ভূমিকা: বাবলা (বৈজ্ঞানিক নাম: Vachellia nilotica ইংরেজি: Indian Gum Arabic Tree, Prickly Acacia, The Babul Tree) গাছের ভেষজ গুণাগুণ ও উপকারিতা অনেক। এই বাবলা গাছ হচ্ছে ফেবাসি পরিবারের ভ্যাসেলিয়া গণের মাঝারি আকৃতির কাঁটাযুক্ত লাল ফুলবিশিষ্ট দ্রুত বর্ধনশীল বৃক্ষ। এদের পাতা তেঁতুলের পাতার মতো। গাছের গায়ে কাঁটা আছে। এই বাবলা গাছের হিন্দি নাম ববুর, ববুল ও কীকর।
বাবলা ফেবাসি পরিবারের কাঁটাযুক্ত লাল ফুলের দ্রুত বর্ধনশীল বৃক্ষ
বাবলা গাছের নামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আর একটি গাছ এদেশে হয়; তার প্রচলিত গ্রাম্য নাম গুয়ে বাবলা। গুয়ে এই বিশেষণ দেওয়াটার কারণ হলো এই গাছের ত্বকে (ছালে) পাওয়া যায় যেন বিষ্ঠার গন্ধ, কিন্তু ফলে পাওয়া যায় বর্তমানের প্রসিদ্ধ Scent ‘মাইমোসা’র (Mimosa) গন্ধ। এই গাছগুলি আকারে ছোট হয় এবং এর বাড়-বাড়ন্ত কম; এটির বোটানিক্যাল, নাম Acacia farnesiana willd. এটি Leguminoseae ফ্যামিলিভুক্ত। এই Acacia গণের আরও বহু প্রজাতি আছে। আমাদের খদির বা খয়ের গাছ, শমী বা শাঁই গাছ এই Acacia গণভুক্ত।
রোগ প্রতিকারে বাবলার ব্যবহার
১. পাতলা দাস্ত হয় তার সঙ্গে আম সংযুক্ত আছে, সেক্ষেত্রে কচিপাতা ৩ থেকে ৪ গ্রাম আধ পোয়া জল সিদ্ধ করে এক ছটাক থাকতে নামিয়ে ছেকে, অল্প চিনি মিশিয়ে সেটা একবার বা দুইবারে খেতে হয়। এর দ্বারা ওটা সেরে যায়; তবে ঐ পাতা সিদ্ধ করার সময় কুড়চির ছাল ৩ থেকে ৪ গ্রাম দিয়ে থাকেন অনেক বৈদ্য, অবশ্য এটা চক্রদত্তের ব্যবস্থা।
২. ৫ থেকে ৭ গ্রাম পাতা ৩ কাপ জলে সিদ্ধ করে ১ কাপ থাকতে নামিয়ে ছেকে নিয়ে সেই জলে ক্ষত ধুলে ওটা সেরে যায়, এমনকি ক্ষতে পচনক্রিয়া আসতে দেয় না; এ ভিন্ন পাতার মিহি গুড়ো ক্ষতের উপর ছড়িয়ে দিলে ওটা সেরে যায়।
হাজা হলে বা অতিশয় জল ঘাঁটবার ফলে হাত-পায়ের আঙ্গুলের ক্ষতবিশেষ হলে এই পাতার মিহি গুড়ো হাজার উপর ছড়িয়ে দিতে হয়।
৩. কর্ণমূল হলে ডাক্তারি মতে এটির নাম মামস (Mumps). সাধারণতঃ কানের গোড়া ফোলা, তার সঙ্গে জ্বর (অবশ্য এ জ্বর হয় দুই একদিন বাদে) সেক্ষেত্রে পাতা ১০ থেকে ১২ গ্রাম, ভাজা বালি ২০ থেকে ২৫ গ্রাম, খয়ের (খদির) ২।৩ গ্রাম একসঙ্গে বেটে গরম করে ২/৩ বার প্রলেপ দিতে হবে। দুই-একদিনের মধ্যে ফোলা ও ব্যথা দুইই কমে যাবে। তবে জ্বর হলে আভ্যন্তরিক ঔষধের প্রয়োজন থাকবেই। তাছাড়া মামস ভিন্ন সন্নিপাতজনিত গাল, গলা ফোলায় ২। ৩ দিনেই আরোগ্য হয়।
৪. দাঁতের মাড়ি ফলা: উপরিউক্ত ঘনসারে একটু জল মিশিয়ে তুলি করে মাড়িতে লাগাতে হয়।
৫. মচকে গেলে: ফোলা বা ব্যথা দুই আছে অথবা ফোলা আছে ব্যথা নেই, সেক্ষেত্রেও একটু জল মিশিয়ে পাতলা করে লাগালে ওটা সেরে যাবে।
৬. গল ক্ষত: ২ থেকে ৩ গ্রাম ঘনসার নিয়ে আধ কাপ অল্প গরম জলে মিশিয়ে, সেই জলে কুল্লি (Gargle) করলে ওটা সেরে যায়; আর যদি মুখে বা গলায় ক্ষত থাকে সেটাও সেরে যায়। অথবা ১০।১২ গ্রাম বাবলা গাছের ছাল আধা সের জলে সিদ্ধ করে ১ কাপ থাকতে নামিয়ে, ছেকে, সেই জলে কুল্লি (Gargle) করলে যে গলার ঘা কিছুতেই সারছে না সেটা সেরে যাবে।
