শঙ্করজটা বা পৃশ্নিপর্ণী-এর বারোটি ভেষজ গুণাগুণ

শঙ্করজটা বা পৃশ্নিপর্ণী (Uraria Picta) গাছটি ৩–৪ ফুট লম্বা, এদের পাতা ৫–৬ ইঞ্চি লম্বা, ১ – ১.৫ ইঞ্চি চ‌ওড়া, পূষ্পবিন্যাস নলাকৃতি, চতুর্দিকে ঘনসংবদ্ধ, ফুলের রং গোলাপি, বর্ষায় ফোটে । অসামান্য ভেষজ গুণসম্পন্ন বর্ষজীবী গাছ, পূর্ব ভারত ও বাংলাদেশের দোয়াঁশ মাটিতে জন্মায়।

শঙ্করজটা বা পৃশ্নিপর্ণী-এর উপকারিতা

এটি প্রধানভাবে কাজ করে রসবহ স্রোতে।

১. কাসিতে: ধোঁয়া ধুলো অথবা কোন গন্ধ নাকে আসার পর যে কাসি হয়, তবে সে নতুনই হোক, আর পুররোই হোক, সেক্ষেত্রে চাকুলে ১০ গ্রাম একটু কুটে নিয়ে ৩। ৪ কাপ জলে সিদ্ধ করে আন্দাজ এক কাপ থাকতে নামিয়ে, ছে’কে ওই জলটা তিন-চার বারে একটু একটু খেতে হবে। শুধু এ কাসিই নয়, শরীরের রসবহ স্রোতে বাতপিত্তের বিকারজনিত কাসিতেও কাজ হয়। তাছাড়া আরও কতকগুলি কারণেও কাসি হয়, বিশেষতঃ ক্ষয়রোগে বুকে আঘাত লেগেও হতে পারে। এসব ক্ষেত্রেও ওই চাকুলের ক্বাথ পানীয় হিসেবেও ব্যবহার করা যায়।

২. অগ্নিমান্দ্যে: যে অগ্নিমান্দ্যটি কফ প্রাধান্য নিয়ে হয়, এর লক্ষণ হবে— খেয়ে যাচ্ছেন কিন্তু ক্ষিধে তেমন হয় না, সেক্ষেত্রে চাকুলে ১০ গ্রাম (সমগ্র গাছ) কুটে নিয়ে (আধ কুটা ক’রে) ৩ কাপ জলে সিদ্ধ করে এক কাপ থাকতে নামিয়ে, ছে’কে, সকালে ও বৈকালে দু’বারে ঐ সিদ্ধ ক্বাথটা খেতে হবে। তবে প্রয়োজনবোধে এটা ২০ গ্রামও ব্যবহার করার বিধি দেওয়া আছে। আর একটা পদ্ধতিতেও ব্যবহার করা যায়, ৫ গ্রাম চূর্ণ এককাপ গরম জলে ২। ৩ ঘণ্টা ভিজিয়ে রেখে, সেটাকে ছে’কে খেতে হবে। এটাতে কফজন্য যে অগ্নিমান্দ্য সেটা সেরে যাবে।

৩. শ্বাসে: যে শ্বাস শীতে, বর্ষায় ও শরতের আকস্মিক ঠাণ্ডা লেগে আরম্ভ হয় কিম্বা বুকের দুর্বলতায় কফ ও বায়ুর বিকারে (এই বিকার ঘটে প্রাণ ও উদান বায়ুর যে স্বাভাবিক সঞ্চরণশালিতা সেটা কফ কতৃক ব্যাহত হ’তে থাকলে) যে শ্বাসকষ্ট হয় সেক্ষেত্রে। তাই ব’লে যাঁদের হাঁপানি প্রকট আকার ধারণ করেছে, সেক্ষেত্রে এই ভেষজে ততটা কাজ হবে না, তবে আগন্তুক কারণের শ্বাসপ্রবাসে কষ্ট হ’তে থাকলে শঙ্করজটা চূর্ণ ৫ গ্রাম আধ কাপ গরম জলে ৩। ৪ ঘণ্টা ভিজিয়ে রেখে সেটাকে ছে’কে সেই জলটা খেতে হবে। তবে একটা কথা সবদাই মনে রাখতে হবে যে শ্লেম্মার সংযোগ না থাকলে শ্বাস-প্রশ্বাসের কষ্ট হবে না।

