ভাঁট বা ঘেঁটু গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ। সাধারণতঃ ৩ থেকে ৪ ফুট উচু হতে দেখা যায়, কচি কাণ্ডের গায়ে শ্বেতবর্ণের রোম আছে। শাখা ও প্রশাখা খুব কম। পাতা লম্বায় ৪ থেকে ৮ ইঞ্চি পর্যন্ত হয়ে থাকে, দেখতে অনেকটা ডিম্বাকৃতি তবে অগ্রভাগ ক্রমশঃ সরু, খসখসে ও বোঁটা ১-৩ ইঞ্চি লম্বা, মলকাণ্ড ও শাখার অগ্রভাগে ৬-১২ ইঞ্চি লম্বা পপদণ্ড বের হয়, তাতে গুচ্ছাকারে বহু, শ্বেতবর্ণ ও লাল আভাযুক্ত ফল হয়, এর বহিরাবরণ রোমক। ফলের ব্যাস ৩ ইঞ্চি, চেপ্টা ও কালো রঙের। শীতের শেষে ফুল ও গ্রীষ্মকালে ফল হয়। পশ্চিমবাংলায় প্রায় সর্বত্র এবং ভারতের অঞ্চল বিশেষে কম বেশী এটি জন্মে। সাধারণতঃ জঙ্গলের ধারে, পতিত জমিতে জন্মে থাকে।
অন্যান্য নাম:
এর সংস্কৃত নাম “ঘণ্টাকর্ণ”, বাংলায় প্রচলিত নাম ঘেণ্ট, ভাঁট ও হিন্দীতে ভাঁট নামে পরিচিত। বৈজ্ঞানিক নাম Clerodendrum viscosum Vent., ফ্যামিলি Verbenaceae.
ভাঁট বা ঘেঁটু-এর বিভিন্ন অসুখে ব্যবহার:
এটি স্বাদে তিক্তরসান্বিত, বলকারক, কামোদ্দীপক, পিত্ত বিকারে ও কফে হিতকর ও ব্যথা-বেদনানাশক। ঔষধার্থ এই গাছের পাতা, মূল ব্যবহার করা হয় পেটের অসুখ, চর্মরোগ ইত্যাদি রোগের ঘরোয়া ভেষজ ওষুধ হিসাবে।
১. ক্রিমির উৎপাতে: এ গাছের পাতার রস খুবই তিতা স্বাদের হয়। চিরতার পরিবর্তে এর রস ব্যবহার করলে ক্রিমি মরে যায়। যদি পেটে ছোট ছোট ক্রিমি হয়, তাহলে মলদ্বার দিয়ে পিচকারি দিলে সব ছোট ক্রিমি মরে যায়।
যেকোন ধরনের ক্রিমি—সে যে বয়সেই হোক না কেন, এই ঘেটু পাতার রস এক চা-চামচ ২/৩ চামচ জল মিশিয়ে সকালের দিকে খালি পেটে খেতে হবে। এইভাবে কয়েকদিন খেলে এর দ্বারা যেকোন ধরনের ক্রিমির উপদ্রবের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যাবে, এবং কুচো কিমিগুলি মরে গিয়ে মলের সঙ্গে পড়ে যাবে।
এমন কি “কেচো ক্রিমিও বেরিয়ে যায়। তবে একটা বিষয়ে সাবধান থাকতে হয়, এটাতে খুবই ক্ষুধার উদ্রেক হয়, তাই বলে এই সময় যে দ্রব্য আহারে মধুর রসের আধিক্য বাড়ে সেই ধরনের কোন দ্রব্য ব্যবহার করতে নেই, তাহলে ক্রিমির উৎপাত কমানো যায় না।
২. কাঁকড়া বা বিছার কামড়ে: ভাঁট বা ঘেঁটু গাছের পাতা এবং ফুল শিল দিয়ে সামান্য পানি সাথে বেটে দশংনের জায়গায় প্রলেপ দিলে যন্ত্রণা কমবে এবং বিষও বিনষ্ট হয়ে যাবে।
৩. ম্যালেরিয়ায়: এই জ্বর বেশ কিছুদিন ভোগ করলে আমাদের রক্তবহ স্রোতের মূল কেন্দ্র যে যকৃত আর প্লীহা সেটা বাড়তে থাকে, তার ফলে প্রথমেই দেখা দেয় পাডুরোগ, মূত্রের পরিমাণ কমে যাবে, তারপরে অজীর্ণ, তারপরে পেটের দোষ একটু একটু করে সরে হবে;
এমন অবস্থা এলে তো করবেনই, কিন্তু কিছু আগে থেকেই সাবধান হলে ক্ষতি কি? তাই বলছি প্রথমাবস্থায় ঘেটুপাতার রস এক চাচামচ ৭/৮ চামচ জল মিশিয়ে একটু, গরম করে সকালে ও বৈকালে ২ বার খেতে হবে।
৪. টিউমারে: ঘেঁটুর মূল বেটে টিউমারের ফোলা অংশে ভালোভাবে প্রলেপ দিয়ে তার ওপর কাপড়ের ফালি জড়িয়ে রাখা দরকার। কিছুদিন নিয়ম করে প্রয়োগ করতে হবে।
