ভুমিকা: এর প্রচলিত নাম সান্দোল বা সোনালু (Cassia fistula)। ভারতের প্রায় সব প্রদেশেই, এমনকি এই দেশের সন্নিহিত দেশ বা অঞ্চলেও পাওয়া যায়। তবে পাশ্চাত্য উদ্ভিদবিজ্ঞানীগণের বক্তব্য হলও এই গাছের আদিম বাসস্থান নাকি দক্ষিণপূর্ব এশিয়া, কিন্তু এটা দেখা যাচ্ছে যে, প্রাক আর্যসভ্যতার কালে অর্থাৎ দ্রাবিড় সভ্যতার কালেও এই ফলের ব্যবহার করা হতো।
বৈজ্ঞানিক নাম: Cassia fistula. সমনাম: Bactyrilobium fistula Willd, Cassia bonplandiana DC, Cassia excelsa Kunth, Cassia fistuloides Collad, Cassia rhombifolia Roxb, Cathartocarpus excelsus G.Don, Cathartocarpus fistula Pers, Cathartocarpus fistuloides (Collad.) G.Don, Cathartocarpus rhombifolius G.Donসাধারণ নাম: golden shower tree. বাংলা নাম: সোনালু, সোনালী, বাদর লাঠি। জীববৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাস জগৎ/রাজ্য: Plantae. বিভাগ: Angiosperms. অবিন্যাসিত: Edicots. অবিন্যাসিত: Rosids. বর্গ: Fabales.পরিবার: Fabaceae. গণ: Cassia. প্রজাতি: Cassia fistula Linn.
বিবরন:
অযত্নে জন্মায় এই গাছ। দেখতে মধ্যমাকার হয়। ২৫ থেকে ৩০ ফুট পর্যন্ত উচু হতে দেখা যায়। পর্ণমোচী বৃক্ষ, ১০-২০ মিটার উঁচু, তরুণ বিটপ। রেশমী রোমশ। তরুণ গাছের বাকল ভস্ম বর্ণের ও মসৃণ এবং পুরাতন গাছের বাকল বাদামী। এর লম্বা পত্রবৃন্তে ৩ থেকে ৬ জোড়া পর্যন্ত পাতা হতে দেখা যায়। পাতার আকার অনেকটা কাক জামের (Eugenia fruticosa) পাতার মতো। পাতা যৌগিক, পত্রক অক্ষ ৮-১২ সেমি লম্বা, গ্রন্থিবিহীন। পত্রক ২-৮ জোড়া, প্রায় দৈর্ঘ্যে ৬-১৭ ও প্রস্থ ৩.৫-৭.৫ সেমি, ডিম্বাকৃতি-উপবৃত্তাকার, সূক্ষ্মাগ্র বা দীঘা, উপর পৃষ্ঠ গাঢ় সবুজ ও চকচকে, প্রথম অবস্থায় অঙ্কীয় পৃষ্ঠ রৌপ্য রোমশ এবং শেষে ফ্যাকাশে, উপপত্র তুরপুন আকার, অতি ক্ষুদ্র, ১-২ মিমি লম্বা, আশুপাতী।
পুষ্পবিন্যাস বৃহৎ, দোলকী রেসিম, ২০-৪০ সেমি লম্বা, কখনও ৬০ সেমি লম্বা, মঞ্জরীদন্ড ২-১০ সেমি লম্বা, রোমবিহীন, পুষ্প সহপত্রী, মঞ্জরীপত্র ৮-১০ মিমি লম্বা, ডিম্বাকার, সূক্ষ্মা, রোমশ। পুষ্প আড়াআড়ি প্রায় ৪.৫-৬.৫ সেমি, উজ্জ্বল হলদে, সুদর্শন, প্রস্ফুটনে প্রাচুর্য, বৃন্ত ৪.০-৫.৮ সেমি লম্বা, সরু। বৃত্যংশ ৫ টি ও আকারে ৭-১০ মিমি পর্যন্ত লম্বা হয়। দেখতে ডিম্বাকৃতি-উপবৃত্তাকার ও সবুজ। বাইরের দিকটা মখমলীয়, পেছনের দিক ভঁজকৃত।
ফাগুন ও চৈত্র মাসে গাছের পাতা ঝরে যায় এবং বৈশাখে নতুন কচি কলাপাতা রঙের পাতা গজায়, তারপরই গাছ পুষ্পিত হতে সুরু করে। এর বৈশিষ্ট্য হলও গাছের শাখা থেকে লম্বা ছড় নামে, সেটাতেই মালার আকারে হলুদ রঙের ফুল হয়। সাধারণের কাছে এই গাছটি ‘বানরলাঠির’ গাছ বলে পরিচিত।
এই হেতু যে, এর ফলগুলি লম্বায় কম বেশী এক হাতের মতো হয় এবং আকারে গোল ব্যাস প্রায় এক ইঞ্চি, কাঁচা ফল সবুজ থাকে, পাকলে এই ফলের গায়ের রঙ হয় মেহগনি কাঠের রঙের মতো। ফলের মধ্যে বহু, বীজ থাকে। সেগুলি আকারে মটরের মতো হলেও চেপ্টা, মসৃণ, উজ্জ্বল পীতের আভাযুক্ত ধূসর রঙের। বৈশিষ্ট্য হলো, এই বীজগুলি একসঙ্গে থাকে না, এর ফলের মধ্যে সমদূরত্বে গোল পয়সা বা আধুলি আকারে দেওয়াল সৃষ্টি করেছে প্রকৃতিভাবে। আর সেই দেওয়ালের গায়ে তেতুলের মাড়ি বা মজার মতো চিটচিটে আঠাবৎ একটি জিনিস জন্মে।
ফল কাঁচা অবস্থায় পাড়লে এটা পাওয়া যায় না, গাছপাকা ফলেই এটা পাওয়া যায়। সেই আঠাবৎ পদার্থটাই ঔষধ হিসাবে ব্যবহার করা হয়। সেই আঠাকে বলে সোন্দালের আঠা বা ফলমজ্জা। ইউনানি সম্প্রদায় একে বলেন ‘মগজ ফুলুস’। এই ফুলুস অর্থ আগেকার আমলের ‘বড় পয়সা’, যেহেতু এই ফলের প্রকোষ্ঠগুলি পয়সার আকারের হয়। ফাঙ্গুন ও চৈত্রে গাছ পত্রশূন্য হলেও গাছে পাকা ফলগুলি ঝুলতে থাকে। হিন্দিভাষী অঞ্চলের প্রচলিত নাম আমলতাস, উড়িষ্যার অঞ্চল বিশেষে একে বলে সোন্দলি।।[১][২]
ক্রোমোসোম সংখ্যা:
2n = ২৪, ২৮ (Irwin and Trune, 1960).
