গুইয়া বাবলা গাছ-এর নানাবিধ ভেষজ গুণাগুণ

গুইয়া বাবলা গাছ-এর কষে ঠোঁট প্রচুর লাল হয়। তবে মুখ থেকে বিষ্ঠার গন্ধ বের হয়, কেননা এর বাকল থেকে মলের গন্ধ বের হয়। কারণেই হয়তো এমন একটি উপকারী উদ্ভিদকে এমন বর্জ্য-সম্বন্ধীয় নাম দেয়া হয়েছে। এ গাছটির গুণের কদর করেও অনেকে নাম দিয়েছেন যেমন- গোকুল, গয়া বাবুল, অরিমেদ, বিটখদির, ইরিমেদ, কালস্কন্ধ। আমেরিকার উষ্ণ অঞ্চলে এর আদি নিবাস হলেও আমাদের এ অঞ্চলের অপেক্ষাকৃত শুষ্ক এলাকায় এ গাছ ভালোভাবে অভিযোজিত হয়েছে। ঝুরঝুরে বেলে পাথুরে মাটিতে ভালো হয়।

গুইয়া বাবলা গাছ-এর পরিচিতি:

গুইয়া বাবলা গাছ কাঁটাদার ঝোপজাতীয় গাছ ৪ থেকে ৫ মিটার পর্যন্ত উঁচু হতে পারে এবং খুব ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায়। পাতা দ্বিপক্ষল-খুব সরু, ১ সেমি-এর মতো লম্বা। গাছের ছাল ছাই রঙের। তিন বছর বয়স হলেই ফুল ধরতে থাকে, ফুল হলুদ রঙের এবং সুগন্ধি। ফল ৪ থেকে ৬ সেমি পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। গাছের কাছে গেলেই বিশ্রী মলের গন্ধ পাওয়া যায়। অথচ মজার ব্যাপার এর ফুল থেকে সুগন্ধ বের হয়, এ ফুল থেকে ‘ক্যাসি পারফিউম’ নামক বেশ মূল্যবান পারফিউম তৈরি করা হয়। নভেম্বর থেকে মার্চ মাস সময়কালে এর ফুল হয়। তারপর ফল হয়। এ গাছের পাতা, ফুল ও ছাল ওষুধে ব্যবহার করা হয়।

উদ্ভিদবিজ্ঞানীদের মতে এর আদি নিবাস আমেরিকার উষ্ণ অঞ্চল হলেও এ যুক্তি মেনে নিতে বড় কষ্ট হয়। কেননা যে-গাছের গুণপনা, বিশেষ করে ওষুধি মূল্যায়ন। সুপ্রাচীন অথর্ববেদে করা হয়েছে, সে-গাছ আমাদের দেশজ এবং সেই প্রাচীনকালের বৈদ্যগোষ্ঠীর নিকট সুপরিচিত ছিল না, এটা হয় না। ইহার ফল চামড়া পাকা করতে ব্যবহৃত হয়। ভেষজ গুণাবলীর মধ্যে ইহা কোষ্ঠবদ্ধতাকারী, কৃমিনাশক, আমাশয় প্রতিষেধক এবং মুখ ফোলা নিরাময়ক, দাঁতের ক্ষয়রোগ, চুলকানি, ব্রংকাইটিস, শ্বেতপ্রদর, আলসার, ফোলা প্রভৃতিতে উপকারী

প্রাচীন শাস্ত্রে:

এটি কোনো বাছবিচার না করে দুর্বল শক্তিকে বলবান করে এবং দুবৃত্তদের বিনাশ করে। চরক সংহিতার বিমান স্থানের ৮ম অধ্যায়ে কষায় স্কন্ধতে গুয়ে বাবলার (অরিমেদের) উল্লেখ আছে। চরকের সূত্রস্থানের ৪৯ অধ্যায়ে একপ্রকার আর্টিকেরিয়া (বোলতার হুল ফুটলে শরীরের স্থানে স্থানে যেমন ফুলে যায় তেমনি চামড়ার উপরে ফুলে যাওয়া) প্রশমনে অরিমেদ ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। আয়ুর্বেদের মতে কফ ও বায়ুর বিকারে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়। কিন্তু পিত্তবিকার অনুবন্ধী হয়ে থাকে। এ অবস্থায় একটি চিকিৎসা দরকার যার মাধ্যমে বায়ু ও শ্লেষ্মা প্রশমিত হয়, কিন্তু পিত্ত উত্তেজিত না হয়। এ লক্ষণে গুইয়া বাবলার ছাল উপকারী। সুশ্রত সংহিতার সূত্রস্থানের ৩৭ আধ্যায়ে সালসারাদিসমূহ বর্ণনায় এ অরিমেদকে কফবিকার, মেদবিকার এবং কুষ্ঠ, প্রমেহ কিংবা পাণ্ডুরোগে বা জন্ডিস খুবই কার্যকর বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এ ছাড়াও অমিতাচারী উচ্ছৃঙ্খল ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে এ ওষুধি কার্যকর।

