কুলেখাড়া বা কান্তা কালিকা বা কুলিকারহা বা ক্ষরিক বা গোকুলকাঁটা (বৈজ্ঞানিক নাম: Hygrophila auriculata) হচ্ছে একান্থাসি পরিবারের হাইগ্রোফিলা গণের একটি একবর্ষজীবী, খাড়া, শাখাবিহীন বীরুৎ। একে চলতি কথায় কুলেখাড়ার গাছ, আবার কোনো কোনো জায়গায় কুলপো শাক বলে। এই কুলেখাড়ার রয়েছে অনেক ঔষধি গুনাগুণ।
কুলেখাড়ার কাণ্ড কন্টকময়, দেড় দুই ফুট উচু হয়, আবার জায়গা হিসেবে ৩/৪ ফুটও উচু হতে দেখা যায়। কাঁটা ৬টি, ১.৫-৩.৬ সেমি লম্বা, সোজা বা বক্র কাক্ষিক কণ্টকবিশিষ্ট চতুষ্কোণী এবং পর্বে ৮টি অবৃন্তক বা অর্ধবৃন্তক পাতা বিশিষ্ট।[১] কুলেখাড়া সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য নিচের লিংকের লেখাটি পড়ুন
কুলেখাড়া ভেষজ গুণাগুণ সম্পন্ন একটি শাক
গাছ জন্মানোর পরে প্রথমদিকে গাছে কোনো কাঁটা হয় না; আশ্বিন-কার্তিকের পর থেকে পাতার গোড়া থেকে কাঁটা বেরোয়, ক্ষুপ জাতীয় গাছ। এখানে কুলেখাড়ার রোগ প্রতিকারসহ আরো কতিপয় ব্যবহার উল্লেখ করা হলো।
১. আমাশয় বা শোথে: পায়ের চেটো (যে অংশটার ওপর ভর দিয়ে আমরা হেঁটে বেড়াই) ফুলে যায়, এটা সাধারণতঃ পেটে আম (অপক্ক মল) জমার জন্য হয়; সেক্ষেত্রে কেবলমাত্র পাতার রস (ডাঁটা বাদ) ৪ চা-চামচ একটু গরম করে ছেকে, সকালে ও বিকালে দু’বার খেতে হবে; এর সঙ্গে ২/৫ ফোঁটা মধু দেওয়াও চলে। এর দ্বারা ঐ ফুলোটা চলে যাবে।
২. পাণ্ডু রোগে: এ রোগের লক্ষণ হ’লো শরীরের রং ফ্যাকাসে হওয়া (হলদে নয়), যাকে প্রচলিত ভাষায় বলা হয় ‘এনিমিয়া’। এক্ষেত্রে অমোঘ ঔষধ হ’লো, কেবলমাত্র কুলেখাড়া পাতার রস ৪ চা-চামচ একটু গরম করে দু’বেলা খাওয়া।
৩. বাতরক্ত: যে রোগে শরীরে ক্ষত হয়, ফেটে যায়, রস গড়ায়, আয়ুর্বেদে এটাকে বলা হয় বাতরক্ত; এক্ষেত্রে সমগ্র গাছকে থেতো করে ৪ চা-চামচ রস একটু গরম করে দু’বেলা খেতে হয়। এটা কিন্তু বাগভটের উপদেশ। এর সঙ্গে ঐ রস যদি গায়ে মাখা যায় ত’তে আরও তাড়াতাড়ি উপশম হয়। এটা বাংলার বৈদ্যককুলের প্রত্যক্ষ উপলব্ধ যোগ।
৪. অনিদ্রায়: কুলেখাড়া শিকড়ের (মূলের) রস ২ থেকে ৪ চা-চামচ সন্ধ্যার পর খাওয়ালে সুখনিদ্রা হয়, এটা হরীত সংহিতার উপদেশ।
৫. অশ্মরী (পাথুরী) রোগ: সে পিত্তের থলিতেই হোক আর কিডনিতেই হোক, পিত্তবিকারে যে পাথুরী (stone) হয়, সেখানে কুলেখাড়া বীজ আধ চা-চামচ আধ গ্লাস জলে গুলে সবটাই খেতে হয়।
৬. দীর্ঘস্থায়ি সম্ভোগে: যাঁরা ইচ্ছুক তাঁরা শোধিত আত্মগত (আলকুশী Mucuma prurita) বীজের গুড়ো আধ চামচ ও কুলেখাড়া বীজের গুড়ো আধ চামচ একসঙ্গে গরম দুধে গুলে খাবেন, এটার দ্বারা ঐ উদ্দেশ্যটা সিদ্ধ হবে। তবে এখানে একটা কথা বলা দরকার যে “তালমাখনা’ হলো কুলেখাড়া বীজ-এই যে অনেকের ধারণা আছে সেটা কিন্তু ঠিক নয়; বাজারে যেটা তালমাখনা বলে বিক্রি হয় ওটা পৃথক দ্রব্য, আর বাজারে যেটা কুলেখাড়া বা কোকিলাক্ষ বীজ বলে বিক্রি হয় ওটাও কুলেখাড়া বীজ নয়। আসল কুলেখাড়া বীজের রং অবিকল কোকিলের চোখের রং হবে।
