বিবরণ: তমাল (বৈজ্ঞানিক নাম: Diospyros montana) এবিনাসি পরিবারের ডিয়োসপিরোস গণের সপুষ্পক উদ্ভিদের একটি ছোট বৃক্ষ। এরা প্রায় ১৫ মিটার উঁচু, কান্ড ও পল্লব কখনও কন্টকিত, বাকল গাঢ় বাদামী।[১] ই গাছের গুঁড়ি কাণ্ড আঁকাবাঁকা ও আঁকাবাঁকা ডালপালায় বিস্তৃত। বাকল অমসৃণ ও গাঢ় ধূসর বর্ণের এবং বাকলের উপরিভাগের ছোট ছোট আস্তর খসে পড়ে।
এদের পাতা সরল, একান্তর, ডিম্বাকার দীর্ঘায়ত, লম্বায় ৫-১০ সেন্টিমিটার ও চওড়ায় ২.৫-৪.০ সেন্টিমিটার, মূলীয় অংশ তাম্বুলাকার বা গোলাকার, শীর্ষ সূক্ষ্মাগ্র বা স্থূলাগ্র, বৃন্ত ২-১০ মিমি লম্বা, অতিরোমশ।[১] পাতার কিনারা মসৃণ এবং আগা সুচালো। জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি মাসে পাতা ঝরে যায়।
তমাল ছোট থেকে মাঝারি আকৃতির পাতাঝরা বৃক্ষ। এরা উচ্চতায় ৫-৭ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। এ এদের পাতা আয়তাকার, লম্বায় ৫-১০ সেন্টিমিটার ও চওড়ায় ২.৫-৪.০ সেন্টিমিটার, কিনারা মসৃণ এবং আগা সুচালো। জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি মাসে পাতা ঝরে যায়।
এদের পুষ্প ছোট, সাদা, চতুরাংশক। বৃতি গভীর ৪ খন্ডিত, প্রশস্ত ঘন্টাকার, রোমশ বিহীন বা স্বল্প রোমশ। দলখন্ড ৪টি, ৮-১০ মিমি লম্বা, উভয় পার্শ্ব রোমশ বিহীন। পুংপুষ্প ২-৮টি, নিয়ত মঞ্জরীতে বিন্যস্ত, চতুরাংশক, পুংকেশর ১৪-২০টি, পুংদন্ড মসৃণ, প্রায় ১ মিমি লম্বা। স্ত্রী পুষ্প একল, চতুরাংশক, বৃন্ত ৫ মিমি লম্বা, মসৃণ, গর্ভাশয় গোলাকার, ৮ প্রকোষ্ঠী, গর্ভদন্ড ৪টি, বন্ধ্যা পুংকেশর ৪-১২টি, রোমশ বিহীন। ফল গোলাকার বেরি জাতীয়, আড়াআড়ি ১-৪ সেমি, পরিপক্ক অবস্থায় হলুদ। বীজ চ্যাপ্টা, কালো। ফুল ও ফল ধারণ ঘটে মার্চ-মে।[১] সেপ্টেম্বর- অক্টোবর মাসে পরিপক্ক ফল হলুদ বর্ণ ধারণ করে। ফল ভক্ষণযোগ্য নয়। প্রতিটি ফল একক বীজ বিশিষ্ট। বীজের আয়ুষ্কাল খুবই কম।
ক্রোমোসোম সংখ্যা: 2n = ৩০ (Kumar and Subramaniam, 1986).
আবাসস্থল: চিরহরিৎ অরণ্য, চুনা পাথরীয় অঞ্চল, ঝোপ এবং সাধারণ পর্ণমোচী অরণ্য।
ভৌগোলিক বিস্তৃতি: তমাল বাংলাদেশ, ভারত, মায়ানমার, শ্রীলংকা, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, লাওস, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, চীন ও অস্ট্রেলিয়ার উষ্ণাঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত।
বাংলাদেশে অস্তিত্বমূলক অবস্থা: বাংলাদেশে তমাল একটি মহাবিপন্ন (Critically Endangered) দেশিয় প্রজাতির বিরল গাছ। ২০১২ সালের প্রণীত বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনে তমাল গাছ রক্ষিত উদ্ভিদ (Protected Plant) হিসেবে বিবেচিত।
বাংলাদেশে বিস্তৃতি ও প্রাপ্তিস্থান: আমদের দেশে তমাল গাছ ইদানীং খুব একটা দেখা যায় না। এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে লাগানো তমালের কিছু গাছ রয়েছে। ময়মনসিংহ এলাকায় প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো কয়েকটি গাছ রয়েছে যেমন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেনে, আনন্দমোহন কলেজের অধ্যক্ষের কার্যালয়ের সামনের বাগানে এবং ময়মনসিংহের কাচিঝুলিতে বনবিভাগের বিভাগীয় কার্যালয়ের উলটো দিকে তমাল গাছ রয়েছে। ঢাকার মিরপুরে অবস্থিত জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান, রমনা পার্ক, বেনাপোল পাঠবাড়ী আশ্রম, ঠাকুরগাঁও গোবিন্দজীউ মন্দির, দিনাজপুর রাজবাড়ী কালিয়া কান্তজীউ মন্দিরে এই গাছ আছে।[২] বাংলাদেশের হিন্দুমন্দীর চত্বরে ও রাস্তার পার্শ্বে রোপিত অবস্থায় দেখা যায়।
