ভূমিকা: বড় ছাতিম (বৈজ্ঞানিক নাম: Alstonia scholaris) এপোসিনাসি পরিবারের এলস্টোনিয়া গণের বৃহৎ ও চিরসবুজ বৃক্ষ। পত্রাচ্ছাদিত বড় ছাতিম গাছগুলি ৪o/৫০ ফুট পর্যন্ত উচু হয়। গাছের পুরু ছালের ভিতরটা সাদা ও দানাযুক্ত কিন্তু উপরটা খসখসে, গাছের সমগ্রাংশে সাদা দুধের মত আঠা (ক্ষীরা) আছে, পাতাগুলির আকার অনেকটা মনসা পাতার মত। যার সংস্কৃত নাম স্মুহী। প্রায় সব শাখারই অগ্রভাগ ছাত্রাকার ও ৭টি পাতা সাজানো থাকে; আবার কোন কোন শাখাগ্রে ৫/৭/৮টি পাতাও দেখা যায়, তবে সেটা খুবই কম, তাই এই গাছটির একটি নাম ‘সপ্ত্চ্ছদ’। চ্ছদ অর্থে পত্র (পাতা) অথবা ‘সঙ্গতিপর্ণ” বা ‘সাতপর্ণী”, হিন্দি ভাষাভাষী অঞ্চলে একে বলা হয় ছাতিয়ান বা ছাতিবন, আর বাংলার চলতি নাম ছাতিম। শরৎকালে ফুল ও শীতকালে সরু বরবটীর শিম্বির মত ফল হয়। এর ফুলের উৎকৃষ্ট গন্ধ থাকলেও সেটি তীব্র।
বিদগ্ধজন এই নামটির সঙ্গে সুপরিচিত। তার প্রধান কারণ বিশ্ববরেণ্য কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর প্রমাণপত্রের প্রতীক স্বরূপ দেওয়া হয় এই সপ্তপর্ণীর পত্র।[১]
বিবরণ: বড় ছাতিম লম্বা বৃক্ষ। পত্র এক আবর্তে ৫-১০টি, পত্রবৃন্ত অনূর্ধ্ব ১.৭ সেমি লম্বা, পত্র ফলক ৯.৫-২৪.৫ x ৫.৬ সেমি, আয়তাকার-বল্লমাকার, উপবৃত্তাকার-আয়তাকার, মসৃণ, উপরের পৃষ্ঠ চকচকে, অঙ্কীয় পৃষ্ঠ বহুসংখ্যক পার্শ্বশিরা বিশিষ্ট, ফ্যাকাশে, মধ্যশিরা নিচের পৃষ্ঠে স্পষ্ট, পার্শ্ব শিরা উভয় পাশেই উথিত কিন্তু অঙ্কীয় পৃষ্ঠে অধিকতর স্পষ্ট, নিম্নাংশ কীলকাকার বা স্থূলাগ্র, শীর্ষ স্থূলাগ্র বা সামান্য দীর্ঘাগ্র, প্রান্ত অখন্ড।[২]
পুষ্পবিন্যাস ক্ষুদ্র ছত্রমঞ্জরী সাইম, শাখাবিশিষ্ট, বহু-পুষ্পবিশিষ্ট, রোমশ বা ঘন ক্ষুদ্র কোমল রোমাবৃত, পুষ্পদণ্ড অনূর্ধ্ব ২.৫ সেমি লম্বা, পুষ্পবৃন্তিকা অনূর্ধ্ব ৮ মিমি লম্বা, দৈর্ঘ্যে বৃতির সমান বা খবর, মঞ্জরীপত্র আয়তাকার বা বল্লমাকার, সূক্ষ্মা, রোমশ। পুষ্প সবুজাভ-সাদা, ৬-১২ মিমি লম্বা। বৃতি ২ মিমি লম্বা, রোমশ, স্থায়ী, খন্ডসমূহ আয়তাকার, ডিম্বাকার, স্থূলাগ্র। দলমণ্ডল নল বেলনাকার, ৬ মিমি লম্বা, খন্ডসমূহ ৩-৫ মিমি লম্বা, ডিম্বাকার, স্থূলাগ্র। চক্র (ফলক) অনুপস্থিত। ফলিক্যাল ঝুলন্ত, ২০-৪০ সেমি লম্বা ও ৩-৪ মিমি চওড়া। বীজ উভয় প্রান্তে স্থূলাগ্র। ফুল ও ফল ধারণ ঘটে নভেম্বর থেকে মে মাসে।
ক্রোমোসোম সংখ্যা: ২n = ৪০, ৪৪ (Kumar and Subramaniam, 1986)।
চাষাবাদ ও আবাসস্থল: রাস্তার ধারে, বাস্তুভিটার কুঞ্জে মাঝে মাঝে চিরহরিৎ, পর্ণমোচী বা মিশ্র বনাঞ্চলের স্বাভাবিক বৃক্ষ হিসেবে পাওয়া যায়। বংশ বিস্তার হয় বীজ দ্বারা।
প্রাপ্তিস্থান: আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, ভুটান, চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলংকা। বাংলাদেশে ইহা দেশের সর্বত্র আবাদ করা হয় এবং দেশের পূর্বাঞ্চলীয় বনাঞ্চলে প্রাকৃতিকভাবে জন্মে।[২] এছাড়াও এই গাছ জন্মে সমগ্র বাংলা, দক্ষিণ ও উত্তর ভারতে প্রায় সাড়ে তিন হাজার ফুট পর্যন্ত উচুতেও।[১]
