আফিং বা আফিম হচ্ছে ভেষজ গুণসম্পন্ন বর্ষজীবী গুল্ম

গুল্ম

আফিং বা আফিম

বৈজ্ঞানিক নাম: Papaver somniferum L., Sp. Pl. 1: 508 (1753). সমনাম: Papaver officinale C. C. Gmelin (1806), Papaver hortense Hussenot (1835), Papaver setigerum DC. (1893). ইংরেজি নাম: Opium Poppy, Maw/seed. স্থানীয় নাম: আফিং, আফিম, পোস্তদানা।

ভূমিকা: আফিং বা আফিম (বৈজ্ঞানিক নাম: Papaver somniferum)হচ্ছে ভেষজ গুণসম্পন্ন বর্ষজীবী গুল্ম। ফল পাকলে তা থেকে বীজ সংগ্রহ করা হয়। এগুলোই দেখতে পোস্তদানা মতো। পোস্তদানা, ফল, আঠা, ফুল ও ফুলের পাপড়ি সবগুলোই ঔষধরূপে ব্যবহৃত হয়।

আফিং বা আফিম-এর বর্ণনা:

বর্ষজীবী খাড়া বীরুৎ, মসৃণ অথবা উদ্ভিদটির নিচের অংশ বা মঞ্জরীদন্ড কিঞ্চিৎ কুর্চ সদৃশ রোমাবৃত, ০.৫-১.০ মিটার উঁচু, কিঞ্চিৎ শাখান্বিত। পাদদেশীয় পাতা খর্বাকার বৃন্তবিশিষ্ট, বৃন্ত ১-২ সেমি লম্বা, ফলক ডিম্বাকার-দীর্ঘায়ত, ১৫-২৫ X ৮-১৫ সেমি;

পাদদেশ গোলাকার বা হৃৎপিণ্ডাকার, শীর্ষ তীক্ষাগ্র, অগভীরভাবে পক্ষল খন্ডিত, খস্তক ত্রিকোণাকার, স্থূল দপ্তর, চকচকে সবুজ, উপরের দিকের কান্ডজ পাতা খর্বাকার, অতি অগভীরভাবে খন্ডিত অথবা অখন্ডিত, পাদদেশ হৃৎপিণ্ডাকার-কান্ডবেষ্টক।

আরো পড়ুন: আফিম বা আফিং গুল্মে আছে নানাবিধ ভেষজ গুণাগুণ

পুষ্প মুকুল ডিম্বাকার-দীর্ঘায়ত, স্থূলাগ্র, ১.৫-৩.০ x ১-২ সেমি। পুষ্প একক, গভীর পেয়ালাকৃতির, আড়াআড়িভাবে ২-১০ সেমি, পুষ্পবৃন্ত ৩-২০ সেমি লম্বা। বৃত্যংশ ২টি, স্কুল ডিম্বাকার, মসৃণ, সবুজ, শীঘ্র আশুপাতী।

পাপড়ি ৪টি, বিডিম্বাকার, বর্তুলাকার, আড়াআড়িভাবে ৩-৯ সেমি, কিনারা ঢেউখেলানো অথবা বিবিধভাবে খন্ডিত, সাদা, গোলাপী, লাল, বেগুনি অথবা বিবিধ বর্ণের, কখনও পাদদেশ কালচে আভাবিশিষ্ট।

পুংকেশর অনেক, পুংদন্ড সূত্রাকার, ৫-১০ মিমি লম্বা, হলুদাভ, পরাগধানী দীর্ঘায়ত, ১.০-১.৫ মিমি লম্বা, হলুদাভ বা ননী বর্ণ। গর্ভাশয় গোলকাকার, ৫-১২টি খন্ডকময় অগ্রস্থ চক্রবিশিষ্ট এবং যাহা অবৃন্তক গর্ভমুণ্ড বহন করে।

ফল ক্যাপসিউল, গোলকাকার, উপগোলকাকার বা ডিম্বাকার, ২-৭ x ৫-৬ সেমি, পাদদেশ গোলাকার, শীর্ষ সমতল, মসৃণ, গর্ভমুণ্ডের চক্র বর্ধিত, শুষ্ক ঝিল্লি সদৃশ, ৭-১৮টি রশ্মিবিশিষ্ট। বীজ গোলকাকার, ৩ মিলি (প্রায়) ব্যাসবিশিষ্ট, সাদা বা ধূসরাভ বাদামী অথবা ধূসরাভ কালো। ক্রোমোসোম সংখ্যা: 2n = ২০, ২২, ৪৪ (Kumar and Subramaniam, 1986).

আরো পড়ুন:  লতাফুটকি বহুবর্ষজীবী ভেষজ গুণসম্পন্ন আরোহী গুল্ম

আফিং বা আফিম-এর চাষাবাদ:

পপি বা আফিম ফুলের সৌন্দর্যে আলোকিত হয়ে ওঠে। সমতল অঞ্চলে অক্টোবর মাসে ও পার্বত্য অঞ্চলে মার্চ মাসে পপির বীজ স্থায়ী জমিতে বপন করতে হয়। কারণ চারা তৈরি করে তুলে লাগানোর সময় চারা মারা যেতে পারে। হালকা বেলে এবং দো-আঁশ মাটি পপি চাষের উপযোগী।  বংশ বিস্তার হয় বীজের সাহায্যে।

বিস্তৃতি:

আদিনিবাস দক্ষিণ ইউরোপ যেখানে সৌন্দর্য্য বর্ধনের জন্য এবং ঔষধ শিল্পের জন্য ব্যাপকভাবে এবং চীনের অনেক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে চাষ করা হয়। আফগানিস্তান, ভারত, লাওস, মায়ানমার, থাইল্যান্ড (উত্তরাঞ্চল) এবং বাংলাদেশেও অবৈধভাবে চাষ করা হয়।