৫. বিভিন্ন চর্মরোগে: দেহের যে কোন চর্মরোগে ঘেঁটু পাতাকে থেঁতো করে রাতে শোয়ার সময় প্রলেপ দিয়ে পরিষ্কার পাতলা কাপড়ের ফালি ছিড়ে বেঁধে দিতে হবে। এরকম চার পাঁচ দিন করলেই চর্মরোগ সেরে যাবে।
৬. কোষ্ঠবদ্ধতায়: ভাঁট বা ঘেঁটু পাতার রস ৩০ মি.লি. পরিমাণ সকালে খালিপেটে খেলে পেট পরিষ্কার হয়ে যায়। তবে এ পরিমাণ বয়স্কদের জন্যে। শিশু অথবা বালক বা অল্প বয়স্কদের এর অর্ধেক পরিমাণ একইভাবে খাওয়াতে হবে। গাছের ডালের ওপরের দিকের কচি পাতা সংগ্রহ করে পরিষ্কার করে শিলে সামান্য পানি দিয়ে বেটে রস বের করা দরকার।
৭. পেটের যন্ত্রণায়: পেটে মল জমলে অথবা দীর্ঘদিন ধরে বদহজমে ভুগলে মাঝে মাঝে পেটে যন্ত্রণা করে। ঘেঁটুর মূলের ৫ থেকে ৭ গ্রাম পরিমাণ রস এক গ্লাস ঘোলের সাথে মিশিয়ে খেলে যন্ত্রণা থাকে না।
পেট ব্যথায় যে ব্যথা অজীর্ণে ভোজনজনিত কারণে আসে, সে ব্যথাটা হয় কুনকুনে। এর সঙ্গে থাকে পেটে অস্বস্তি। এইভাবে খানিকক্ষণ থাকার পর আর অনুভূত হয় না, তখন মনে হয় এখন আর কিছু নেই, সব হজম হয়ে গিয়েছে। তারপর আবার গুরপাক কিছু খাওয়া হলো। তারপর আর হজম হলো না, কারও বা পাতলা দাস্ত হতে থাকলো আবার কারও ভেদ বমি দুটোই হতে থাকে; তার সঙ্গে এসে জোটে পিপাসা, তখন ঠাণ্ডা পানীয় খেতে ইচ্ছে হয়। এরই পরিণামে আসে অন্ত্রে ক্ষত।
এই ধরনের ক্ষেত্রে ঘেটু মূলের ছাল ৩ থেকে ৪ গ্রাম টাটকা ঘোলে বেটে, ছেকে নিয়ে এটা খেলে ওই অজীর্ণজনিত উপসর্গগলি চলে যাবে। দরকার হলে এটা সকালে-বৈকালে দু’বারও খাওয়া যায়। অজীর্ণে ভোজনের এই কুঅভ্যাসটা কিন্তু ভাল নয়। এই ভাঁট বা ঘেঁটু মূলের ছাল দুই/একদিন সামলে দিতে পারে, কিন্তু নিত্য অত্যাচার করবো আর ঘেটু মূলের ছাল খাবো এটা চলে না।
৮. মাথার উকুনে: গোসল করার তিন ঘণ্টা আগে টাটকা ঘেঁটু পাতার রস মাথায় ভালোভাবে মাখলে উকুন মরে যায়। তবে নিয়ম করে তিন থেকে চার দিন ব্যবহার করা দরকার।
৯. শরীরে বলবৃদ্ধি: দীর্ঘ রোগ ভোগের পর শরীর দুর্বল হলে ঘেঁটুপাতার রস রোজ তিন থেকে চার চামচ পরিমাণ খেলে শরীরে দ্রুত পূর্বের বল ফিরে আসে।
CHEMICAL COMPOSITION
Clerodendrum viscosum Vent.
Clerodendrum infortunatum 1. Clerodin. 2. Sterol. 3. Xanthophyll. 4. Carotene. 5. Leaves contain : – (a) Ash 8.0%; (b) Protein 21.2%; (c) crude fibre 14.8%; (d) Reducing sugars 3.0%; (e) Total sugars 17.0%. 6. Leaves contain a fixed oil consisting of (a) linolenic acid; (b) Oleic acid; (c) Stearic acid; (d) Lignoceric acid.
সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।
তথ্যসূত্র:
১. আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য: চিরঞ্জীব বনৌষধি খন্ড ৪, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৩৮৩, পৃষ্ঠা, ৪০-৪৩।
২. আঃ খালেক মোল্লা সম্পাদিত;লোকমান হেকিমের কবিরাজী চিকিৎসা; মণিহার বুক ডিপো, ঢাকা, অক্টোবর ২০০৯; পৃষ্ঠা ৪৩-৪৪।
জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ সম্মান ও এমএ পাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। বিভিন্ন সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রোদ্দুরে ডট কমের সম্পাদক।