পরিচিতি: কাঠ বাদাম কমব্রেটাসি পরিবারের উষ্ণমণ্ডলীয় অঞ্চলের একটি বৃক্ষ। এই গাছের ফলটি খাবারের যোগ্য, তাই একে একটি ফলদ বৃক্ষ বলা হয়। এদের অনেকগুলো নাম রয়েছে। বিভিন্ন স্থানে একে যেসব নামে ডাকা হয় সেগুলো হচ্ছে: বাংলা আখরোট, সিঙ্গাপুর আখরোট, ইবেলবো, মালাবার আখরোট, নিরক্ষীয় আখরোট, সমুদ্র আখরোট, ছাতা গাছ, আব্রোফো নকাটি, জানমান্দি ইত্যাদি। এটিকে আলংকারিক উদ্ভিদ হিসেবে বিভিন্ন দেশে ব্যবহার করা হয়।
বিবরণ: কাঠ বাদাম মধ্যম থেকে বৃহৎ পর্ণমােচী বৃক্ষ, ২৫ মিটার পর্যন্ত উঁচু, কাষ্ঠ বাদামী বা লালাভ, শাখাসমূহ আবর্ত, আনুভূমিকভাবে বিস্তৃত, তরুণ বিটপ লাল রােমশ, পরবর্তীতে রােমশবিহীন। পত্র ৮-২৫ x ৪-১৪ সেমি, বিডিম্বাকার, কখনও উপবৃত্তাকার, চর্মবৎ বা কাগজবৎ, সর্পিলাকারে সজ্জ্বিত এবং শাখার প্রান্তে সমাকীর্ণ, শীর্ষ গােলাকার বা সামান্য দীর্ঘাগ্র মূলীয় অংশ সরু, হৃৎপিন্ডাকার, ২টি গ্রন্থিযুক্ত, প্রান্ত অখন্ড, শিরা ৬-৯ জোড়া, প্রশস্ত ফাঁকযুক্ত, উপরের পৃষ্ঠ মসৃণ ও উজ্জ্বল, গ্রন্থি গুটিকাকার, বৃন্ত শক্ত, মােটা, খাটো, ৫-১২ মিমি লম্বা, রােমশ।
পুষ্পবিন্যাস অক্ষীয় স্পাইক, উপরের অংশে পুংপুষ্প এবং মূলীয় অংশে অল্পকিছু উভলিঙ্গ পুষ্প জন্মে, স্পাইক ৮-১৫ সেমি লম্বা, মঞ্জরীঅক্ষ চাপা রােমশ, কখনও রােমশ বিহীন, মঞ্জরীপত্র ক্ষুদ্র, আশুপাতী। পুষ্প সাদা বা সাদাটে, অবৃন্তক। বৃতি ১২ x ৩-৫ মিমি, খন্ড ডিম্বাকৃতি ত্রিকোণাকার, ১.০-১.৫ | মিমি লম্বা। পুংকেশর ২.৫ মিমি লম্বা। গর্ভাশয় পুষ্পধার | সহ ২-৫ সেমি লম্বা, গর্ভদ ২ সেমি লম্বা রােমশ বিহীন, চাকতি ঘন রােমশ। ফল ডুপ, অতিপরিবর্তনশীল, ৩-৭x | ২-৫ সেমি, ডিম্বাকৃতি থেকে প্রশস্ত উপবৃত্তাকার, সবুজাভ হলুদ বা লাল, মােটামুটি পার্শ্বীয় চাপা, মসৃণ উজ্জ্বল, শুষ্কাবস্থায় কালচে। ফুল ও ফল ধারণ ঘটে মার্চ থেকে ডিসেম্বর মাসে।[১]
পরিবেশের কারণে এই গাছ ৫০ থেকে ১০০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। কাঠবাদাম গাছের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এদের উপরের দিক থেকে আনুভূমিকভাবে ডালপালা বের হয়। গাছের বয়স বাড়লে এর উপরের দিকের ডালপালা অনেকটা চ্যাপ্টা হয়ে যায়, তখন দেখতে ফুলদানীর মতো লাগে। শাখাপ্রশাখাগুলো স্তরে স্তরে সাজানো থাকে। এদের মতো আনুভূমিক বিস্তার খুব কম গাছেই দেখা যায় যে কারণে একে তুলনা করা হয় ‘প্যাগোডা’র সাথে যা চীন জাপান নেপাল ভারত প্রভৃতি এলাকার উপাসনালয়। ভারত-বাংলাদেশের সুপরিচিত বহু স্তবকবিশিষ্ট লাল-ভাঁটের (Clerodendrum paniculatum) পুষ্পমঞ্জরীও দেখতে অনেকটা এমন যে কারণে এর সাধারণ নাম ‘প্যাগোডা প্ল্যান্ট’। খুব শক্ত না হলে কোনো গাছের পক্ষে এমন আনুভূমিক বিস্তার সম্ভব নয়।
