পরিচিতি: ছায়াতরু হিসেবে অশ্বত্থ ঔষধি গাছটি রাস্তার ধারে রোপণ করা হলেও উপযোগিতায় বটগাছের সঙ্গে তার তুলনাই হয় না। তবে বট, অশ্বত্থ, পাকুড় প্রভৃতি যাদের গুপ্তবীজ, সেইসব গাছের তলায় বহু ফল পড়ে থাকলেও সেই সব ফলের বীজ থেকে চারা হতে দেখা যায় না; অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভাঙ্গা বাড়ির ফাটলে বা কার্ণিসে এর চারা দেখতে পাই, কারণ যেসব পাখি এসব ফল খায়, তাদের উদরের মধ্যে যে তাপ আছে, হয়তো জননোপযোগী বীজগুলিই কেবল তারই দ্বারা অঙ্কুরিত হবার যোগ্য হয়। দেখা যাচ্ছে এই ফ্যামিলির বীজের অঙ্কুরোদগমের ইনকিউবেটর যেটা Incubator: ডিম ফোটাবার যন্ত্র হচ্ছে এইসব পাখির উদর। বাংলা তথা সমগ্র ভারতের জনসাধারণের কাছে অশ্বত্থ গাছের বর্ণনার বিশেষ প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। অশ্বত্থ ঔষধি গাছটির বৈজ্ঞানিক নাম Ficus religiosa Linn ও পরিবার Syffe Moraceae. এ ধরনের আর একটি গাছ হয়, সেটির প্রচলিত নাম নন্দীবৃক্ষ বা গয়া অশ্বত্থ। এর বৈজ্ঞানিক নাম Ficus rumphii Blume, সমগ্র পৃথিবীতে এই ফ্যামিলির প্রায় ৬০০টি প্রজাতি (Species) থাকলেও ভারতবর্ষে ১১২টি প্রজাতি বর্তমান। চৈত্র মাসে অশ্বত্থ ঔষধি বৃক্ষ পত্রশূন্য হয় এবং বৈশাখে আবার নতুন পাতায় ভরে যায়। তারপরেই হয় ফল এবং বর্ষার শেষে ফল পেকে যায়। একে হিন্দিভাষী অঞ্চলে বলে থাকে পিপ্পল গাছ। সংস্কৃত নাম ক্ষীরন্দ্রুম, গজভক্ষ্য।
অশ্বত্থ একটি বহু উপকারি পবিত্র বৃক্ষ
রোগ প্রতিকারে
১. বাতরক্তে: এই রোগের লক্ষণের বর্ণনা ‘চিরঞ্জীব বনৌষধি’র প্রথম খন্ডের ৩৩০ পৃষ্ঠায় দেওয়া হয়েছে। অশ্বত্থ ঔষধি বৃক্ষের স্বরস ছাল অর্থাৎ উপরের চটা বা মরা ছাল নয় ২০ গ্রাম নিয়ে থেতো করে ৪ কাপ জলে সিদ্ধ করে এক কাপ থাকতে নামিয়ে ছেঁকে সকালে ও বিকালে আধা কাপ করে খেলে ১০ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে এটা কমের দিকে যাবে। তবে এর সঙ্গে আধ চা-চামচ করে মধু মিশিয়ে খেতে পারলে ভাল হয়; এটা চরকীয় ব্যবস্থা।
২. ইন্দ্রিয়শৈথিল্য- পুরুষের বয়সের ৪টি স্তরে ইন্দ্রিয়ের চর্চার ধারা ৪টি কিশোর, তরুণ, যুবা ও প্রৌঢ়। কৈশোরে থাকে শিহরণ, যুবার ও তরুণের বিভিন্ন প্রক্রিয়ার ও বিভিন্ন পথে তার প্রবৃত্তির উপভোগে আসক্তি, তারই অত্যধিক ক্ষয়ে প্রৌঢ়ে আসে ইন্দ্রিয়শৈথিল্য, এর পূর্বাভাসে দেখা যায়—যোগসূত্রের ক্ষেত্রটা বাস্তবের কাছে পৌছলে