আরো পড়ুন:  গোয়ালিয়া লতা বাংলাদেশে পার্বত্য অঞ্চলের ভেষজ বিরুৎ

৪. শোথে: সেটা আভ্যন্তরিকই হোক আর বাহ্যই হোক; এক্ষেত্রে ১০ গ্রাম চাকুলে বা শঙ্করজটা (কোন কোন প্রাচীন বৈদ্য ২০ গ্রাম পর্যন্ত ব্যবহার করতেন) থেতো করে, যাকে বলে কুটে নিয়ে ৩ কাপ জলে সিদ্ধ করে এক কাপ থাকতে নামিয়ে ছেকে সেই জলটা খেতে হবে অথবা ৫ গ্রাম চূর্ণ গরম জলে ৪।৫ ঘণ্টা ভিজিয়ে রেখে সেটাকে ছে’কে ওই জলটা খেতে হবে। এটার দ্বারা শোথটা কমে যাবে।

৫. রোগান্তিক দুর্বলতায়: রোগেভোগার পর অনেকের পুষ্টিকর তেমন কিছু খাওয়ার সংগতি হয় না, সেক্ষেত্রে এই চাকুলে চূর্ণ দেড় বা দু’ গ্রাম মাত্রায় খাওয় র সময় ভাতে বা রুটির সঙ্গে মিশিয়ে খেলে রোগ ভোগান্তের দুর্বলতাটা চ’লে যাবে।

৬. শ্লেষ্মপ্রধান জ্বরে: এক্ষেত্রে চাকুলে ১০ বা ১৫ গ্রাম কুটে নিয়ে তার ক্বাথ করে (৪ কাপ জলকে সিদ্ধ করে ১ কাপ ক’রে) ছে’কে সেই জলটা সকালে ও বৈকালে দু’বারে খেলে শ্লেষ্মও কমে যাবে, তার সঙ্গে জ্বরের তাপেরও হ্রাস হবে। এই রকম ২। ৩ দিন খেলে শ্লেষ্মপ্রধান জ্বরের বিরাম হয়।

৭. নতুন সর্দিতে: যেখানে দেখা যায় নাক দিয়ে জল ঝ’রছে, মাথা ভারি, গা-হাত-পা কামড়ানি, ভাল ক্ষিধে লাগছে না—এক্ষেত্রেও চাকুলে ১০ গ্রাম ক্বাথ ক’রে খেলে ঐ নতন সর্দি হওয়ার অসুবিধে গুলি ভালো হয়ে যাবে।

৮. রক্ত আমাশয়: ১০।১২ চা-চামচ (এক ছটাক আন্দাজ) ছাগদুধের সঙ্গে ৭। ৮ গণ জলে মিশিয়ে তার সঙ্গে চাকুলে চূর্ণ ৫-৬ গ্রাম সিদ্ধ ক’রে, জলের চতুর্থাংশ আন্দাজ থাকতে নামিয়ে (সিকি ভাগ) ছে’কে সেই দুধটা খেলে রক্ত-আমাশয় উপশম হবে।

