বিবরণ:
জারুল মধ্যমাকৃতি, পত্রমোচী বৃক্ষ। এদের পত্র বৃহৎ, ৬ ইঞ্চি থেকে ৮ ইঞ্চি দীর্ঘ, আয়তাকার, মসৃণ। পত্রবৃন্ত আধা ইঞ্চি পর্যন্ত হতে পারে। এদের মঞ্জরি অনিয়ত, শাখায়িত, বহুপৌষ্পিক ও প্রান্তিক। ফুল বেগুনি, ২ থেকে আড়াই ইঞ্চি প্রশস্ত। বৃতি সবুজ, দৃঢ়, স্থায়ী এবং ৬ বৃত্যংশে বিভক্ত। পাপড়ি ৬, প্রায় ১ ইঞ্চি দীর্ঘ, কোমল এবং আন্দোলিত-প্রান্তিক। পরাগকেশর অসংখ্য, হলুদ বর্ণ। ফল ডিম্বাকৃতি, বৃতিযুক্ত, পৌনে ১ থেকে ১ ইঞ্চি দীর্ঘ ও ৫–৭ অংশে বিভাজ্য, কঠিন। বীজ ও দীর্ঘ, কৌণিক।
জারুলের কাণ্ড নাতিদীর্ঘ, মসৃণ, ম্লানধূসর এবং শীর্ষ অজস্র শাখায় ছত্রাকৃতি। খসেপড়া বাকলের আঁকাবাঁকা চিহ্নে চিত্রিত কাণ্ড অনেকটা পেয়ারার সঙ্গে তুলনীয়। পাতা লম্বা, চওড়া এবং গাঢ়-সবুজ। জারুলের বয়স্ক পাতা অনেক সময় রক্তিম। এই পাতার পিঠের রং ঈষৎ ম্লান, পত্রবিন্যাস বিপ্রতীপ। শীত পাতা-খসানোর দিন। অবশ্য গাছটি দীর্ঘদিন নিষ্পত্র থাকে না। নিরাভরণ শাখা বসন্তের শেষে আবার কচি পাতার উজ্জ্বল সবুজে ভরে ওঠে এবং পর পরই আসে প্রস্ফুটনের ঢল। শাখান্তের বিশাল মঞ্জরি, উজ্জ্বল বেগুনি বর্ণের উচ্ছলতা এবং ঘনসবুজ পাতার পটভূমিকায় উৎক্ষিপ্ত পুষ্পচ্ছটা শুধু দুষ্প্রাপ্য নয়, সৌন্দর্যে অনন্যও।
জারুল ফুলের বেগুনি রং যেমন আকর্ষণীয় তেমনি শোভন-সুন্দর তার পাপড়ির নমনীয় কোমলতা। ছয়টি মুক্ত পাপড়িতে গঠিত এই ফুল বেগুনি, কখনও সাদার কাছাকাছি পৌছায়। পুরনো পাপড়ি পাণ্ডুবর্ণ এবং যেহেতু মঞ্জরি বহু-পৌষ্পিক, তাই সাদায় বেগুনিতে মিলেমিশে প্রস্ফুটনে সব সময়ই বৈচিত্র্যের রেশ থাকে। ফুলের কেন্দ্রে বহু খাটো পুংকেশর পরস্পরের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে, তাদের পরাগকোষ হলুদ। বৃত্তি দৃঢ়, ধূসর-সবুজ, রোমশ ও যুক্ত। পাপড়ির মতো স্বল্পায়ু নয়, প্রস্ফুটনের শেষেও বৃতি ঝরে পড়ে না, ফলের সঙ্গে লেগে থাকে। | ফল ডিম্বাকৃতি ও বৃতিযুক্ত। প্রস্ফুটনের পর পরই শাখা ফলভারে নুয়ে পড়ে। অবশ্য প্রথম প্রস্ফুটনের পর ফুলের প্রাচুর্য মন্দ হলেও বর্ষা থেকে শরৎ অবধি জারুল গাছে ফুলের রেশ লেগে থাকে। বছর ঘুরে এলে পাতা ঝরার দিনে ঝরে পড়ে এই ফলেরাও। বীজ পক্ষল এবং সহজেই অংকুরিত হয়। বৃদ্ধিও