কাঠ বাদামের পাতা শুষ্ক মৌসুমে ঝরে যায়। পাতা ঝরে পড়ার আগে পাতাগুলো গোলাপী-লাল বা হলদেটে-খয়েরি রঙের হয়ে যায়। পাতা ঝরে যাবার আগে পাতায় যে রঙ হয় তার কারণ লুটিন, ভিয়োলাজ্যানথিন ও জিয়াজ্যানথিন নামের রঞ্জক পদার্থ। এই গাছের ফলটি রসালো প্রকারের ও ভেতরের প্রকোষ্ঠে কয়েকটি বীজ থাকে। বীজগুলো খাবার যোগ্য হয় ফল পাকার পর। বীজগুলো খেতে অনেকটা আখরোটের মতো।
পত্রপতন ও ফল ধরার সময়ও সব জায়গায় একরকম নয়। গড়পড়তা হিসাবে এটি শুষ্ক-ঋতু পত্রমোচী গাছ, বেশি বড় হলে যাতে অধিমূল বা বাট্রেস হতে দেখা যায়। হাওয়াইতে এই গাছ চিরসবুজ, দক্ষিণ ভারতে দো-ফসলা, কিন্তু ক্যারিবিয়ান দ্বীপে সারা বছর ফল ধরে। এর ফুল খুব ছোট, আধ সেন্টিমিটার আকারের যার সুঘ্রাণ থাকলেও মানুষ তা টের পায় না। ভারতে ও বাংলাদেশে বানর ও বাদুড় এর বীজের বিস্তার ঘটায়। বাদুড় এর ফল আহরণ করে অনেক দূরে আস্তানায় নিয়ে গিয়ে ধারালো দাঁতে কামড়ে খায়। এ ছাড়া জলের ধারে জন্মালে জলবাহিত হয়েও এর বিস্তার ঘটে। তবে অধিক দূরবর্তী অঞ্চলে মানুষই এর বিস্তার ঘটিয়েছে বলে এর সঠিক আদি নিবাস সম্পর্কে জানা যায় না।
আবাসস্থল ও বিস্তৃতি: প্রশস্ত রাজপথ। ছায়াতরু রূপে রােপণ করা হয়। বিস্তৃতি আছে মাদাগাস্কার, উষ্ণমন্ডলীয় এশিয়ার সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চল, ভারত থেকে তাইওয়ান, মালয় পেনিনসুলা থেকে উত্তর অস্ট্রেলিয়া অঞ্চলে। বাংলাদেশে ছায়াতরুরূপে রাজপথে ও উদ্যানে রােপণ করা হয়। দেশীয়করণ হয়েছে ভারতীয় উপমহাদেশ, দক্ষিণপূর্ব এশিয়া, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, নিউগিনি প্রভৃতি দেশে। আমেরিকাতে এই গাছ নতুন। গত শতাব্দীর মাঝামাঝি কাঠবাদাম গাছ ব্রাজিলের নগরসমূহে ভূদৃশ্যে ব্যবহার করা হয়েছে ‘রাস্তায় পাতা পড়া’ ইউরোপীয় আমেজে। এখন ওসব এলাকায় লাগানো হয়েছে ‘নেটিভ গ্রীন’।
অর্থনৈতিক ব্যবহার ওগুরুত্ব: কাঠ বাদামের বাকল, পত্র ও ফলে প্রচুর ট্যানিন থাকায় চামড়া রংয়ের কাজে এদের ব্যবহার করা হয়, এছাড়া রং ও কালি তৈরিতেও এরা গুরুত্বপূর্ণ। এই গাছের পাতা ফল ইত্যাদি অংশ সঙ্কোচক, মূত্রবর্ধক এবং হৃদযন্ত্রের টনিকরূপে সুপরিচিত। তরুণ পত্রের রস থেকে এক প্রকার অয়েনমেন্ট তৈরি করা হয় যা কুষ্ঠরােগ, খােস-পাঁচড়া এবং অন্যান্য চর্মপীড়া নিরাময় করে। পাতার রস পেটের শূল পীড়া ও মাথা ব্যথা নিরসনে খাওয়া হয়। বীজের শাস থেকে এক প্রকার