৯. বাতরক্ত রোগে: পূর্বেই বলা হয়েছে যে, এই রোগে কোষ্ঠকাঠিন্য এসে যায়, শরীরে দাহ হয়, গায়ে চাকা চাকা দাগ ওঠে। এই রোগের চিকিৎসা না হ’লে তার পরিণাম কুণ্ঠ। এক্ষেত্রে সিকি কাপ ছাগদগ্ধের সঙ্গে চাকুলের ক্বাথ মিশিয়ে, (চাকুলে চূর্ণ ৫ গ্রাম, আধ কাপ গরম জলে ভিজিয়ে, ৩। ৪ ঘণ্টা বাদ ছেকে নিতে হবে) তার সঙ্গে তিল তেল (আধ চা-চামচ/৩০ ফোঁটা আন্দাজ) মিশিয়ে খাওয়ার ব্যবস্থা। এই যোগটি ৩। ৪ দিন খাওয়ার পর থেকেই এর উপকারিতা প্রত্যক্ষ করা যাবে। আর সব প্রথম উচিত হলো, সরষের তেল কি খাওয়া আর কি মাখা এই দুটোই ত্যাগ করা। এইটাই প্রাচীনদের বিধান।

আরো পড়ুন:  জলধুনিয়া গুল্মের নানাবিধ গুণাগুণের বর্ণনা

১০. অর্শ রোগে: রক্ত পড়ার পর মলদ্বারে প্রদাহ হয়, দপ দপ করে, সেক্ষেত্রে চাকুলে ৮। ১০ গ্রাম একটু কুটে বা থেঁতো ক’রে নিয়ে সেটা ৪ কাপ জলে সিদ্ধ করে। আন্দাজ এক কাপ থাকতে নামিয়ে ছেকে ওই ক্বাথে খই সিদ্ধ ক’রে (প্রয়োজনে আরও জল দিতে হবে) সুসিদ্ধ হওয়ার পর তাকে খেতে হবে। এর দ্বারা অর্শের উপসর্গগলি চ’লে যাবে।

বাহ্য ব্যবহার

১১. চোখ জ্বালা ও ফোলায়: চাকুলে মূলে চূর্ণ ৫ গ্রাম, সৈন্ধব ১ গ্রাম ও গোলমরিচ ১ গ্রাম (চূর্ণ), এই তিনটি চূর্ণ একসঙ্গে টক আমানির জলের সঙ্গে মেড়ে বেশ চটচটে হ’লে কাজলের মত চোখে লাগালে (দিনে একবার) চোখ জ্বালা, চোখ ফোলা ও চোখ লাল হওয়া কমে যাবে।

১৩. হাড় ভাঙ্গায়: চাকুলে মূল চূর্ণ ৩। ৪ গ্রাম মাংস যুষের সঙ্গে খেতে হবে (সেটা ছাগমাংস হলেও চলবে)। অথবা ১০ গ্রাম চাকুলে ৪ কাপ জলে সিদ্ধ করে আন্দাজ এক কাপ থাকতে নামিয়ে, ছেকে, সেই ক্বাথে ছাগমাংস সিদ্ধ করে, (অবশ্য আরও খানিকটা জল দিতে হবে। সেটা খেতে হবে। এটা তো গেল খাওয়ার ব্যবস্থা। আর চাকুলের মূল মাংসের ক্বাথ দিয়ে বেটে, অল্প গরম করে ওই হাড় ভাঙ্গার জায়গাটায় লাগাতে হবে। এটাতে বিশেষ উপকার পাওয়া যায়। এটি যাঁরা প্রত্যক্ষ করেছেন তাঁদেরই কাছ থেকে শোনা।

CHEMICAL COMPOSITION

(a) Saponin (b) Glycosides (c) Sterols (d) Terpenoids.

সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।

তথ্যসূত্রঃ

১. আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য: চিরঞ্জীব বনৌষধি খন্ড ৫, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ ১৪০৩, পৃষ্ঠা, ১৪৭-১৪৯।

বি. দ্র: ব্যবহৃত ছবি উইকিমিডিয়া কমন্স থেকে নেওয়া হয়েছে। আলোকচিত্রীর নাম:  Prashant Awale

Leave a Comment

error: Content is protected !!