ঝুনঝুনা কড়ই বা লোহা শিরিষ এশিয়ার শোভাবর্ধক ও ভেষজ বৃক্ষ

বৃক্ষ

ঝুনঝুনা কড়ই

বৈজ্ঞানিক নাম: Albizia procera (Roxb.) Benth., Lond. J. Bot. 3: 89 (1844). সমনাম: Mimosa procera Roxb. (1799), Acacia procera (Roxb.) Willd. (1806). ইংরেজি নাম: White Siris. স্থানীয় নাম: শিল কড়ই, জাত কড়ই, সাদা কড়ই, লোহা শিরিষ (সিলেট), ঝুনঝুনা কড়ই।
জীববৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাস
জগৎ/রাজ্য: Plantae, বিভাগ: Angiosperms. অবিন্যাসিত: Edicots. অবিন্যাসিত: Rosids. বর্গ: Fabales. পরিবার: Fabaceae. প্রজাতি: Albizia procera.

ভূমিকা: ঝুনঝুনা কড়ই (বৈজ্ঞানিক নাম: Albizia procera) আলবিয়িয়া গণের ফেবিয়াসি পরিবারের একটি সপুষ্পক বৃক্ষ। এই প্রজাতি উদ্যান, রাস্তার পাশে, প্রতিষ্ঠানে লাগিয়ে শোভাবর্ধন করে। রেললাইনের স্লিপার তৈরিতে এই গাছের কাঠ ব্যবহৃত হয়।

ঝুনঝুনা কড়ই-এর বর্ণনা:

দ্রুত বর্ধনশীল, সুউচ্চ এবং পত্রঝরা বৃক্ষ, ১০-৪০ মিটার উঁচু, সোজা ও বাট্রেসমূলবিহিন গুঁড়িবিশিষ্ট। বাকল প্রায় মসৃণ, ফ্যাকাশে ধূসর থেকে বাদামী ধূসর, উজ্জ্বল বাদামী বর্ণের জন্য সহজেই দূর থেকে ইহাকে চেনা যায়, বাকল পাতলা খন্ডে খন্ডে সহজেই উঠে যায়। শাখা-প্রশাখা অসংখ্য বাদামী বর্ণের বায়ুরন্ধবিশিষ্ট। কচি বিটপ সাদা ও রেশমী রোমাবৃত।

পাতা দ্বি-পক্ষল যৌগিক, অণুপর্ণী, উপপত্র খর্বাকার, ০.৫ মিমি (প্রায়) লম্বা, আশুপাতী। পত্রাক্ষ ১০-২৫ সেমি লম্বা, ত্রিকোণীয়, উপরের পৃষ্ঠ খাজকাটা, মসৃণ, পত্রবৃন্তের গোড়া থেকে ১.০-২.৫ সেমি। উপরে একটি প্রলম্বিত বা ডিম্বাকার এবং অবৃন্তক উপবৃদ্ধি বর্তমান যা ৬-৭ X ২ মিমি।

পক্ষ ১-৬ জোড়া, ১২-২৫ সেমি লম্বা, ত্রিকোণাকার, মসৃণ, প্রায়শই উপরের পত্রকজোড়ার পাদদেশের মাঝখানে ১-৩টি খর্বাকার ও দীর্ঘায়ত উপবৃদ্ধি বর্তমান। পত্রক ৩-১০ জোড়া, প্রতিমুখ থেকে উপপ্রতিমুখ, ২.০-৫.৪ x ১-২ সেমি, খর্বাকার বৃন্ত যুক্ত, তির্যক দীর্ঘায়ত, ডিম্বাকার থেকে রম্বসাকার-দীর্ঘায়ত বা ট্রাপিজিয়াম আকৃতির, স্থূলা বা সখাঁজবিশিষ্ট, অখন্ড, শক্ত কাগজবৎ, মধ্যশিরা মাঝ বরাবর।

পুষ্পমঞ্জরী বৃহদাকার, প্রান্তীয়, অসংখ্য যৌগিক মঞ্জরী এবং মঞ্জরীদন্ডক শিরমঞ্জরী, মঞ্জরীদন্ড সচরাচর ২-৫ টি একসাথে গুচ্ছবদ্ধ অথবা কদাচিৎ একক, ০.৮-২.৫ সেমি লম্বা। প্রতিটি শির আড়াআড়িভাবে ১.৪ সেমি (প্রায়), ১৬-৩০টি পুষ্পের সমন্বয়ে গঠিত। পুষ্প অবৃন্তক, হলুদাভ সাদা।

আরো পড়ুন:  পিপুল ফলে আছে শরীরের সাধারণ রোগ সারানোর ভেষজ গুণ

বৃতি ফেকাশে সবুজ, ২.০-২.৫ মিমি নলাকার, দন্তক ৫টি, খর্বাকার, ত্রিকোণাকার, তীক্ষ, অসম, বাইরের পৃষ্ঠ মসৃণ। দলমন্ডল ৫.০-৬.৫ মিমি লম্বা, চুঙ্গি-আকার, সবুজাভ সাদা, খন্ডাংশ ৫টি, ১.৫-২.০ মিমি লম্বা, উপবৃত্তাকার, তীক্ষ্ণ।

