পরিচিতি: বহেড়া বৃক্ষ ৬০ থেকে ১০০ ফুট পর্যন্ত উচু হতে দেখা যায়, গাছের গুড়িও বেশ লম্বা, অবশ্য ছাল খুব বেশি পুরু হয় না, পাতা ৩ থেকে ৭ বা ৮ ইঞ্চি লম্বা হয়; দেখতে অনেকটা ছোট আকারের বট পাতার মতো, শীতকালে গাছের পাতা পড়ে যায়, বসন্তকালে আবার নতুন পাতা গজায়। পাতার বোঁটা (পত্রবৃন্ত) ১ বা দেড় ইঞ্চি লম্বা। ফুল ছোট, দেখতে অনেকটা নাকছাবির মতো, সেগুলি পুষ্পদণ্ডের চারদিকে যেন সাজানো; ফুলে নভেম্বরের দিকে হয় ফল; সেই ফল পুষ্ট হয় শীতের প্রাককালে, তারপর আপনা-আপনি পড়ে যেতে শুরু হয়; ফলে একটি বীজ, তার মধ্যে বাদামের মতো একটা মজ্জা আছে, যদিও সেটা আকারে ছোট তা হলেও খেতে অনেকটা কাগজী বাদামের মতো। এই বহেড়া ফল দুটি আকারের হতে দেখা যায় একটি গোল আর একটি ডিম্বাকৃতি, কিন্তু এরা প্রজাতিতে পৃথক নয়। বহেড়ার রয়েছে অনেকগুলো ভেষজ গুণ। ঔষধ হিসাবে ব্যবহার হয় এর ফল ও ফলমজ্জা।[১]
বর্ণনা: বহেড়া পর্ণমােচী বৃক্ষ, ৩০-৪০ মিটার উঁচু, পরিধি ১-২ মিটার, শীর্ষাংশ ব্যাপক বিস্তৃত, অধিমূল প্রশস্ত, বাকল পুরু, কালচে, অনুদৈর্ঘ্য চিড় যুক্ত। পত্র ৬-১৬ x ৫.০-১০.৫ সেমি, প্রশস্ত বিডিম্বাকার দীর্ঘায়ত থেকে বিডিম্বারাকার উপবৃত্তাকার, কখনও সরু বিভল্লাকার, কাগজবৎ থেকে চর্মবৎ, ক্ষুদ্র শাখায় সর্পিলাকারে বিন্যস্ত বা শাখার প্রান্তে সমাকীর্ণ, কখনও আবর্ত, শীর্ষ গােলাকার বা স্থলাগ্র, কখনও দীর্ঘা, মূলীয় অংশ গােলাকার, স্থূলা বা কর্তিতা, মূলীয় অংশ কখনও অসম, প্রান্ত অখন্ড , শিরা ৬-৮ জোড়া, প্রশস্ত ফাঁক যুক্ত, বৃন্ত ৩-৯ সেমি লম্বা, প্রথমে রােমশ পরবর্তীতে রােমশ বিহীন, গ্রন্থি অস্পষ্ট।[২]
পুষ্পবিন্যাস অক্ষীয় স্পাইক, ৩-১৫ সেমি লম্বা, মঞ্জরীঅক্ষ লালাভ, রােমশ, পুংপুষ্প শীর্ষাংশে এবং স্ত্রীপুষ্প মঞ্জরীর নিম্নাংশে জন্মে, মঞ্জরীপত্র সাধারণত অনুপস্থিত। পুষ্প হলদে, মুকুল অর্ধগােলাকার, অবৃন্তক। বৃতি ৪-৫ x ৪-৫ মিমি, বহিরাংশ মরচে রােমশ, মূলীয় অংশের অভ্যন্তর মরচে অতিরােমশ। খন্ড বহি: বা অন্তর্মুখী বক্র, ব-দ্বীপাকার, ১.৫ মিমি লম্বা। পুংকেশর ৩.০-৩.৫ মিমি লম্বা, মসৃণ, পরাগধানী ০.৮ মিমি লম্বা। গর্ভাশয় উপ-বৃত্তাকার, ১.৫-৫.০ মিমি লম্বা, গর্ভদন্ড ৪ মিমি লম্বা, মসৃণ, চাকতি ঘন মরচে রােমশ। ফল ড্রুপ, ২৩ x ১.৫-২.৫ সেমি, অর্ধগােলাকার থেকে প্রশস্ত উপবৃত্তাকার, শুষ্কাবস্থায় খুব শক্ত, সামান্য অনুদৈর্ঘ্য খাঁজ যুক্ত, ঘন রােমশ। বীজ ১.২ x ০.৫ সেমি, উপবৃত্তাকার অমসৃণ। ফুল ও ফল ধারণ ঘটে মার্চ থেকে নভেম্বর মাসে।[২]
ক্রোমোেসােম সংখ্যা: 2n = ২৬, ৪৮ (Fedorov, 1969).
