট বা ইউরিয়া বা অন্য কোন নাইট্রোজেন সার প্রয়োগ করতে হবে।
চ. নাইট্রোজেন সার বেশি মাত্রায় দেয়া যাবেনা। কেননা তাতে ফুলের আকার ছোট ও রঙ ফ্যাকাসে হবে।
ছ. অতিরিক্ত পর্যাপ্ত পটাশ সার দিলে ফুলের রঙ ভালো হয় এবং অতিরিক্ত ফসফরাস সার দিতে ফুলের রঙ খারাপ হয়। তাই ফসফরাস সার বেশি মাত্রায় দেয়া যাবেনা।
জ. গাছের গোড়ার মাটি নিয়মিত আলগা করে দিতে হবে এবং আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। তবে মাটি সাবধানে খুড়তে হবে যাতে গাছের শেকড় না কাটে।
ঝ. গাছ বড় হলে প্রতিটি গাছে ৩ থেকে ৪টি বড় শাখা রেখে বাকীগুলি ছেঁটে দিলে ফুল বড় বড় হবে।
ঞ. প্রদর্শনীর জন্যে বড় ফুল পেতে পাশের কুড়ি ছেঁটে দিয়ে নিয়মিত সার প্রয়োগ, জলসেচ ও রোগ বালাই দমন করতে হবে।
ট. গোবর সার ও সরিষার খইল ভিজিয়ে তরল সার তৈরী করে চারা রোপণের পরের মাস থেকেই দিতে হবে এবং কুড়ি আসার সময় তরল সারে সামান্য ইউরিয়া মিশিয়ে দিতে হবে।
ঠ. গাছ ২৫ থেকে ৩০ সেঃ মিঃ লম্বা হলে প্রধান শাখাটি কোনো বাউনীতে বাড়িলে দিলেও তাতে ছোট ছোট শাখা বের হবে এবং ফুলের উৎপাদন হবে।
ফুল সংগ্রহ:
চন্দ্রমল্লিকা গাছ একবার মার্চ থেকে জুলাই এবং পুনরায় সেপ্টেম্বর থেকে জানুয়ারী মাস পর্যন্ত বৃদ্ধি হয় ও ফুল দেয়।
ক. চন্দ্রমল্লিকার ফুল গাছ হতে তোলার পরও বেশ ক’দিন টাটকা থাকে এবং দূরে পাঠানো যায়।
খ. যখন বাইরের পাপড়ি পূর্ণভাবে ফুটে এবং মাঝের পাপড়ি ফুটতে শুরু করে তখনই ফুল তোলার সময়।
গ. লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে কুড়ি অবস্থায় তোলা না হয়, কেননা এ অবস্থায় তুললে ফুল ফোটে না।
ঘ. ফুল বোটাসহ তুলে এর বোটাগুলি বালতির জলে ডুবিয়ে রেখে তারপর প্যাক। করে বাজারে পাঠাতে হবে।
তথ্যসূত্র:
১. সিরাজুল করিম আধুনিক পদ্ধতিতে ফুলের চাষ প্রথম প্রকাশ ২০০১ ঢাকা, গতিধারা, পৃষ্ঠা ৯৪-৯৭। আইএসবিএন 984-461-128-7
জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ সম্মান ও এমএ পাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। বিভিন্ন সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রোদ্দুরে ডট কমের সম্পাদক।