তবেই তার উদ্দীপনা। যদি এইসব বয়সে এগুলির স্বাভাবিকতা না দেখা যায় অর্থাৎ কৈশোরে তার শিহরণ নেই, যৌবনের উন্মাদনাও তার মধ্যে দেখা যাচ্ছে না, তরুণের তরুণীতেও বিরাগ, তার কারণ তার এবং প্রৌঢ়কালে হাল থেকেও বেহাল, তখন বুঝতে হবে চিকিৎসার প্রয়োজন। এক্ষেত্রে একটু বদ-ফরমাশ লিখতে বাধ্য হচ্ছি—যেহেতু এটার ফল নিশ্চিত। কি করতে হবে; অশ্বত্থ গাছের গোড়া অন্তত এক থেকে দেড় হাত খুড়ে ফেলতে হবে, তারপর আঙ্গুলের মাপে ৩ থেকে ৪টি শিকড়কে কলম-কাটা করে ২ থেকে ৩টি একত্রিত করে বাঁধা যায় এমন শিকড়কে নির্বাচন করতে হবে এবং এমনভাবে কাটতে হবে যেন একই জায়গায় ঐ কাটা মুখগুলি পড়ে; যেদিক গাছের সঙ্গে সংযুক্ত আছে সেই দিকটাই নিতে হবে এবং একটি মাটির বা এ্যালুমিনিয়ামের পাত্রে খেজুর বা তালগাছে রস ধরার জন্য যেমন করে পেতে রাখে, সেইভাবে রেখে তবে পাত্রটা পাততে হবে। তারপর কোন পাতা বা চট দিয়ে অশ্বত্থগাছের গোড়া, যেখানটায় মাটি খুঁড়ে ফেলা হয়েছে, সেখানটায় ঢেকে দিতে হবে এবং পাত্রের মুখটাও কোনো ন্যাকড়া দিয়ে ঢেকে দিতে হয়, যেন ওটাতে পোকামাকড় কিছু না পড়ে। সমস্ত রাত্রি শিকড় থেকে টপটপ করে যে রস ঐ পাত্রে পড়বে; পরদিন সকালে ঐ পাত্রটা থেকে সংগহীত রসের এক থেকে দেড় চা-চামচ নিয়ে সকালে ও বিকালে ২ বার একটু দুধ মিশিয়ে খেতে হবে; নতুবা শুধু খাওয়া যায়। এর দ্বারা যে বয়সে যে অসুবিধে চলছে সেটা সামলে দেবে।
৪. পিত্ত বমনে: অনেক সময় এই পিত্তবমনটা জ্বর হলেও হয়। আবার না হলেও হয়; এক্ষেত্রে অশ্বত্থের চটা বা স্বভাবমতে ছাল অন্তর্ধূমে দগ্ধ করে অর্থাৎ হাঁড়ির মধ্যে ছাল পুরে সরা চাপা দিয়ে, মাটি দিয়ে হাঁড়ির মুখ লেপে, রৌদ্রে শুকিয়ে নিয়ে, পোড়া দিতে হয়; ভিতরের ছালগুলি পুড়ে কয়লায় পরিণত হবে, সেই অঙ্গার ৪ থেকে ৫ গ্রাম ১ কাপ জলে দিয়ে নেড়ে ঐ কয়লাটা একটা ন্যাকড়ায় ছেকে ফেলে দিয়ে ঐ পরিষ্কার জলটা একটু একটু করে খেলে পিত্তবমন বন্ধ হয়ে যায়।
৫. পিত্তজ্বরে পিপাসা: উপরিউক্ত পদ্ধতিতে জল তৈরী করে দু-এক চা-চামচ করে খেলে পিপাসা চলে যায়।
৬. শিশদের মুখের ক্ষতে: অশ্বত্থের ছাল কিন্তু চটা নয়, শুকিয়ে সেটাকে মিহি চূর্ণ করে ২ থেকে ৫ ফোঁটা মধু মিশিয়ে চাটালে মুখের ক্ষত শুকিয়ে যাবে।
বাহ্য প্রয়োগে
৭. ক্ষতে: এমন কতকগুলি ক্ষত হয়, যেটায় পুঁজ প্রচুর জন্মে এবং যন্ত্রণাও থাকে; সেক্ষেত্রে অশ্বত্থের কচিপাতা ক্ষতের উপরে চাপা দিয়ে বেধে রাখলে ঐ পুঁজ পড়া কমে যাবে এবং যন্ত্রণারও উপশম হবে।
