কানাইডিঙ্গা-এর বিবরণ:
কানাইডিঙ্গা ছোট থেকে মাঝারি আকৃতির পাতাঝরা বৃক্ষ, উচ্চতায় ৮-১২ মিটার বা সর্বোচ্চ ২০ মিটার হয়ে থাকে। এদের গুঁড়ি কান্ড সরল সোজা নলাকার এবং বাকল পুরু, নরম ও ধূসর বাদামি বর্ণের। পাতা যৌগিক, বোটা লম্বাটে, পত্রফলক লম্বায় ১২০-১৮০ সেন্টিমিটার, দ্বি বা ত্রি-শ্বাখান্বিতভাবে এবং অসংখ্য পত্রকযুক্ত। পত্রকগুলো ডিম্বাকার, লম্বায় ৭-২০ সেন্টিমিটার ও চওড়ায় ২-৭ সেন্টিমিটার, কিনারা ঢেউ খেলানো এবং আগা সূচালো। পত্রকগুলো ঝরে পড়ার আগে তামাটে বাদামি বা লালচে বর্ণের হয়ে থাকে। কাণ্ড ও ডালপালা ততটা নিশ্ছিদ্র নয়। পাতা সমদূরত্বে সারিবদ্ধ, বেশ নান্দনিক।
জুন-জুলাই মাসে ডালপালার আগায় খাড়াভাবে উৎপন্ন লম্বাটে পুষ্পবিন্যাসে ক্রমাগতভাবে নিচ থেকে উপরের দিকে বড় ঘন্টাকৃতির লালচে বর্ণের ফুল ফোটে এবং ফুলগুলো দুর্গন্ধযুক্ত। দীর্ঘ সময় ধরে ফুল ফোটে; বর্ষার শেষভাগ থেকে প্রায় হেমন্ত অবধি। লম্বাটে মঞ্জরিদণ্ডের আগায় আঙুলের ডগার মতো অসংখ্য কলি ঈষৎ ঝুলে থাকে। রাতে বাদুর ফুলে ফুলে বিচরণ করে পরাগায়ন ঘটায়। দিনের আলোয় কোনো ফুল ফোটার প্রস্তুতি চোখে পড়ে না। রাতের অন্ধকারে অতি দ্রুততার সঙ্গে তা শেষ হয়। ফুল প্রথম দর্শনে পীতপাটলাও মনে হতে পারে। গুচ্ছবদ্ধ ফুল বেশ বড়, ঈষৎ হলুদ ও বেগুনি রঙের। ৫টি পাপড়িই গভীরভাবে মোড়ানো, পরাগকেশর স্পষ্ট।
ফল পড জাতীয়, তলোয়ারের মতো বাঁকা, লম্বায় ৪৫-৭৫ সেন্টিমিটার ও চওড়ায় ৫-৮ সেন্টিমিটার, উভয় পার্শ্ব চ্যাপটা এবং দুই প্রান্ত ক্রমাগত সরু। প্রতিটি ফলের ওজন ৭৭-১২৬ গ্রাম হয়ে থাকে। নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে পাতাবিহীন ডালপালাতে লম্বাটে কাষ্ঠল ধরনের কালচে বর্ণের পরিপক্ক ফলগুলো ঝুলে থাকে। ফলগুলো আপনি-আপনি ভাবে ফেটে গিয়ে বীজ বের হয়। বীজগুলো লম্বায় ৫-৭ সেন্টিমিটার, চ্যাপ্টা ও সাদা বর্ণের এবং বীজের তিন পার্শ্ব কাগজের মতো পাতলা পাখনাযুক্ত।
প্রজনন ও বংশবিস্তার:
বনাঞ্চলে প্রাকৃতিকভাবে কানাইডিঙ্গার বীজ থেকে চারা ও গাছ জন্মায়। নার্সারিতে সংগৃহীত বীজ পলিব্যাগে বপন করে চারা উৎপাদন করা যায়। বীজের অঙ্কুরোদগমন হার শতকরা প্রায় ৫০ ভাগ।
ভৌগোলিক বিস্তৃতি:
বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভূটান, মায়ানমার, শ্রীলংকা, চীন, জাপান, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়া।
বাংলাদেশে বিস্তৃতি ও প্রাপ্তিস্থান:
চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের মিশ্র চিরসবুজ বনে এবং গাজীপুর, ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইলের পাতাঝরা শাল বনে বিক্ষিপ্তভাবে জন্মানো কানাইডিঙ্গা গাছ দেখা যায়। বনের কিণারা বা প্রান্তভাগে এ গাছ দেখা যায়। দেশব্যাপী গ্রামীণ ঝোপঝাড়ে ও বসতবাড়িতে কানাইডিঙ্গা গাছের দেখা পাওয়া যায়। এ ছাড়া ঢাকার মিরপুরে অবস্থিত জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে এবং চট্টগ্রামস্থ বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউট ক্যাম্পাসে লাগানো কানাইডিঙ্গার কিছু গাছ রয়েছে। এছাড়া, আরণ্যক ফাউন্ডেশন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি ইন্সটিটিউটের সহযোগীতায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ২০১৪-১৫ সালে বেশ কিছু গাছ লাগিয়ে সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে।
গুরুত্ব ও ব্যবহার:
কাঠ হলুদাভ-বাদামি বর্ণের, ভারী ও মজবুত। বাকল ও ফল (পড) থেকে ট্যানিন ও রং পাওয়া যায়। কচি সবুজ ফল (পড) তরকারি হিসেবে রান্না করে খাওয়া যায়। বাকল ও বাকলের রস জন্ডিস রোগ, বাতের ব্যাথা ও জয়েন্টের ব্যাথা নিরাময় করে। শিকড় ও বীজ থেকে তৈরি ঔষধ আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।
আমার অভিজ্ঞতা:
কানাইডিঙ্গা গাছের নামটির সাথে পরিচিত হই ময়মনসিংহের গফরগাঁয়ে চাকরীকালীন ২০০৬ সালের দিকে। গফরগাঁও সরকারি কলেজে একটি গাছ অনেক মেহগনি গাছের ভেতরে অযত্নে টিকে ছিল। এখন আছে কিনা জানি না। তবে প্রায় দেড় হাত বা দুই ফুট লম্বা নৌকার বা ডিঙ্গার মতো ফলটি আমাকে খুব টানত। প্রায় চার ইঞ্চি লম্বা ফুলটিও মুগ্ধ করেছে।
বহুদিন পর সেই গাছটি হটাত আবিষ্কার করি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে। কিন্তু কিছুদিন পর সেখানে দেখি বিল্ডিং তৈরির জন্য টিনের বেড়া উঠছে। ভয় পেয়ে যাই, কানাইডিঙ্গার আসন্ন মৃত্যু কল্পনা করে। কিন্তু পরে দেখি গাছটি কাটা পড়েনি।
ময়মনসিংহের কয়েকটি গ্রামে এ গাছটি এখনো টিকে আছে। আমার ময়মনসিংহের বন্ধুরা কী পারবেন এ গাছটিকে রক্ষা করতে। উল্লেখ্য ঢাবি বোটানিক্যাল গার্ডেনে এবং মিরপুরের জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে এ গাছটি আছে।
ছবির ইতিহাস:
কানাইডিঙ্গা গাছের ফলের ছবিটি ময়মনসিংহের দাপুনিয়া ইউনিয়নের কোনো এক গ্রাম থেকে ৪ অক্টোবর, ২০১৩ তারিখে তুলেছেন বিজন সম্মানিত।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।