আরো পড়ুন:  চন্দ্রকেতু দক্ষিণ এশিয়ায় জন্মানো ভেষজ গুল্ম

আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থায় প্রয়োগ:

প্রাচীন সংহিতাই শুধু নয়, আধুনিক কালেও গুইয়া বাবলার ব্যবহার কম নয়। বাংলাদেশ জাতীয় আয়ুর্বেদিক ফর্মুলারী ১৯৯২-তে ‘বৃহৎ খদির বটিকা’র প্রধান উপাদান হিসাবে গুইয়া বাবলা ছাল ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। এ ওষুধ মুখ, ঠোট, গলা, তালু, জিহ্বা, মাড়ির ঘা এবং দন্তশূল প্রশমক হিসাবে দেয়া হয়। বাংলাদেশ জাতীয় ইউনানী ফর্মুলারী ১৯৯৩ তে গুইয়া বাবলাকে ক্বাথ সফেদ হিসাবে উল্লেখ করে উপদংশ।

গুইয়া বাবলা গাছ-এর ঔষধি গুণাগুণ

১. ঘা ও ক্ষত সারাতে: গুইয়া বাবলা গাছ-এর ক্বাথ খোস-পাঁচড়া, নালি-ঘা, পচননিবারক ওষুধের উপাদান হিসাবে ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া এককভাবে গুয়ে বাবলা ব্যবহার করে কয়েকটি ক্ষেত্রে ভাল ফল পাওয়া গিয়েছে।

২. পাতলা বা আমযুক্ত মল: অনেকের মাঝে মধ্যে পাতলা বা আমযুক্ত খসখসে চটচটে মলত্যাগ করলে গুয়ে বাবলা গাছের ছাল ১০ গ্রাম পরিমাণ থেতলিয়ে ৫ থেকে ৬ কাপ পানিতে ভালোভাবে সেদ্ধ করে ২ কাপ থাকতে নামিয়ে ঐ পানিটা ২-৩ ঘণ্টা অন্তর ৪-৫ বারে খেতে হবে। এভাবে কয়েকদিন খেলে ঐ অসুবিধা চলে যায়।

৩. ডায়াবেটিস: প্রস্রাব করার পর সেখানে পিঁপড়ে লাগে অর্থাৎ কোনো রাসায়নিক বিশ্লেষণ ছাড়াই বোঝা যায় ঐ প্রস্রাবে চিনিজাতীয় দ্রব্য ছিলো এবং সেটাই মধুমেহ; এক্ষেত্রে গুয়ে বাবলার সারকাঠ ৫-১২ গ্রাম পরিমাণ ভালো করে ছেঁচে আধ লিটার পানিতে সেদ্ধ করতে করতে দু’কাপ পরিমাণ হয়ে এলে নামিয়ে ছেঁকে ঐ রসটা ২-৩ বার খেলে উপশম হবে।

৪. রক্ত পড়া বন্ধ করতে: কোনো ব্যক্তির যেখানে ঝলকে ঝলকে রক্ত উঠছে সেখানে এ গাছের তাজা ফুল পানিসহ থেঁতলিয়ে ১৫ থেকে ২০ ফোটা রস দুধসহ এবং শুকনো ফুল হলে তা চূর্ণ করে ২৫০ মিলিগ্রাম মাত্রায় অল্প মধুর সঙ্গে প্রতিদিন দুবার বা অবস্থা বুঝে একবার করে ২ থেকে ৩ দিন খাওয়ালে উপকার বোঝা যাবে।

আরো পড়ুন:  কুম্ভি গাছ-এর নানাবিধ ভেষজ গুণাগুণের বিবরণ

৫. স্বরভঙ্গ: জোরে চেঁচিয়ে কথা বলা বা ঠাণ্ডা লাগা অথবা টনসিলজনিত কারণে স্বরভঙ্গ হলে এ গাছের ছালচুর্ণ বা ছালের রস বের করে শুকিয়ে বড়ির মতো রেখে দিয়ে তা চুষে খেলে এ স্বরভঙ্গ দূর হয়।

সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।

তথ্যসূত্রঃ

১. ড. সামসুদ্দিন আহমদ: ওষুধি উদ্ভিদ (পরিচিতি, উপযোগিতা ও ব্যবহার),  দিব্যপ্রকাশ, বাংলাবাজার, ঢাকা, জানুয়ারি ২০১২, পৃষ্ঠা, ৩৮-৩৯।

বি. দ্র: ব্যবহৃত ছবি উইকিমিডিয়া কমন্স থেকে নেওয়া হয়েছে। আলোকচিত্রীর নাম: Dick Culbert

Leave a Comment

error: Content is protected !!