বিস্তৃতি:
বাংলাদেশ, ভারতসহ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় এই গাছ জন্মে থাকে। ভারত, শ্রীলংকা, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, ভুটান, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ডসহ এশিয়া ও অন্যান্য উষ্ণমন্ডলীয় অঞ্চলে বিস্তৃত। নিউগিনি, চীন ও মিশরে চাষাবাদ করা। হয়। বাংলাদেশে এটি সাধারণ বাহারি উদ্ভিদ রূপে পথি পার্শ্ব ও বাগানে রোপণ করা হয়। এছাড়া ঢাকা, ময়মনসিংহ, দিনাজপুর এবং কুমিল্লার শালবনে স্বাভাবিক রূপে জন্মে।[২]
বংশ বিস্তার ও চাষ পদ্ধতি:
মাঝারি আকারের এই সোনালু গাছ যত্ন ছাড়ায় ভালোভাবে বেড়ে ওঠে। ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিলে মাঝামাঝির মধ্যে পাতা ঝরে যায়। বৈশাখ মাসে নতুন পাতা গজায়। বীজ থেকে গাছ হয়। এই পত্রমোচী গাছের ফল গোল হয়। গরু ছাগলের অপছন্দ বলে এই গাছ যত্রত্ত্র হয়। মার্চ থেকে জুন মাসে এই গাছ ফুল ও ফল ধারণ করে। [৩]
সোনালুর অর্থনৈতিক গুরুত্ব ও ঔষধি গুণ:
ঔষধার্থে ব্যবহার হয় ফল, পাতা বিশেষতঃ কচি পাতা, গাছের বা মূলের ছাল এবং ফলমজ্জা। ট্যানিন রূপে এবং কাঠের ছাই রঞ্জন কার্যের পরিস্কারক রূপে ব্যবহার করা হয়। কাঠ শক্ত, স্থায়ী, আসবাবপত্র, কৃষি যন্ত্রপাতি ও বিদ্যুৎ খাম তৈরিতে ব্যবহার্য। পাতা গবাদি পশু খাদ্য রূপে গ্রহণ করে। পাতার রস বাতরোগে উপকারী। কাঠের রসালো আঁশ যুক্ত অংশ রেচক তাই কোষ্ঠ কাঠিন্য নিরাময়ে গুরুত্বপূর্ণ। জাতিতাত্বিক ব্যবহার ও বাংলাদেশের অনেক অঞ্চলে ফলচূর্ণ দুধের সাথে মিশ্রিত করে টনসিলের প্রদাহে সেঁক দেয়া হয়। ২-৩ দিন সেঁক দেয়ার ফলে টনসিল সম্পূর্ণ সুস্থ হয়। (Hassan, 2002)।
অন্যান্য তথ্য:
বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষের ৭ম খণ্ডে (আগস্ট ২০১০) সোনালু প্রজাতিটির সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, এদের শীঘ্র কোনো সংকটের কারণ দেখা যায় না এবং বাংলাদেশে এটি আশঙ্কামুক্ত হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশে সোনালু সংরক্ষণের জন্য কোনো পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি। প্রজাতিটি সম্পর্কে প্রস্তাব করা হয়েছে যে এই প্রজাতিটির বর্তমানে সংরক্ষণের প্রয়োজন নেই ।[২]
তথ্যসূত্রঃ
১ আয়ূর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্রচার্য, চিরঞ্জীব বনৌষধি‘ খন্ড ২, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৩৮৩, পৃষ্ঠা, ২৭৩-২৭৪।
২. এম মতিয়ুর রহমান(আগস্ট ২০১০)। “অ্যানজিওস্পার্মস ডাইকটিলিডনস” আহমেদ, জিয়া উদ্দিন; হাসান, মো আবুল; বেগম, জেড এন তাহমিদা; খন্দকার মনিরুজ্জামান। বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ। ১০ (১ সংস্করণ)। ঢাকা: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। পৃষ্ঠা ১১৭-১১৮ । আইএসবিএন 984-30000-0286-0
৩. দ্বিজেন শর্মা; ফুলগুলি যেন কথা, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ মে ১৯৮৮, প্রথম পুনর্মুদ্রণ ডিসেম্বর ২০০৩ পৃষ্ঠা, ৪০।
জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ সম্মান ও এমএ পাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। বিভিন্ন সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রোদ্দুরে ডট কমের সম্পাদক।
Very good