নীল টেংরাকাঁটা ভেষজ গুণাগুণের বিবরণ

নোনা জলের ধারে সুন্দরবন অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে জন্মে। এছাড়া দক্ষিণবঙ্গের খালের ধারে বিক্ষিপ্তভাবে জন্মে থাকে। এটি অযত্নে জন্মাতে পারে। তবে কোথাও কোথাও নদীর ধারে মাটির ভাঙ্গন রোধ করার জন্য লাগানো হয়। গাছ ২ থেকে ৫ ফুট লম্বা, চিরহরিৎ। গাছের গোড়ার দিকটা বেশ শক্ত, কাঠাল। পাতা আয়তাকার, মসৃণ, কিনারা ঢেউ খেলানো এবং ডগায় কাঁটা থাকে। ফুল নীল রঙের, এক একটি জোড়ায় ফোটে। ফল আয়তাকার, ইঞ্চিখানিক লম্বা, খয়েরী রঙের। বীজ চ্যাপ্টা, ডিম্বাকৃতি, ইঞ্চি ব্যাসযুক্ত। ফলে ৩ থেকে ৪টি বীজ থাকে। গ্রীষ্মকালে ফুল ও ফল হয়।

এই গাছটি নোনা জলের ধারে হয়। অনেক সময় দেখা যায় যে, দিনের পর দিন জলে দাঁড়িয়ে থাকলেও গাছ পচে না। জোয়ার-ভাটা খালের ধারে তো প্রত্যহ ডুবছে আর উঠছে। ফুল ফোটার আগে গাছ কেটে কাঁটা বাদ দিয়ে সেই পাতা সমেত গাছ গবাদি পশুর খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়, কারণ এই উদ্ভিদটির Calorifie Value অত্যন্ত বেশি। সব রকমের নাম তো পূর্বেই বলা হয়েছে। এর বোটানিক্যাল নাম Acanthus ilicifolius Linn., ফ্যামিলী Acanthaceae. ঔষধার্থে ব্যবহার্য অংশ— সমগ্র গাছ ও মূল।

নীল টেংরাকাঁটা-এর গুণাগুণ

সমগ্র ভেষজটি ক্ষার স্বভাবের। নীল টেংরাকাঁটা গাছের ক্বাথ কফনাশক, দুগ্ধবর্ধক, পিত্তজনিত শোথ নিবারক, মূত্রকারক, অজীর্ণ ও অম্লনাশক। পাতার প্রলেপ বাতব্যাধি ও স্নায়ুশূলে উপকারী। মূল ও গাছের ক্বাথ হৃদ্য, হৃদয়ের রোগে ব্যবহার্য। এটি কফকে তরল করে উঠিয়ে দেয়। এজন্য কাসি ও হাঁপানিতে কাজ করে। তাছাড়া এই ক্বাথ কৃশতাকারক, শ্বেতপ্রদর, মেদরোগ, পক্ষাঘাত, জ্বরাম্ভিক দুর্বলতা প্রভৃতি ক্ষেত্রে ব্যবহার্য। সমগ্র ভেষজটির ক্ষার অম্লপিত্তে হিতকর। মূলের ক্বাথ অল্প গরম অবস্থায় কুলকুচা করলে দাঁতের ব্যথা ও মুখের ঘা সারে।

পাতাটিতে রয়েছে—কার্বহাইড্রেটস্, লিপিডস্, প্রোটিন, নাইট্রোজেন, নন-প্রোটিন নাইট্রোজেন, কোবাল্ট, কপার, ম্যাঙ্গানিজ, মডিবডেনাম, জিঙ্ক প্রভৃতি। এই উদ্ভিদ থেকে অ্যাকানথিসিফোলিন নামক একটি উপক্ষার বর্তমান প্রাণী রসায়নবিদ্‌গণ আবিষ্কার করেছেন। এ ভিন্ন এতে ফ্লাভেনও পাওয়া যায় ।

আরো পড়ুন:  সিলেটি ঢেকিয়া বাংলাদেশ ও ভারতে জন্মানো সংকটাপন্ন শাক

ঔষধি ব্যবহার

এই গাছের ও মূলের ক্বাথ বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে মোটামুটিভাবে যে ফল পাওয়া গেছে, সেটাই উল্লেখ করা হলও।

১. মেদবৃদ্ধিতে: বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে একটু অসাবধানতা হলেই দেহে মেদের সঞ্চার হতে থাকে। সাধারণতঃ এটি ৩৫ থেকে ৩৬ বছরের পরই দেখা দেয়। দীর্ঘদিন হালকা চেহারায় থাকতে থাকতে একটা বয়সের পরে শরীরে মেদ জমা, সামান্য একটু হাঁটলে, সিঁড়িতে ওঠা-নামা করলে, একটু পেটভর্তি করে খেলে হাঁসফাঁস করতে থাকে শরীরটা, তখন বসে পড়া ছাড়া গতি থাকে না। ফলে জীবন হয়ে ওঠে জটিল, ভয়ের।

ECG, Serum Cholesterol প্রভৃতি পরীক্ষা প্রাথমিক ভাবে হতে থাকে। সাধারণতঃ ECG রিপোর্টে কোনো দোষ ধরা না পড়লেও প্রায় ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, Cholesterol-এর মাত্রা ২৫০-এর কাছাকাছি অথবা ওপরে। কারো আবার Blood Sugar হয়ে যাবার ভয় মনের মধ্যে দানা বাঁধে। প্রায় ক্ষেত্রে অম্ল থাকে।

এমতাবস্থায় কুচিকুচি করে কাটা হরিকুশের গাছ ও মূল ৪। ৫ গ্রাম নিয়ে ৪ কাপ জলে সিদ্ধ করে আন্দাজ কাপখানিক থাকতে নামিয়ে, ছেঁকে, ঠাণ্ডা হলে সেটিকে সকালের দিকে অর্ধেকটা এবং সন্ধ্যার দিকে অর্ধেকটা খেতে হবে। মাসখানিক খেলে অবস্থাটা যে আয়ত্তের মধ্যে আসছে, তা বুঝতে পারবেন। ৩। ৪ মাস খাওয়া প্রয়োজন।

২. হাঁপানিতে: শ্বাসকষ্ট, সঙ্গে কখনো প্রচুর পরিমাণে কফ বেরুচ্ছে, কখনো আবার আঠার মত অল্প একটু একটু বেরোয়, তখন কষ্ট আরও বাড়ে। এটিকে তমক শ্বাস বা Bronchial asthma বলা হয়। এক্ষেত্রে উপরিউক্ত পদ্ধতিতে প্রস্তুত হরিকুশের ক্বাথ ১০। ১৫ দিন লাগাতার খাওয়ার পর মাঝে মাঝে কিংবা প্রত্যহ একবার করে কিছুদিন খেলে অনেকদিন ভাল থাকা যায়।

সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।

তথ্যসূত্র:

১. আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য: চিরঞ্জীব বনৌষধি খন্ড ১১, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, সপ্তম মুদ্রণ ১৪২৬, পৃষ্ঠা, ২২১-২২৩।

আরো পড়ুন:  গিরিশোভন শাক এশিয়ার বর্ষজীবী ভেষজ গুল্ম

বি. দ্র: ব্যবহৃত ছবি উইকিমিডিয়া কমন্স থেকে নেওয়া হয়েছে। আলোকচিত্রীর নাম: Vengolis

Leave a Comment

error: Content is protected !!