দ্রুত, মাত্র পাঁচ-সাত ফুট উঁচু গাছও অনেক সময় প্রস্ফুটিত হয়। দৃঢ়তা, দীর্ঘায়ু, বর্ণসজ্জা এবং প্রস্ফুটনের ঐশ্বর্যে জারুল আদর্শ পথতরুই শুধু নয়, বাগান আর বাড়ির প্রাঙ্গণেও রোপণযোগ্য। জলসহিষ্ণু বিধায় দূরদূরান্তগামী জনপথের দুপাশের নিচু জলাভূমিতে রোপণের পক্ষে জারুল খুবই উপযুক্ত।
বিস্তৃতি:
জারুল ভারতীয় উপমহাদেশের নিজস্ব বৃক্ষ। বাংলাদেশ, ভারত ছাড়াও চীন, মালয়েশিয়া প্রভৃতি অঞ্চলে জারুলের সন্ধান মেলে। বাংলাদেশের নিম্নভূমির অন্তরঙ্গ তরুদের অন্যতম এই জারুল। কিন্তু জলাভূমি ছাড়াও স্বাভাবিক শুষ্কতায়ও বাঁচে। অন্যথা, ঢাকাবাসীর পক্ষে জারুলের আশ্চর্য প্রস্ফুটন দেখা অসম্ভব হতো। ঢাকায় বীথিতরুর প্রস্ফুটনের বর্ণবৈচিত্র্যে লালের ভাগ যত বেশি বেগুনির অংশ সেই পরিমাণেই কম। জারুল সেই দুষ্প্রাপ্য বর্ণ-ঐশ্বর্যের অধিকারী। রোকেয়া হলের আশপাশে, নীলক্ষেতে, রমনা পার্কে এবং মিন্টো-বেইলী রোডে জারুলের অঢেল প্রাচুর্য। গ্রীষ্মের শুরুতে এই উচ্ছল প্রস্ফুটন ঢাকার পথ-শোভায় উজ্জ্বলতা ছড়ায়।
ব্যবহার:
জারুল আমাদের অন্যতম প্রয়োজনীয় কাঠের জোগানদার। লালচে রঙে এই কাঠ দৃঢ়, দীর্ঘস্থায়ী এবং বহু কাজে ব্যবহার্য। ঘরের কড়ি-বরগা থেকে নৌকা, গরুর গাড়ি, চাষের যন্ত্রপাতি, সাধারণ আসবাব সবই এ কাঠে তৈরি হয়। এই কাঠ আবার আর্দ্রতাসহিষ্ণু।
জারুলের ভেষজ মূল্যও কম নয়: শিকড় বিরেচক, উত্তেজক ও জ্বররোধী, পাতা ও বাকল রেচক, বীজ নিদ্রাকর্ষী। জারুলের আদি-আবাস চীন, মালয় ও বাংলা-ভারতের জলাভূমি অঞ্চল। নামের প্রথমাংশে ‘লেজারস্ট্রমিয়া’ সুইডেনের অন্যতম তরু-অনুরাগী ল্যাজারস্ট্রমের (১৬৯১-১৭৫৯) স্মারক। ‘স্পেসিওজা’ লাতিন শব্দ, অর্থ সুন্দর।
সাহিত্যে জারুল:
জারুলকে নিয়ে জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন, ‘ভিজে হয়ে আসে মেঘে এ দুপুর চিল একা নদীটির পাশে/জারুল গাছের ডালে বসে বসে চেয়ে থাকে ওপারের দিকে’।
তথ্যসূত্র:
১. দ্বিজেন শর্মা, শ্যামলী নিসর্গ, কথাপ্রকাশ, ঢাকা, চতুর্থ মুদ্রণ, জানুয়ারি ২০১৬ পৃষ্ঠা ৫৭-৫৯।
২. দ্বিজেন শর্মা লেখক; বাংলা একাডেমী ; ফুলগুলি যেন কথা; মে, ১৯৮৮; পৃষ্ঠা-২৪,
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।