আবাসস্থল ও চাষাবাদ: স্যাঁতস্যাঁতে পর্নমােচী অরণ্য এবং সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে কম উঁচু অর্ধচিরহরিৎ ও চিরহরিৎ অরণ্য। বীজে বংশ বিস্তার হয়।
বিস্তৃতি: বহেড়ার বিস্তৃতি দক্ষিণপূর্ব এশিয়া ও উত্তর অস্ট্রেলিয়া। এটি প্রধানভাবে জন্মে ভারতের ছোটনাগপুর, বিহার, হিমাচলপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশে; তবে ভারতের অন্যান্য প্রদেশের অঞ্চশ বিশেষে বিক্ষিপ্তভাবেও হয়ে থাকতে দেখা যায়। এই পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম, বাঁকুড়া ও বর্ধমানের শালবনেও প্রচুর জন্মে। তবে পূর্বোক্ত প্রদেশে এ গাছ লাগানোর অর্থাৎ রোপণ করার দরকার হয় না; পতিত জমি ও মাঠের ধারে বীজ পড়ে আপনা-আপনিই গাছ হয়। বাংলাদেশের ঢাকা, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল জেলার পর্ণমােচী শাল অরণ্য এবং চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলার| অরণ্যেও জন্মে।
অর্থনৈতিক ব্যবহার ও গুরুত্ব: বহেড়ার ফল সঙ্কোচক, রেচক এবং কাশি, গলাভাঙ্গা স্বর ও চোখের পীড়ায় উপকারী । অন্তবজি চেতনা নাশক রূপে পরিচিত তাই অঙ্গের প্রদাহে বাহ্যিক ব্যবহার করা হয় (Watt, 1988)। ফল বেশি গ্রহণ করা হলে মাতাল হওয়ার সম্ভাবনা। কাষ্ঠ শক্ত তবে টেকসই নয়, পানিতে ভাল থাকে। প্যাক-বাক্স, কফিন-বাক্স, পুঁড়ি কুঁদিয়া নৌকা, শালতিজাতীয় নৌকা, কাঠের ভেলা, শামপান, শস্যমাপন যন্ত্র, লাঙ্গল প্রভৃতির তৈরিতে কাষ্ঠ ব্যবহার করা হয়। বীজের শাঁস হাপানি রােগ নিরাময়কারীরূপে প্রচলিত।
ঔষধার্থে ব্যবহার: বহেড়ার ভেষজ গুনাগুণ সম্পর্কে জানতে পড়ুন
অন্যান্য তথ্য: বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষের ৭ম খণ্ডে (আগস্ট ২০১০) বহেড়া প্রজাতিটির সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, এদের শীঘ্র কোনো বড় বিপদের সম্ভাবনা নেই এবং বাংলাদেশে এটি আশঙ্কামুক্ত হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশে বহেড়া সংরক্ষণের জন্য কোনো পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি। প্রজাতিটি সম্পর্কে প্রস্তাব করা হয়েছে বাগানে ও বাসা বাড়িতে অধিক আবাদের উৎসাহ করা যেতে পারেভেষজ ওষুধ ত্রিফলার অন্যতম উপাদান এবং বাড়ির ছােটখাটো অসুখে ব্যবহার যােগ্য বলে প্রতিটি বাড়ীতে এর একটি করে গাছ রােপণ করা উচিৎ।[১]
সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।
তথ্যসূত্রঃ
১. আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য, চিরঞ্জীব বনৌষধি খন্ড ২, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৩৮৩, পৃষ্ঠা, ২৮৯-২৯২।
২. এম কে মিয়া (আগস্ট ২০১০)। “অ্যানজিওস্পার্মস ডাইকটিলিডনস” আহমেদ, জিয়া উদ্দিন; হাসান, মো আবুল; বেগম, জেড এন তাহমিদা; খন্দকার মনিরুজ্জামান। বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ। ৭ (১ সংস্করণ)। ঢাকা: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। পৃষ্ঠা ২৪৯-২৫০। আইএসবিএন 984-30000-0286-0
বি. দ্র: ব্যবহৃত ছবি উইকিপিডিয়া কমন্স থেকে নেওয়া হয়েছে। আলোকচিত্রীর নাম: Dinesh Valke
জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ সম্মান ও এমএ পাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। বিভিন্ন সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রোদ্দুরে ডট কমের সম্পাদক।