রয়না বা পিতরাজ দক্ষিণ এশিয়ার চিরহরিৎ ঔষধি বৃক্ষ

বৃক্ষ

রয়না বা পিতরাজ

বৈজ্ঞানিক নাম: Aphanamixis polystachya (Wall.) RN, Parket, lnd, For, 57 4496 (1031). সমনাম: Sphaerosacme polvstachia Wall. (1829), Aphanamixis timorensis A. Juss. (1830). Amoora rohituka (Roxb.) Wight & Arn. (1833), Amoora timorensis (A. Juss.) Wight & Arn. ex Steud. (1840), Amoora polystachya (Wall.) Wight & Am. ex Steud. (1840), Amoora grandifolia (Blume) Walp. (1842), Aphanamixis rohituka (Roxb.) Pierre (1895), Aphanamixis tripetala (Blanco) Merr. (1918), Ricinocarpodendron polystachyum (Wall.) Mabb. (1982). ইংরেজি নাম : Amoora. স্থানীয় নাম: পিতরাজ, রয়না, তিতরাজ, বাজর, পিত্তি, বৈদ্যরাজ, তিক্তরাজ।

ভূমিকা: রয়না বা পিতরাজ (বৈজ্ঞানিক নাম: Aphanamixis polystachya, ইংরেজি নাম: Amoora) হচ্ছে মেলিয়াসি পরিবারের ভেষজ উদ্ভিদ। এই গাছ বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশেই জন্মে।  

রয়না বা পিতরাজ গাছের বর্ণনা:

রয়না বা পিতরাজ মাঝারি আকারের চিরহরিৎ বৃক্ষ, ২০ মিটার পর্যন্ত উচু, ঘন, ছড়ানো এবং ছাতার আকৃতির চুড়াবিশিষ্ট, বাকল লালচে-বাদামী, মধুময় গ্রন্থি সম্বলিত, ভেতরের বাকল লালচে, প্রায়শ:ই দুগ্ধবৎ তরুক্ষীরবিশিষ্ট। পল্লব বায়ুরন্ধবিশিষ্ট, প্রায় মসৃণ থেকে হলুদ বর্ণের সূক্ষ্ম রোম সম্বলিত।

পাতা ৪৫-১২৫ সেমি লম্বা, পত্রক ৬-১০ জোড়া, কচি অবস্থায় লাল, মসৃণ অথবা কম ক্ষেত্রে পত্রবৃন্ত, পত্রাক্ষ, পত্রকের অক্ষাভিগ পার্শ্ব এবং শিরাগুলোর অক্ষাভিগ দিক কমবেশী বাদামী রোমশ, পত্রবৃন্ত ৫-১৫ সেমি লম্বা, প্রস্থচ্ছেদে বৃত্তাকার কিন্তু বেশ স্ফীত এবং চেপটা, অথবা নিম্নপ্রান্তের নিকটে অক্ষাভিগ পার্শ্ব খাঁজকাটা, পত্রক ৭.৫-২৫.০ x ৪-৯ সেমি, দীর্ঘায়ত থেকে উপবৃত্তাকার-দীর্ঘায়ত, অধচর্মবৎ, শীর্ষ তীক্ষ্ণাগ্র, নিম্নপ্রান্ত গোলাকার থেকে তীক্ষ্ণ অথবা সরু, সচরাচর সুস্পষ্টভাবে অপ্রতিসম, পত্রকবৃন্ত ৪-১০ মিমি লম্বা, মধ্যশিরার উভয়পাশে পাশ্বীয় শিরার সংখ্যা ১০-১২টি, বিস্তৃত।

আরো পড়ুন: পিতরাজ বা রয়না-র কয়েকটি ভেষজ গুণ ও ব্যবহার

স্ত্রী পুষ্পমঞ্জরী ১১০ সেমি পর্যন্ত লম্বা, পুং এবং উভলিঙ্গ পুষ্পমঞ্জরী ৫০ সেমি লম্বা, কিন্তু প্রায় ক্ষেত্রেই অত্যন্ত খর্বাকৃতির, কমবেশী অতি কাক্ষিক। পুষ্প আড়াআড়িভাবে ৪-৯ মিমি, সুগন্ধিযুক্ত, মঞ্জরীপত্রিকা ০.৫ মিমি (প্রায়) লম্বা, শঙ্কবৎ, পুষ্পবৃত্তিকা ৪ মিমি পর্যন্ত লম্বা। বৃত্যংশ ৫টি, ২-৩ মিমি ব্যাসবিশিষ্ট, অর্ধগোলাকৃতি, বাইরের পৃষ্ঠ কমবেশী রোমশ, লালচে, কিনারা সিলিয়াযুক্ত। পাপড়ি ৩টি, প্রশস্ত উপবৃত্তাকার থেকে বর্তুলাকার, অর্ধগোলাকৃতি, মসৃণ অথবা বাইরের পৃষ্ঠ রোমশ, ভেতরের পৃষ্ঠ বিক্ষিপ্তভাবে রোমশ, হালকা পীত বর্ণ থেকে হলুদ অথবা ব্রঞ্জের বর্ণ, কখনও কিছুটা লাল বর্ণের, মোমের আস্তরণবিশিষ্ট।