আফিং বা আফিম-এর অর্থনৈতিক ব্যবহার ও গুরুত্ব:

এই উদ্ভিদটি হেরোইন, মরফিন এবং অন্যান্য উপক্ষারের উৎস যাহা মাদক ব্যবসায় এবং ঔষধে ব্যবহৃত হয়। অপরিপক্ক ফলের তরুক্ষীর থেকে ওপিয়াম প্রস্তুত করা হয়। অপরিপক্ক ফলের কাটা স্থান থেকে সাদা তরুক্ষীর চুয়ে পড়ে যাহা দ্রুত কঠিনাকার এবং বাদামী বর্ণ ধারণ করে।

ক্যাপসিউল থেকে প্রাপ্ত বীজ মসলা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বাণিজ্যিক ওপিয়াম ঔষধে এবং ঔষধ হিসেবে গুরুত্বপুর্ণ কতিপয় উপরের উৎস হিসেবেও ব্যবহৃত হয়; ইহা নিদ্রাকারক হিসেবেও ব্যবহৃত হয়।

শুষ্ক ফল ইউরোপে কাশিতে এবং চীনে ডায়রিয়া ও কাশি নিরাময়ে ব্যবহৃত হয়। থাইল্যান্ডের উত্তরাঞ্চল এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশে ব্যাথানাশক, ডায়রিয়া, কাশি এবং অনিদ্রায় অথবা তন্দ্রা আনয়নকারী হিসেবে ওপিয়াম ব্যবহৃত হয়।

কখনও ইহা সেবন করা হয়, কিন্তু অধিকাংশক্ষেত্রেই ইহা ধুমপানের মাধ্যমে করা হয় যাহা এক প্রকার নেশা এবং ব্যক্তিত্বকে ধ্বংস করে দেয়। কোষ্ঠবদ্ধতাকারী গুণাবলীর জন্য ওপিয়াম পরিচিত।

পরিমিত মাত্রার ওপিয়াম মিশ্রণ এবং প্রযুক্ত ওপিয়াম মারাত্বক পর্যায়ের ডায়রিয়া এবং আমাশয় চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। একইভাবে বেদনা নাশক হিসেবে, কাশি এবং বমি বমি ভাব দূর করতেও ব্যবহৃত হয়।

যদিও এখন পর্যন্ত অনেক দেশের রাষ্ট্রীয় ওষুধনীতিতে শোধিত উপক্ষার প্রধানত মরফিন, কোডেইন এবং নোসক্যাপাইন এর ব্যবহার ওপিয়াম ও ওপিয়ামজাত দ্রব্যের ক্ষেত্রে ব্যাপকস্থান করে নিয়েছে।

আরো পড়ুন:  নিসিন্দা গাছের ২৮টি ভেষজ গুণাগুণ ও ব্যবহার পদ্ধতি জেনে নিন

P. soutiferum থেকে খাওয়ার উপযোগী বীজ ও বীজ তৈল পাওয়া যায়। ইহার বীজ কেক ও রুটিতে ব্যবহৃত হয়। ইহা পাখির খাদ্যেও ব্যবহৃত হয়। পপি বীজ তৈল প্রধানত ভৈজ্য তৈল হিসেবে ব্যবহৃত হয়, এছাড়াও রং ও সাবান তৈরিতেও ব্যবহৃত হয়।

তৈল নিষ্কাশেনের পরে প্রাপ্ত পপি বীজ কেক মিষ্ট এবং গবাদি পশু ও অন্যান্য প্রাণীর খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু ইহার বীজ ক্যাপসলের অংশবিশেষ কর্তৃক কলুষিত হওয়ার কারণে উপক্ষার বিদ্যমান থাকায় প্রানী খাদ্য হিসেবে ব্যবহার কখনও কখনও বিষাক্ত হয়ে থাকে (de Padua et al., 1999). জাতিতাত্বিক ব্যবহার: দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিছু কিছু আদিবাসী ইহার কচি পাতা ভক্ষণ করে থাকে।

আফিং বা আফিম-এর অন্যান্য তথ্য:

বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষের  ৯মখণ্ডে (আগস্ট ২০১০) আফিং প্রজাতিটির সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, এদের শীঘ্র কোনো সংকটের কারণ নেই যদিও তবে ইহার চাষাবাদ ও রোপন সরকারীভাবে নিষিদ্ধ আছে।

বাংলাদেশে আফিং সংরক্ষণের জন্য কোনো পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি। প্রজাতিটি সম্পর্কে প্রস্তাব করা হয়েছে সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণে বোটানিক গার্ডেনসমূহে কতিপয় উদ্ভিদটি সংরক্ষণ করতে হবে। 

তথ্যসূত্র:

১. এম আমান উল্লাহ (আগস্ট ২০১০) “অ্যানজিওস্পার্মস ডাইকটিলিডনস” আহমেদ, জিয়া উদ্দিন; হাসান, মো আবুল; বেগম, জেড এন তাহমিদা; খন্দকার মনিরুজ্জামান। বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ (১ সংস্করণ)। ঢাকা: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। খন্ড ৯ম, পৃষ্ঠা ৩৭৯-৩৮০। আইএসবিএন 984-30000-0286-0

বি. দ্র: ব্যবহৃত ছবি উইকিপিডিয়া কমন্স থেকে নেওয়া হয়েছে। আলোকচিত্রীর নাম: Kora27

Leave a Comment

error: Content is protected !!