অর্থনৈতিক ব্যবহার ও গুরুত্ব: কাঠ পেকিং বাক্স, আসবাবপত্র, কফিন, ব্ল্যাক বোর্ড, কাগজ ও কাগজের মণ্ড তৈরীর জন্য ব্যবহার করা হয়। বাকলের দ্রবণীয় আরক চর্মরোগ, যকৃতের সমস্যা, বহু দিন স্থায়ী জ্বর, অজীর্ণ রোগ, শরীরের শক্তিহীনতা, উদরাময়, আমাশয়, বহু দিন স্থায়ী আলসার, হাঁপানী, বায়ুনালীর ক্ষুদ্রাংশের প্রদাহ, হৃদরোগ উপশমে প্রয়োগ কর হয়। জাতিতাত্বিক ব্যবহার হিসেবে বলা হয়েছে এটি বাংলা অঞ্চলে স্থানীয়ভাবে বাকলের নির্যাস শিশুদের জ্বর-এর চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়, তরুক্ষীর দন্তক্ষয় নিরাময়ের জন্য, কাণ্ডের বাকলের পেষ্ট বাতজনিত ফোলা ও মূলের পেষ্ট টিউমার উপশমের জন্য ব্যবহার করা হয়। ভারতে তরুক্ষীর ফোঁড়া, ক্ষত এবং বাতজনিত ব্যথায় পুলটিশ হিসেবে ব্যবহার করা হয়, তরুক্ষীর এবং তেলের মিশ্রণ কানের ব্যথা প্রশমনের জন্য ড্রপ রুপে ব্যবহার করা হয় (Kanjilal et al., 1939)। ফিলিপাইনে কচি পাতার কৃাথ বেরি নিরাময়ে ব্যবহার করা হয় (Ludivina, 1977)। ঔষধার্থে ব্যবহার হয়-ত্বক (ছাল), পাতা, ফল ও ক্ষীর (আঠা)।[১] বড় ছাতিমের ভেষজ গুনাগুণ সম্পর্কে জানতে পড়ুন
অন্যান্য তথ্য: বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষের ৬ষ্ঠ খণ্ডে (আগস্ট ২০১০) বড় ছাতিম প্রজাতিটির সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, প্রজাতিটির সংকটের কারণ হচ্ছে আবাসস্থল ধ্বংস ও অত্যধিক আহরণ। বাংলাদেশে এই প্রজাতিটি আশংকা মুক্ত (lc)। বাংলাদেশে বড় ছাতিম সংরক্ষণের জন্য কোনো পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি। প্রজাতিটি সম্পর্কে প্রস্তাব করা হয়েছে যে এই প্রজাতিটির সংরক্ষণের কোন আশু ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজন নেই।
তথ্যসূত্র:
১. আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য: চিরঞ্জীব বনৌষধি খন্ড ২, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৩৮৪, পৃষ্ঠা: ১৫-২০।
২. এম আতিকুর রহমান, (আগস্ট ২০১০)। “অ্যানজিওস্পার্মস ডাইকটিলিডনস” আহমেদ, জিয়া উদ্দিন; হাসান, মো আবুল; বেগম, জেড এন তাহমিদা; খন্দকার মনিরুজ্জামান। বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ। ৬ (১ সংস্করণ)। ঢাকা: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। পৃষ্ঠা ১৮৭। আইএসবিএন 984-30000-0286-0
বি. দ্র: ব্যবহৃত ছবি উইকিপিডিয়া কমন্স থেকে নেওয়া হয়েছে। আলোকচিত্রীর নাম: Dolon Prova
জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ সম্মান ও এমএ পাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। বিভিন্ন সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রোদ্দুরে ডট কমের সম্পাদক।