গুরুত্বপূর্ণ তেল উৎপাদন করা হয়। এই শাঁস কাঁচাও খাওয়া হয় (Kunkel, 1984)। কাষ্ঠ শক্ত উজ্জ্বল, হালকা, টেকসই, মাঝামাঝি ধরনের শক্ত এবং পালিশ যােগ্য। কাষ্ঠ থেকে গৃহনির্মাণের সরঞ্জামাদি, হালকা নির্মাণের কাজ আসবাবপত্র তৈরি, নৌকা, জোয়াল, ও চাকা তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। ঘুণ ধরার সম্ভাবনা থাকে বলে কাঠ প্রসেস করে নেয়া ভাল। জাতিতাত্বিক ব্যবহার হিসেবে দেখা যায় ছােট শিশুরা ফল সংগ্রহ করে এবং বীজের শাস কাঁচা খায়। বীজে বংশ বিস্তার হয়। পলিনেশিয়ান দ্বীপপুঞ্জের মানুষ এর কাণ্ড দিয়ে ‘টিকি’ ভাস্কর্য তৈরি করে যাকে এরা ভাবে ‘সৃষ্টির প্রথম মানুষ’।
এই গাছ সমুদ্রের পাড়ে লাগানো হয় কারণ এদের শিকড়ের বিস্তারপদ্ধতি ভূমিক্ষয় রোধ করতে পারে। পলিমাটি, বালিমাটি, কাদামাটি এবং পাহাড়ি এলাকায় এই গাছ ভালভাবে জন্মায়। পুষ্টিহীন, অম্ল, ক্ষারীয় ও লবণাক্ত মাটিতেও এদের রোপন করা যায়। দ্রুতবর্ধনশীল এই গাছ বছরে এক মিটারের চেয়ে বেশি বাড়তে পারে বলে বনায়নের জন্য বেশ উপযোগী। গোটা উপমহাদেশের সমুদ্র উপকূলবর্তী লবণাক্ত অঞ্চলে বনায়নের জন্য কাঠবাদাম একটি নির্বাচিত গাছ হতে পারে।
ঔষধি ব্যবহার: এর নানাবিধ ঔষধি গুণ আছে। বিভিন্ন দেশে ডায়েরিয়া, আমাশয়, সন্ধিবাত, লিভারের রোগ, ডায়েবেটিস, বিভিন্নরকম চর্মরোগ, কুষ্ঠ, জন্ডিস ও অন্ত্ররোগের চিকিৎসায় এর ব্যবহার দেখা যায়। আকন্দ পাতার মত এই পাতা দিয়েও সেঁক দেয়া হাত পায়ের সন্ধি-ব্যথা কমানোর জন্য।
অন্যান্য তথ্য: বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষের ৭ম খণ্ডে (আগস্ট ২০১০) কাঠ বাদাম প্রজাতিটির সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, প্রজাতিটির সংকটের সম্ভাবনা নেই। বাংলাদেশে এটি বর্তমান অবস্থা ও আশংকা মুক্ত (lc) হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশে কাঠ বাদাম সংরক্ষণের জন্য কোনো পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি। প্রজাতিটি সম্পর্কে প্রস্তাব করা হয়েছে সংরক্ষণের প্রয়োজন নেই।[১]
তথ্যসূত্র:
১. এম কে মিয়া (আগস্ট ২০১০)। “অ্যানজিওস্পার্মস ডাইকটিলিডনস” আহমেদ, জিয়া উদ্দিন; হাসান, মো আবুল; বেগম, জেড এন তাহমিদা; খন্দকার মনিরুজ্জামান। বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ। ৭ (১ সংস্করণ)। ঢাকা: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। পৃষ্ঠা ২৫১-২৫২। আইএসবিএন 984-30000-0286-0
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।
অসাধারণ আর্টিকেল স্যার। দীর্ঘায়ু কামনা করি।