ফাইশ্যা উদাল বাংলাদেশের রক্ষিত মহাবিপন্ন উদ্ভিদ

ফাইশ্যা উদাল

বৈজ্ঞানিক নাম: Sterculia villosa Roxb. সমনাম: Sterculia ornata, Sterculia armata; Sterculia lantsangensis Hu, বাংলা ও স্থানীয় নাম: ফাইশ্যা উদাল, ছহালা (ঢাকা), উদাল (সিলেট), ফিউ বান (মগ/মারমা), উমাক (গারো), নামসিং (ম্রো), ইংরেজি নাম: Elephant rope tree, Hairy Sterculia.
জীববৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাস
জগৎ/রাজ্য: Plantae – Plants.  শ্রেণী: Eudicots. উপশ্রেণি: Rosids. বর্গ:  Malvales. পরিবার: Malvaceae. উপপরিবার: Sterculiaceae. গণ: Sterculia. প্রজাতি: Sterculia villosa.

ফাইশ্যা উদাল-এর বিবরণ:

ফাইশ্যা উদাল ছোট থেকে মাঝারি আকৃতির পাতাঝরা বৃক্ষ, উচ্চতায় ১০-১৫ মিটার পর্যন্ত হয়। এদের গুঁড়ি কান্ড সরল, সোজা, গোলাকার এবং ডালপালাগুলো চক্রাকারে বিস্তৃত। কান্ড ও ডালপালাতে ঝরে পড়া পাতার হৃদপিন্ডার চিহ্ন দেখা যায়। বাকল ধূসর বর্ণের, পুরু, মসৃণ এবং আঁশযুক্ত। এই গাছের ডালপালার আগায় পাতাগুলো গুচ্ছাকারে সজ্জিত। পাতার বোটা ২৫-৪০ সেন্টিমিটার লম্বাটে এবং পত্রফলক হাতের তালুর মতো, প্রশস্ততায় ৩০-৪৫ সেন্টিমিটার। পাতার কিনারা ত্রিকোণাকৃতিভাবে ৫-৭ খন্ডে বিভক্ত এবং প্রতি খন্ড আবার ৩ খন্ডে খন্ডিত।

জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে পাতা ঝরে পড়ে। মার্চ-এপ্রিল মাসে নতুন গজানো পাতা লালচে বর্ণের ও প্রচুর লোমশযুক্ত। ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে ডালপালার মাথায় গুচ্ছাকারে ঘণ্টাকৃতির হলুদ বা ক্রিম-হলুদ বর্ণের ফুল ফোটে। ফুলগুলোর কেন্দ্রভাগ মেরুন বা লাল বর্ণযুক্ত। এদের ফলগুলো কিডনি আকৃতির, লম্বায় ৪-৮ সেন্টিমিটার এবং গুচ্ছাকারে সজ্জিত। এপ্রিল-মে মাসে পরিপক্ক ফল লালচে বর্ণের হয়। প্রতিটি ফলের ভিতর কালো বর্ণের অনেক বীজ থাকে। প্রতি কেজিতে বীজের সংখ্যা ৫,৬০০-৬,০০০টি। সাধারণ তাপমাত্রায় বীজ ২০-২৫ দিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়।

ফাইশ্যা উদালের ফুল, আলোকচিত্র: J.M.Garg

ভৌগোলিক বিস্তৃতি:

ফাইশ্যা উদাল দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ ভারতের নিজস্ব গাছ হিসেবে পরিচিত। এ গাছ বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভূটান, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া ও দক্ষিণ চীন পর্যন্ত বিস্তৃত।

বাংলাদেশে অস্তিত্বমূলক অবস্থা:

বর্তমানে বাংলাদেশে ফাইশ্যা উদাল গাছ খুব একটা দেখা যায় না। ২০১২ সালের প্রণীত বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনে ফাইশ্যা উদাল গাছকে রক্ষিত উদ্ভিদ (Protected Plant) হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বন উজাড়, ভেষজের জন্য এবং আঁশযুক্ত বাকল থেকে দড়ি/রশি বানাতে অতিরিক্ত গাছ আহরণ ও আবাসস্থল ধবংসের ফলে ফাইশ্যা উদাল প্রজাতির গাছের সংখ্যা কমে গেছে।

আরো পড়ুন:  কামদেব বাংলাদেশের রক্ষিত মহাবিপন্ন বৃক্ষ

বাংলাদেশে বিস্তৃতি ও প্রাপ্তিস্থান:

চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিশেষ করে বান্দরবানে ও কক্সবাজারের মিশ্র চিরসবুজ বনে এবং গাজীপুর, ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইলের পাতাঝরা শাল বনের স্যাঁতসেঁতে জায়গায় বিক্ষিপ্তভাবে জন্মানো কিছু ফাইশ্যা উদাল গাছ দেখা যায়। এ ছাড়া চট্টগ্রাম অঞ্চলে কিছু কিছু বসত বাড়িতে ফাইশ্যা উদালের গাছ দেখা যায়।

প্রজনন ও বংশবিস্তার:

প্রাকৃতিকভাবে বন এলাকায় বীজ থেকে চারা ও গাছ জন্মায়। এ ছাড়া নার্সারিতে সংগৃহীত বীজ পলিব্যাগে বপন করে চারা উৎপাদন করা যায়। বীজের অঙ্কুরোদগমের হার শতকরা ৪০-৪৫ ভাগ। চারা গজাতে সময় লাগে ১০-১৫ দিন। বর্ষার শুরুতে জুন মাসে এক বছর বয়সী চারা লাগানো হয়।

ফাইশ্যা উদাল-এর গুরুত্ব ও ব্যবহার:

কাঠ সাদা বর্ণের, বেশ নরম ও হালকা। গাছ থেকে নির্গত বর্ণহীন গাম/কষ ভেষজরূপে ব্যবহৃত হয়। বীজ আগুনে পুড়ে বা ভেজে খাওয়া যায় এবং স্বাদ বাদামের মতো। চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে ফাইশ্যা উদালের আঁশযুক্ত বাকল থেকে দড়ি/রশি বানিয়ে গরু-ছাগল বেঁধে রাখা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় বাকল থেকে বানানো ফিতা দিয়ে আদিবাসীরা বাঁশের ঝুড়িকে মাথার কপালে বেঁধে মালামাল পরিবহন করে থাকে। এ ছাড়া আদিবাসীরা আঁশযুক্ত বাকল থেকে পরিধেয় মোটা কাপড় বুনে থাকে। গাছ একটু বড় হলে গাছের ছাল তুলে রশি বানাতে গিয়ে গাছ আর বড় হতে পারে না। অনেক সময় গাছ মারা যায়।

সংরক্ষণের জন্য গৃহীত পদক্ষেপ:

আরণ্যক ফাউন্ডেশন-এর সহযোগিতায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশ বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ২০১২, ২০১৩ ও ২০১৪ সালে ফাইশ্যা উদালের চারা লাগিয়ে প্রজাতিটিকে বিলুপ্তির হাত থেকে সংরক্ষণের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।

Leave a Comment

error: Content is protected !!