প্রজনন ও বংশবিস্তার: সাধারণত বন এলাকায় প্রাকৃতিকভাবে বীজজাত চারা দিয়ে তমালের বংশবিস্তার হয়। নার্সারিতে সংগৃহীত বীজ যথাশীগ্র পলিব্যাগে বপন করতে হয়। চারা গজানো বা বীজের অঙ্কুরোদগমের হার শতকরা প্রায় ৭০-৮৫ ভাগ। চারা গজাতে সময় লাগে ১৭-৬৫ দিন।
তমাল গাছের অর্থনৈতিক ব্যবহার, গুরুত্ব ও ক্ষতিকর দিক:
তমাল গাছের কাঠ ঘরের খুঁটি এবং আসবাব তৈরিতে ব্যবহার করা হয় (Khan and Alam, 1996)। তমালের কাঠ হলুদ বা ধূসর বর্ণের, মধ্যম শক্ত, মজবুত এবং টেকসই। কৃষি সরঞ্জামাদি ও আসবাবপত্র নির্মাণে কাঠ ব্যবহৃত হয়। তমাল গাছ হিন্দু ধর্মালম্বীদের কাছে খুব পূজনীয়। তাদের ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তমাল গাছে বসে বাঁশি বাজাতেন। সে কারণে হিন্দুরা শ্রীকৃষ্ণ উপাসনালয়ে তমাল গাছ লাগিয়ে থাকে।
পাতা ও ফলের চূর্ণ বিষাক্ত বিধায় মাছকে সংজ্ঞাহীন বা অচেতন করা হয় (Das and Alam, 2001)। এর পাতা যদি বেশী পরিমান পানিতে ফেলে রাখা হয় তাহলে টক্সিসিটি হয়ে মাছ মারা যায়।
এ গাছের বিভিন্ন অংশ আয়ুর্বেদিক ভেষজ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। গাছের প্রতিটি অংশ স্বাদে অত্যন্ত তিতা। তমালের বিষাক্ত ফল ফোড়ায় ব্যবহার করা হয়। গাছের বাকলে রয়েছে ট্রাইটারপিন্স ও মিথানল যা যকৃত রোগের ঔষধ এবং বেদনানাশক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তমালের ফল থেকে জ্বর ও ক্ষতরোগ নিরাময়ের ঔষধ তৈরি হয়। এ ছাড়া তমালের ফল পানিতে সেদ্ধ করলে লালচে কালো রঙ তৈরি হয় যা কাপড়, সুতা ও পাট রঙ করতে ব্যবহৃত হয়।
জাতিতাত্বিক ব্যবহার: ভারতের কয়া আদিবাসী সম্প্রদায় মূলের বাকল চূর্ণ তেঁতুলের সাথে মিশ্রিত করে আমাশয় রোগ নিরাময়ে ব্যবহার করে। কান্ডের বাকল চূর্ণ ও পাতা একত্রে মিশ্রিত করে ভারতের জাটাপু ও সাভারা আদিবাসী সম্প্রদায় মাছের খামারে বিষ হিসাবে প্রয়োগ করে (Rama and Henry, 1996)।
অন্যান্য তথ্য: বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষের ৭ম খণ্ডে (আগস্ট ২০১০) তমাল প্রজাতিটির সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, এদের বর্তমান অবস্থা নির্ণয় করা হয়নি এবং প্রজাতিটি অতি এখনও বিরল মনে হয়। প্রজাতিটি সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, প্রজাতিটির আশু সংকটের কারণ দেখা যায় না। এবং প্রজাতিটি বাংলাদেশে আশংকামুক্ত (lc)। প্রজাতিটি সম্পর্কে প্রস্তাব করা হয়েছে যে, আশু সংরক্ষণের পদক্ষেপ গ্রহণ নিষ্প্রয়োজন।
সংরক্ষণের জন্য গৃহীত পদক্ষেপ: ঢাকার মিরপুরে অবস্থিত জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানের ৬ নম্বর সেকশনে লাগানো তমালের কিছু গাছ সংরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। আরণ্যক ফাউন্ডেশন সহযোগিতায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশ বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তমালের চারা লাগিয়ে প্রজাতিটিকে সংরক্ষণের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
তথ্যসূত্র:
১. এম আহসান হাবীব, (আগস্ট ২০১০)। “অ্যানজিওস্পার্মস ডাইকটিলিডনস” আহমেদ, জিয়া উদ্দিন; হাসান, মো আবুল; বেগম, জেড এন তাহমিদা; খন্দকার মনিরুজ্জামান। বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ। ৭ (১ সংস্করণ)। ঢাকা: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। পৃষ্ঠা ৩৬৭। আইএসবিএন 984-30000-0286-0
২. চয়ন বিকাশ ভদ্র, “প্রকৃতি: দুষ্প্রাপ্য তমাল.” দৈনিক ইত্তেফাক, ১১ ডিসেম্বর ২০১৬, www.ittefaq.com.bd/print-edition/aiojon/2016/12/11/161715.html.
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।