পুংকেশর অসংখ্য, অনেকখানি বহির্গামী, পুংকেশরীয় নল দলনল থেকে লম্বা, পরাগধানী ক্ষুদ্র, হলুদ, দ্বি-খন্ডিত। গর্ভাশয় প্রায় অবৃন্তক, ১.৫ মিমি (প্রায়) লম্বা, মসৃণ, গর্ভদন্ড সূত্রাকার, গর্ভমুণ্ড ক্ষুদ্রাকার। ফল পড, ১১-১৮ x ১.৫-২.৮ সেমি, রৈখিক-দীর্ঘায়ত, চেপটা, মসৃণ, উজ্জ্বল লাল বাদামী, বীজের উপরে সুনির্দিষ্ট দাগ বর্তমান, শুধুমাত্র নিচের দিকের সংযুক্তি রেখা বরাবর বিদারিত হয়। ফল বৃক্ষে অনেকদিন ধরে টিকে থাকে।

বীজ প্রতি পড়ে ৭-১৩টি, ৭.৫ x ৪.৫ মিমি (প্রায়), বি-ডিম্বাকার-উপবৃত্তাকার, ১.৫ মিমি (প্রায়) পুরু, অ্যারিওল ৪.৫ x ৩.০ মিমি (প্রায়) । ক্রোমোসোম সংখ্যা: 2n = ২৬ (Mehra and Hans, 1971).

আবাসস্থল ও বংশ বিস্তার:

নিম্নভূমির বর্ষা অরণ্য, অগ্নিদগ্ধ তৃণভূমি, ক্রান্তীয় মৌসুমী অরণ্য, এবং জলজ গুল্ম অরণ্য। বাংলাদেশে ইহা সমতলভূমিতে, রাস্তার ধারে, গ্রাম্য ঝোপ-ঝাড়, পতিত জমি এবং নদীর তীরে দেখা যায়। ফুল ও ফল ধরে মে-জানুয়ারী। বীজ এবং শাখা কলমের মাধ্যমে বৃক্ষটির বংশ বিস্তার হলে ভাল জন্মায়।

ঝুনঝুনা কড়ই-এর বিস্তৃতি:

আদি নিবাস ভারতের কেন্দ্রীয় অঞ্চল, মায়ানমার, ভূটান, নেপাল, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, নিউগিনি, ইন্দো-চীন, চীন (দক্ষিণাংশ), ইন্দোনেশিয়া এবং ফিলিপাইনসহ ও মালয় পেনিনসুলা ব্যতিত সমগ্র গ্রীষ্ম প্রধান এশিয়ায় বিস্তৃত। বাংলাদেশে ইহা চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার বনভূমি এবং ঢাকা-ময়মনসিংহের শালবনে পাওয়া যায়।

অর্থনৈতিক ব্যবহার ও গুরুত্ব:

ইহা বাংলাদেশের সুপরিচিত কাঠের গাছগুলোর মধ্যে একটি। ইহার কাঠ শক্ত, মজবুত এবং টেকসই, আসবাবপত্র, গৃহ নির্মাণ, দেরাজের কাজ, রেল লাইনের স্লিপার, কৃষিজ যন্ত্রপাতি, গরুর গাড়ির চাকা, সেতু নির্মাণ, ইক্ষু মাড়াই কলের কড়িকাঠ, ধান মাড়াই যন্ত্র এবং চা-বাক্স তৈরির উপযোগী। ইহার কাঠ থেকে উন্নতমানের কয়লা পাওয়া যায়।

আরো পড়ুন:  সিনামোমান গণের প্রজাতিগুলোর বৈশিষ্ট্য

ইহার পাতা কীটনাশক গুণাবলী সম্পন্ন এবং পাতার পেষ্ট আলসারে পট্টি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অষ্ট্রেলিয়াতে ইহা মাছের বিষ হিসেবে লিপিবদ্ধ হয়েছে (Caius, 1989). জাতিতাত্বিক ব্যবহার: কচি শাখা এবং পাতা হাতির প্রিয় খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয় (Momtaz and Khatun, 1988).

অন্যান্য তথ্য: বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষের  ৯ম খণ্ডে (আগস্ট ২০১০) ঝুনঝুনা কড়ই প্রজাতিটির সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, এদের শীঘ্র কোনো সংকটের কারণ দেখা যায় না এবং বাংলাদেশে এটি আশঙ্কামুক্ত হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশে ঝুনঝুনা কড়ই সংরক্ষণের জন্য কোনো পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি। প্রজাতিটি সম্পর্কে প্রস্তাব করা হয়েছে যে এই প্রজাতিটির বর্তমানে সংরক্ষণের প্রয়োজন নেই। 

তথ্যসূত্র:

১. বি এম রিজিয়া খাতুন (আগস্ট ২০১০) “অ্যানজিওস্পার্মস ডাইকটিলিডনস” আহমেদ, জিয়া উদ্দিন; হাসান, মো আবুল; বেগম, জেড এন তাহমিদা; খন্দকার মনিরুজ্জামান। বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ (১ সংস্করণ)। ঢাকা: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। খন্ড ৯ম, পৃষ্ঠা ১৬৫-১৬৬। আইএসবিএন 984-30000-0286-0

বি. দ্র: ব্যবহৃত ছবি উইকিমিডিয়া কমন্স থেকে নেওয়া হয়েছে। আলোকচিত্রীর নাম: J.M.Garg

2 thoughts on “ঝুনঝুনা কড়ই বা লোহা শিরিষ এশিয়ার শোভাবর্ধক ও ভেষজ বৃক্ষ”

  1. আমি রোদ্দুরে সাইটে ভেষজ সম্পর্কে লিখতে চাই।

    Reply
    • স্যার, আমরা এখনো অতিথি লেখকদের কাছ থেকে লেখা নিচ্ছি না। আপনার আগ্রহের জন্য ধন্যবাদ।

      Reply

Leave a Comment

error: Content is protected !!