৭. শোথে: সে যকৃৎ দোষেই হোক আর কিডনির দোষেই হোক, এই শোথ চলে যায়—যদি সমগ্র গাছ অন্তর্ধূমে দগ্ধ করে অর্থাৎ মুখঢাকা পাত্রে পুড়িয়ে যে ছাই পাওয়া যাবে, সেটাকে গুড়ো করে দু’বেলা এক গ্রাম (১৫ গ্রেণ) করে ঠান্ডা জল দিয়ে খাওয়া যায়, এর দ্বারা প্রস্রাব পরিষ্কার হবে এবং কয়েকদিনের মধ্যেই ফুলো কমে যাবে; এটা চক্রদত্তের উপদেশ।
৮. রক্তপাত রোধে: উড়িষ্যার গ্রামাঞ্চলে ক্ষেত-খামারে (ধান কাটার সময়) কোনো কিছুতে হাত বা পা কেটে বা ছ’ড়ে গিয়ে রক্ত পড়তে থাকলে এই পাতাকে থেতো করে ঐ কাটায জায়গায় চেপে দিয়ে বোধে দিলে; এর দ্বারা অতি শীঘ্রই রক্ত বন্ধ হয়ে যায়। আর ক্ষতও শুকিয়ে যাবে।
৯. হারপিসে: একে পোড়া নারেঙ্গাও বলে, এটি পিত্ত-শ্লেষ্মা-বিকৃতিজনিত রোগ; এ রোগে কুলেখাড়ার পাতা, কাঁচা হলুদ একসঙ্গে বেটে লাগাতে হয়, এটাতে জ্বালা যন্ত্রণা চলে যাবে এবং ক্ষতও শুকিয়ে যাবে।
১০. শীতলী রোগে: পায়ের শিরাগুলি কালো ও মোটা হয়ে কুচকে কোঁচোর মতো জড়িয়ে যায়, তার জন্য যন্ত্রণাও হয়। এক্ষেত্রে ঐ গাছপাতা বাটা লাগালে কাজ হবে, এর সঙ্গে ঐ কুলেখাড়ার পাতা রস করে ৪/৫ চা-চামচ ক’রে খেতে হবে।
১১. বাজীকরণে: অকালে যাদের যবজনোচিত রতিশক্তি কমে গিয়েছে, সেক্ষেত্রে এই কুলেখাড়ার মূল চূর্ণ ২ গ্রাম দুধ সহ খেলে এই অসুবিধেটা কিছুদিনের মধ্যে উপশমিত হয়। এটা চরক সংহিতার চিকিৎসাসস্থানে ২৬ অধ্যায়ে বলা হয়েছে। এই উদ্দেশ্যে সুশ্রুত সংহিতায়ও ব্যবস্থা দেওয়া হয়েছে ধারোঞ্চ দুধের সঙ্গে।
১২. ক্রোধী: কোনো অল্প কারণে হঠাৎ রেগে যায়, হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়, বিশেষত শৈশবাবস্থায়ও এটা দেখা যায় যে, অনেকে জেদীও থাকে; এক্ষেত্রে এই কুলেখাড়া পাতা ও ডাঁটা দিয়ে ঝোল করে বেশ কিছুদিন খাওয়ালে ওটার পরিবর্তন দেখা যাবে। আরও একটা লাভ হবে এটাতে যকৃৎকেও (লিভারকে) সক্রিয় করবে।[২]
সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।
তথ্যসূত্রঃ
১. মমতাজ বেগম, (আগস্ট ২০১০)। “অ্যানজিওস্পার্মস ডাইকটিলিডনস” আহমেদ, জিয়া উদ্দিন; হাসান, মো আবুল; বেগম, জেড এন তাহমিদা; খন্দকার মনিরুজ্জামান। বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ। ৬ (১ সংস্করণ)। ঢাকা: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। পৃষ্ঠা ৩৫-৩৬। আইএসবিএন 984-30000-0286-0
২. আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য: চিরঞ্জীব বনৌষধি, খন্ড ২, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৩৮৪, পৃষ্ঠা ২১-২৫।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।
খুব সুন্দর একটা লেখা।