খয়ের গাছ-এর নানাবিধ ভেষজ প্রয়োগ ও গুণাগুণ

খয়ের গাছ-এর কথা মনে এলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে পান খাওয়া টকটকে লাল ঠোঁট আর জিহ্বার দৃশ্য। আমাদের দেশে খয়েরের অন্য কোনো পরিচয় সাধারণের নিকট থেকে জানা যায় নি।

অন্যান্য নাম:

বাংলায় খয়েরের আরও বেশ কয়েকটি নাম আছে যেগুলো বিভিন্ন গ্রন্থ, উপন্যাসে দেখা যায়, যেমন কালপত্র, পত্রী, ক্ষিতী, ক্ষক্ষা, সুশল্য, বক্রকণ্ট, যজ্ঞাঙ্গ, দন্তধাবন, গায়ত্রী, জিক্ষশল্য, কন্টী, সারুদ্রম, কুষ্ঠারি, বহুসার ও মেধ্য। এ ছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন ভাষার নাম- সংস্কৃত- খদির; হিন্দি- খৈর; মায়ানমার- শ; ইউনানী- কাত, ক্বাথসফেদ, ক্কাথ সুখ; ইংরেজিতে- Cutch tree, catechu tree.

খয়ের গাছ-এর বিবরণ:

খয়ের মধ্যম আকারের পাতাঝরা বৃক্ষ। যার হালকা পালকসদৃশ। পাতার দৃষ্টিনন্দন পল্লব আছে। গাছের উচ্চতা এবং কাণ্ডের বেড় প্রায়ই বাবলা গাছের মতো, কিন্তু বাবলার বিপরীতে এর কাটাগুলো নিচের দিকে নোয়ানো। অগ্রভাগ সুচালো কিন্তু ভিত্তিস্থলে স্ফীত দেখতে শিমুলের কাটার মতো; এদের ছোট কাটা থাকে। পাতা পক্ষল; ফুল হালকা হলুদ। ফল আরোমশ, কিঞ্চিৎ বাঁকা বা কোঁকড়ানো থাকে। জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় মাসে ফুল শুরু হয়ে ভাদ্র-আশ্বিন পর্যন্ত তা চলতে থাকে এবং কার্তিক থেকে পৌষ-মাঘ পর্যন্ত সময়কালে দেখা যায়। পাকার পরই ফল ফেটে গিয়ে ফলের খোসাসহ বীজ মুক্ত হয়ে বায়ু এবং পানিতাড়িত হয়ে বিস্তৃত হয়ে যায়।

আরো পড়ুন: খয়ের দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বাণিজ্যিক ও ভেষজ গুণে ভরা বৃক্ষ

খয়ের গাছ-এর বিস্তৃতি:

খয়ের কিন্তু আমাদের এ উপমহাদেশের দেশজ উদ্ভিদ। তবে এটি আংশিক মরুদ্ভিদ বলে ঝুরঝুরে দোআঁশ এবং বালি ও কাদার বিভিন্ন অনুপাতে মিশ্রিত বেলে বা কঙ্করময় মাটিতে ভালো জন্মে । ভেজা আর্দ্র অঞ্চলে এ বৃক্ষ লাগানো হলেও গুণগত মান কমে যায়। বাংলাদেশের রাজশাহী, যশোরসহ উত্তরবঙ্গের টানি জমিতে খয়ের জন্মে। উপগোত্র- মাইমোসী।

প্রাচীন গ্রন্থে:

খয়েরকে আমাদের নিকট পান খাওয়ার অনুপান হলেও অথর্ববেদের বৈদ্যক কল্পের ১৩.৩১.৫১ সূক্তে যূপম ও মেধ্য নামে খয়েরকে উল্লেখ করা হয়েছে। বৈদিক সূক্ত ধরে চরক, সুশ্রুত, অত্রিসংহিতা, হারীত, চক্রদত্ত, ভাবপ্রকাশ, বাগভটসহ প্রতিটি প্রাচীন গ্রন্থেই এর সার কাঠে বীর্যশক্তি সংহত থাকার কথা বলে রক্তদুষ্টিজনিত বা শোণিত স্রোতে ব্যাধি রোগের ক্ষেত্রে প্রয়োগের কথা বলা হয়েছে। চরক সংহিতায় কুষ্ঠ রোগীকে খদিরের ক্কাথ সেবন করতে বলা হয়েছে।

আরো পড়ুন:  বন ধনে বা বন ধুনিয়া বাংলাদেশের সর্বত্রে জন্মানো ভেষজ বিরুৎ

বাংলাদেশ জাতীয় আয়ুর্বেদিক ফমুর্লারি ১৯৯২-তে ২৫টি ওষুধে খয়েরের ব্যবহারের উল্লেখ দেখা যায়। বাংলাদেশ জাতীয় ইউনানী ফর্মুলারী ১৯৯৩-তে খয়েরকে দু’ভাগে। উল্লেখ করা হয়েছে- ক্বাথ সফেদ (সাদা খয়ের) হিসাবে ১২টি ওষুধে এবং কাত সুখ (লাল খয়ের) হিসাবে ২টি ওষুধের উপাদান হিসাবে ব্যবহার করা হয়।

ভেষজ গুণ:

১. আমাশয় সারাতে: এক গ্রাম মাত্রায় খয়েরের চূর্ণ ব্যবহার করলে প্রাপ্তবয়স্কের আমাশয় রোগ ভালো হয়ে যায়।

২. জ্বর, কাশি কমাতে: খয়ের জ্বরনাশকও বটে। আলজিভ বৃদ্ধি হলে এবং তজ্জনিত কাশিতে ছোট এক টুকরা এটি মুখে রেখে চুষলে বিশেষ ফল পাওয়া যায়।

৩. ক্ষত সারাতে: পুরাতন ক্ষত এবং সিফিলিসের প্রাথমিক ক্ষতে এর চূর্ণ ব্যবহার করে বিশেষ ফল পাওয়া যায়। এছাড়া গনোরিয়ার গভীর নালীক্ষত এবং অত্যধিক রজঃস্রাবে ও শ্বেতস্রাবে এর ব্যবহার অত্যধিক ফলদায়ক।

৪. যৌনসম্ভোগে: খয়ের অল্প মাত্রায় ব্যবহারে। যৌনসম্ভোগের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় কিন্তু অতিমাত্রায় ব্যবহার করলে পুরুষত্বহানি ঘটে।

এছাড়া খয়ের দাঁতের গোড়া থেকে রক্ত পড়া বা স্কার্ভি বন্ধ করে। খয়েরের গাছের সার কাঠ এবং সার কাঠের নির্যাসই মূলত বাণিজ্যিক খয়ের বা ক্থ অর্থাৎ হালকা রঙের খয়ের বা কুথ অর্থাৎ গাঢ় রঙের খয়ের ২০ থেকে ৩০ বছর বয়সী গাছের সার কাঠ থেকে পাওয়া যায়। এ সার কাঠের মুল উপাদান হলো ক্যাটেচিন এবং ক্যাটেচুট্যানিক অ্যাসিড।

সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।

তথ্যসূত্রঃ

১. ড. সামসুদ্দিন আহমদ: ওষুধি উদ্ভিদ (পরিচিতি, উপযোগিতা ও ব্যবহার),  দিব্যপ্রকাশ, বাংলাবাজার, ঢাকা, জানুয়ারি ২০১২, পৃষ্ঠা, ৩৬-৩৭।

বি. দ্র: ব্যবহৃত ছবি উইকিমিডিয়া কমন্স থেকে নেওয়া হয়েছে। আলোকচিত্রীর নাম: J.M.Garg

Leave a Comment

error: Content is protected !!