৮. গভীর ক্ষতে: ক্ষত আস্তে আস্তে গভীর হয়ে যাচ্ছে, শুকিয়ে যাওয়ার নাম নেই, এক্ষেত্রে ঐ অশ্বত্থ গাছের চটা অর্থাৎ উপরের ছালের যে অংশটার স্বভাবমৃত্যু হয়েছে, এগুলি প্রায় হাত দিয়েই তুলে নেওয়া যায় সেসব মিহি চূর্ণ করে ঐ ক্ষতের উপর খুব পাতলা করে ছড়িয়ে দিলে ২ থেকে ৪ দিনের মধ্যেই ওটা পুরে উঠবে। সাবধান, কাঁচা ছাল শুকিয়ে সেটার গুড়ো যেন প্রয়োগ করবেন না, তাহলে এটাতে উল্টাই হবে।
৯. পোড়ার ঘায়ে ক্ষত: অন্তর্ধূম দগ্ধ অশ্বত্থে অর্থাৎ চটার অন্তর্ধূম দগ্ধ কয়লার মিহি গুড়ো করে নারকেল তেলের সঙ্গে অথবা মোমের সঙ্গে বা ভেসলিনের সঙ্গে মিশিয়ে ঐ পোড়ার ঘায়ে লাগালে ২ থেকে ৪ দিনের মধ্যে শুকিয়ে যায়।
১০. যোনির ক্ষতে: অনেক কারণেই হতে পারে, এক্ষেত্রে অশ্বত্থ গাছের ছাল ২০ থেকে ২৫ গ্রাম ৬ কাপ জলে সিদ্ধ করে এক কাপ থাকতে নামিয়ে, ছেকে ঐ ক্বাথে ডুস দিয়ে ধুইয়ে দিতে হবে অথবা পিচকারী করে যোনির বিবরটা ধুয়ে ফেলতে হবে; এইভাবে একদিন অন্তর একদিন পরিমাণমত ৩ থেকে ৪ বার ডুস দিলে ওটা সেরে যাবে।
১১. যোনিকন্দে: এটি সাধারণত যোনিদ্বারের নিম্নভাগে হয়, এটি নারীদের লজ্জাকর রোগ। এ রোগে প্রচুর পরিমাণে দুর্গন্ধযুক্ত রসস্রাব হতে থাকে। এক্ষেত্রে অশ্বত্থ ছাল ও পাতা সমপরিমাণে নিয়ে ২৫ থেকে ৩০ গ্রাম ৪ কাপ জলে সিদ্ধ করে এক কাপ থাকতে নামিয়ে ছেকে, ঐ জল দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে। এর দ্বারা ওর রসস্রাব কমে গিয়ে আস্তে আস্তে শুকোতে থাকবে।
১২. কানের পুঁজে ও যন্ত্রণায়: দুটি অশ্বত্থের পাতা নিয়ে পানের খিলির মত ঠোঙা করে, সরষের তেল এক চা-চামচ আন্দাজ ঐ ঠোঙায় ঢেলে, প্রদীপে অথবা বাতি জ্বেলে গরম করতে হবে, ঐ তেলটা ফুটে যখন তলার দিকটা পড়ে পড়ে যাওয়ার মত অবস্থা হবে, তখন ঐ গরম তেল ড্রপারে করে নিয়ে কানে ফোঁটা ফোঁটা দিতে হবে; এর দ্বারা ঐ পুঁজ পড়া ও কটকটানি বা যন্ত্রণা চলে যাবে।
সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।
তথ্যসূত্রঃ
১. আয়ূর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য, চিরঞ্জীব বনৌষধি খন্ড ২, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৩৮৪, পৃষ্ঠা, ৫৭-৬২।
বি. দ্র: ব্যবহৃত ছবি উইকিপিডিয়া কমন্স থেকে নেওয়া হয়েছে। আলোকচিত্রীর নাম: Dinesh Valke
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।