পরিচিতি: পাহাড়ি ভাঁট বা ঘেঁটু গুল্ম জাতীয় দেশি বুনো সপুষ্পক উদ্ভিদ। ফুল গাছটি ভাঁট বলে পরিচিত হলেও স্থানভেদে এবং ভিন্ন ভিন্ন জনগোষ্ঠীতে এর ভিন্ন ভিন্ন নামও রয়েছে। অনেকে একে বনজুঁই বলেন। কোথাও বলা হয় ভাঁটি, কোথাও ঘণ্টকর্ণ। সংস্কৃতে একে বলে ঘণ্টা, ঘণ্টাকর্ণ, বাণবিড়।
ভাট একটি বুনো ফুল, পথের ধারে জংলা যায়গায়, গায়ের মাঠের ধারে অযত্নে ফুটে থাকে এই ফুল। এক এক ঋতুতে ভাঁট গাছে একেক রঙ নেয়। ঋতু পরিবর্তনে ফুলের গন্ধেও পরিবর্তন আসে। গাঢ় সবুজ গাছগুলো বর্ষায় পাতা মেলে নতুন রূপে সেজে ওঠে। আদর করে কেউ বাগানে রোপণ করে না। আর ফুলটি সুবাস ছাড়ে রাতে। দিনের বেলা শুকে দেখেছি হালকা সুবাস থাকে তখনও, তবে ছড়ায় না। ফুল ফোটার পর মৌমাছিরা ভাঁট ফুলের মধু সংগ্রহ করে।
আরো পড়ুন: ভাঁট বা ঘেঁটুর নানা ভেষজ গুণ
পাহাড়ি ভাঁট বা ঘেঁটু-এর বিবরণ:
ভাঁট ১-২ মিটার উচ্চতার ছোট ছোট গাছ। এদের পাতা সরল। দেখতে সবুজ, অমসৃণ এবং চারপাশে খাঁজ কাটা। পাতার নিচের শিরাগুলো স্পষ্ট। পাতা নরম লোমশ। পাতার প্রান্ত খণ্ডিত রোমশ। হৃদপিণ্ডের মতো আকার, অগ্রভাগ ক্রমশ সরু, পাতার বোঁটা আছে। এদের ডিম্বাকার বা হৃৎপিণ্ডাকার। গাছের পাতা লম্বায় ১২ থেকে ১৫ সেন্টিমিটার হয়। চ্যাপ্টায় হয় ১০ থেকে ১২ সেন্টিমিটার। পাতার বোটা ১-৪ ইঞ্চি লম্বা। কাণ্ড অপেক্ষাকৃত শক্ত ও নমনীয়। সহজে ভাঙে না। মার্চ-এপ্রিল মাসে ফুল ফুটে। ভাট ফুলের রং ধবধবে সাদা। প্রতিটি ফুলে ৫টি করে পাপড়ি থাকে। পাপড়ির গোড়াতে থাকে সামান্য বেগুনী রঙের পোঁছ। ফুলের কেন্দ্র থেকে ৪টি করে ৩ সেন্টিমিটারের মত লম্বা মঞ্জুরি (পুংকেশর) ফুলের সামনের দিকে বেরিয়ে আসে, সামনের অংশে থাকে কালো দানার মত। ফুলের নিচের লাল রঙের বৃন্তগুলোর ভিতর একটি কালো ফল হয়। ফল ড্রপ। চ্যাপ্টা রঙ কালো। শীতের শেষে ফুল ও গরম কালে ফল ধরে। বীজ থেকে চারা হয়। এ ছাড়াও কন্দ থেকে চারা হয়।
ব্যবহার:
ভাঁটের রয়েছে ঔষধি গুণ। ভাঁট হলো গ্রামবাংলার পথের ওষুধ। দেশের সর্বত্র আদিবাসী ও বাঙালি সমাজে এর ব্যবহার আছে। গ্রামের কবিরাজরা নানা কাজে ভাঁটের পাতা, কাণ্ড ও শেকড় ব্যবহার করেন। কেবলমাত্র মানুষ নয়, গরু-ছাগলের চিকিৎসাতেও ভাঁটের মূল ও পাতা কাজে লাগে। পুরনো ভাঁট গাছের ঝোপ ছোট পাখি ও খুদে সরীসৃপদের বাসস্থান। কোথাও কোথাও এ ফুল দিয়ে ঘণ্টাকর্ণ ও ভাঁটি পূজা হয়। এই ফুল রোগবালাই ও আপদবিপদ দূর করে বলে অনেকে বিশ্বাস করেন।
এদের রস তিতা বলে সহজে কেউ খেতে চায় না। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে শরীরে জ্বর লেগে থাকলে, গেটেবাতে ও আমাশয় ও পেট ব্যথায় ভাঁটের কচি ডগার রস কয়েক দিন সকালে খেলে রোগ ভালো হয়ে যায়। ভাঁটপাতার রস কৃমিনাশক। এর পাতা অ্যাজমা, টিউমার, সাপের কামড় ও চর্ম রোগে ব্যবহার হয়। মূলের নির্যাস দাঁতের ক্ষয়রোগ, পেটব্যথা, ও হিস্টিরিয়ার উপশম করে। যে কোনো চর্মরোগে ভাঁটপাতার রস ৩-৪ দিন লাগালে আশ্চর্যজনক ফল পাওয়া যায়। উকুন হলে ভাঁট পাতার রস লাগিয়ে ১ ঘণ্টা পর ধুয়ে ফেলবেন। উকুন থাকবে না। ম্যালেরিয়াতেও এর ব্যবহার দেখা যায়।
বিস্তৃতি:
গ্রাম-বাংলার পথঘাট মাঠের চিরচেনা এই ভাঁটফুল। বাংলাদেশের সর্বত্র কম-বেশি এর বিস্তৃতি আছে। মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের বনাঞ্চল ও পাহাড়ের আঁকাবাঁকা রাস্তার পাশে ভাঁট গাছ বেশি দেখা যায়। সাধারণত পথের ধারেই ভাঁট গাছ জন্মে থাকে। বেড়ে ওঠে অবহেলা আর অনাদরে। গ্রামের মেঠো পথের ধারে, পতিত জমির কাছে এরা জন্মে থাকে এবং কোনরূপ যত্ন ছাড়াই প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠে। এছাড়াও পাহাড়ি বনের চূড়ায় এবং পাহাড়ি ছড়ার পাশে এদের উপস্থিতি বিশেষভাবে লক্ষনীয়।
বিবিধ: Clerodendrum গণে ৪০০-এর অধিক প্রজাতি রয়েছে এবং বাংলাদেশে রয়েছে অন্তত ৩টি প্রজাতি।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।