৭. প্রদর রোগে: এটা স্ত্রীরোগ, ঋতুমতী হওয়ার পর সব বয়সেই হতে পারে, এক্ষেত্রে ২ গ্রাম আন্দাজ ঘনসার এক পোয়া আন্দাজ জলে গুলে উত্তরবস্তি দিতে হয় যাকে বলা যায় ডুস দেওয়া ; এর দ্বারা সাদা সাবটা বন্ধ হয়ে যাবে।
৮. স্তনে ক্ষতে: শিশুদের মুখের টানে অনেক সময় এটা হয়, সেক্ষেত্রে বাবলা গাছের শুধু ছাল আন্দাজ ৮।১০ গ্রাম একট থেতো করে নিয়ে সেটা সিদ্ধ করে সেই জলে ধুয়ে ফেললে ওটা সেরে যায়।
৯. প্রবল কাসি: তার সঙ্গে কফের যোগ, সেক্ষেত্রে বাবলার ফল চূর্ণ ২ রতি (৪ গ্রেণ) মাত্রায় অল্প চিনি বা মিছরির গুড়া মিশিয়ে দিনে রাতে মোট ৩ বার খেতে হয়, এর দ্বারা শ্লেষ্মা উঠে যায়, কাসিও কমে।
১০. পিত্তের দাহে: ২/৩ গ্রাম গদ (বাবলার আঠা) আধ পোয়া জলে রাত্রে ভিজিয়ে রাখতে হবে, সকালে একটু চিনি মিশিয়ে সরবত করে খেতে হবে।
১১. রক্তস্রাব: সে উধ্ব বা আধো যে মার্গ থেকেই হোক না কেনো ৩/৪ গ্রাম গদের সরবত করে খেতে হয়, এর দ্বারা দুই-একদিনেই তার উপশম হয়।
১২. শত্রুতায়: যৌবনের গনোরিয়া রোগের পরিণতিতে প্রৌঢ়কালে প্রস্রাবের সময় মাঝে মাঝে কষ্ট হচ্ছে, সেক্ষেত্রে ২ গ্রাম আন্দাজ গ’দের গড়োর সরবত করে, তার সঙ্গে আমরুল শাকের (Oxalis Corniculata) রস ২ চামচ অথবা ৩ গ্রাম আন্দাজ শুকনো শাক ২ কাপ জলে সিদ্ধ করে সেই জলের সঙ্গে গদের গুড়া মিশিয়ে সরবত করে খেলে এই অসুবিধেটা চলে যায়। এটা প্রাচীন বৈদ্যগণের একটি মুষ্টিযোগ। মেহ রোগে শুধু, গদের গুড়ো ২/৩ গ্রাম সরবত করে খেলেও উপকার হয়।
১৩. শুষ্ক পুষ্টিতে: ছোট ছোট টুকরো গদকে ঘিয়ে ভেজে, গড়ো করে, তার সঙ্গে চিনি মিশিয়ে লাডু তৈরী হয়; এটার ওজন আন্দাজ ১০।১২ গ্রাম হবে। এই লাড্ডু একটি বা দুটি খেয়ে এক কাপ দুধ খেয়ে থাকেন ভারতের রাজস্থানীরা। তারা উপকার নিশ্চয়ই পেয়ে থাকেন।
১৪. বত্তিশা: এই বত্রিশ (৩২) সংখ্যাটির উচ্চারণের অপভ্রংশ হয়ে বত্তিশা হয়েছে; আসলে পেস্তা, বাদাম, কিসমিস, ছোট এলাচ, লবঙ্গ, বংশ লোচন, আখরোট প্রভৃতি ৩১টি দ্রব্যের সঙ্গে ঘিয়ে ভাজা গদকে গড়ো করে সব জিনিস চিনির সঙ্গে পাক করে লাডু বানানো হয়। হরিয়ানা, পাঞ্জাব এইসব অঞ্চলে প্রসূতা নারীর ভগ্নস্বাস্থ্যের পুনরুদ্ধার ও সুস্থ রাখার জন্য এইটি খাওয়ানোর রীতি আবহমান কাল থেকে চলে আসছে।
রাসায়নিক গঠন:
(a) Sucrose. (b) Tannin. (c) Enzyme. (d) Auxins.
সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।
তথ্যসূত্রঃ
১. আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য: চিরঞ্জীব বনৌষধি খন্ড ১, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৩৮৩, পৃষ্ঠা,২২৭-২২৮।
জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ সম্মান ও এমএ পাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। বিভিন্ন সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রোদ্দুরে ডট কমের সম্পাদক।
বাবলা পাতা সম্পর্কে অনেকের মুখে শুনেছি। কিন্তু আপনার এই পোস্টটি থেকে বিস্তারিত জানতে পারলাম। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ পোস্টটি শেয়ার করার জন্য।