আরো পড়ুন:  কুকুরচিতা বা মেন্দা গাছ-এর নয়টি ভেষজ গুণ

পুংকেশরীয় নল প্রায় পাপড়ির সমান লম্বা, হালকা পীত বর্ণের, পরাগধানী ৬টি, ২.৫-৪.০ মিমি লম্বা, উপবৃত্তাকার, শীর্ষ সূক্ষ খর্বাগ্রবিশিষ্ট, মসৃণ। গর্ভাশয় উপগোলকাকার বা উপবৃত্তাকার, গর্ভদন্ড দৃঢ়, গর্ভমুণ্ড ৩-খন্ডিত, বন্ধ্যা গর্ভকেশর লুপ্তপ্রায় ডিম্বকবিশিষ্ট। ফল ক্যাপসিউল, নিরেট বিডিম্বাকার, ২-৪ সেমি ব্যাসবিশিষ্ট, প্রাথমিক অবস্থায় হলুদাভ, পরিপক্ক অবস্থায় পাটল বর্ণ বা লাল বর্ণের, মসৃণ, ৩টি ভাবিশিষ্ট, ফলতৃক কখনও দুগ্ধবৎ তরুক্ষীরবিশিষ্ট। বীজ ১-৩টি, সমোত্তল, বাদামী-লাল বা কমলা বর্ণের তৈলাক্ত বীজোপাঙ্গ দ্বারা আবৃত। ফুল ও ফল ধারণ ফেব্রুয়ারী থেকে মে।

ক্রোমোসোম সংখ্যা: 2n = ৩৬ (Mehra and Khosla, 1969).

আবাসস্থল:

নিম্নভূমি এবং পার্বত্য অরণ্য, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৮০০ মিটার উচ্চতা পর্যন্ত, মৌসুমী প্লাবিত অরণ্য, গৌণ। অরণ্য এবং চুনাপাথরের অরণ্যসহ। এই গাছের বংশ বিস্তার করা হয় বীজ দ্বারা

বিস্তৃতি:

ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, মায়ানমার এবং শ্রীলংকা। বাংলাদেশে প্রজাতিটি চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, গাজীপুর, ময়মনসিংহ, শেরপুর, টাঙ্গাইল এবং সিলেট জেলার বনভূমিতে পাওয়া যায়।

অর্থনৈতিক ব্যবহার ও গুরুত্ব:

ইহার কাঠ ঘরবাড়ি নির্মাণে ব্যবহৃত হয় এবং আসবাবপত্র, নৌকার পাশি, যানবাহনের বডি, টানারী এবং ভিনেগার ও প্লাইউড নির্মাণ শিল্পের জন্য উপযোগী। বীজ তেল বাতরোগে তরল মলম হিসেবে এবং ক্ষত স্থানের ব্যান্ডেজ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ইহার বাকল বাতরোগ, ঠান্ডা এবং বুকের ব্যাথার চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। শোনা যায় ইহার ফল বিষাক্ত।

জাতিতাত্বিক ব্যবহার:

ভারতের লোধা আদিবাসীরা। শিশুদের প্লীহা ও যকৃত বৃদ্ধির চিকিৎসায় ইহার বীজোপাঙ্গের সাথে মধু মিশিয়ে খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকে। সাওতাল আদিবাসীরা ক্যান্সার আক্রান্ত ক্ষতের। চিকিৎসায় ইহার কাঠের নির্যাস ব্যবহার করে থাকে (Pal and Jain, 1998). মলুক্কাস এ ইহার পাতা বাটা পানিতে দ্রবীভূত করে উক্ত মিশ্রণ ধানের রোগ নিয়ন্ত্রনে ব্যবহার করা হয়।

রয়না বা পিতরাজ গাছের অন্যান্য তথ্য:

বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষের ৯ম খণ্ডে (আগস্ট ২০১০) পিতরাজ প্রজাতিটির সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, এদের শীঘ্র কোনো সংকটের কারণ দেখা যায় না এবং বাংলাদেশে এটি আশঙ্কামুক্ত হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশে পিতরাজ সংরক্ষণের জন্য কোনো পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি। প্রজাতিটি সম্পর্কে প্রস্তাব করা হয়েছে যে এই প্রজাতিটির বর্তমানে সংরক্ষণের প্রয়োজন নেই।

আরো পড়ুন:  বুনো ঝিঙা দক্ষিণ এশিয়ার ভেষজ গুণসম্পন্ন বিরুৎ

তথ্যসূত্র:

১. এম অলিউর রহমান এবং শুক্লা রানী বসাক (আগস্ট ২০১০)। “অ্যানজিওস্পার্মস ডাইকটিলিডনস” আহমেদ, জিয়া উদ্দিন; হাসান, মো আবুল; বেগম, জেড এন তাহমিদা; খন্দকার মনিরুজ্জামান। বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ (১ সংস্করণ)। ঢাকা: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। পৃষ্ঠা ৯১-৯২। আইএসবিএন 984-30000-0286-0

বি. দ্র: ব্যবহৃত ছবি উইকিমিডিয়া কমন্স থেকে নেওয়া হয়েছে। আলোকচিত্রীর নাম: Dinesh Valk

Leave a Comment

error: Content is protected !!