ভারতের উষ্ণ-প্রধান অঞ্চল সমূহের প্রায় সর্বত্রই এটির চাষ হয়ে থাকে; এমনকি ৩০০০ ফুট উচুতে পর্যন্তও চাষ হয়। তবে স্থানে স্থানে এর বাড়-বন্ধি বেশী, কোথাও আবার খুবই কম। সাধারণতঃ অল্প লোনা বেলে মাটিতে এটির বাড়-বাড়ন্ত, এবং অধিক ফলনের পক্ষে অনুকূল। বাংলায় এটির চাষ হলেও পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে পূর্ববঙ্গ ও উত্তরবঙ্গে বেশী হয়। ৭ থেকে ৮ বছরের গাছ না হলে ফল হয় না, ফল হওয়া আরম্ভ হলে তারপর ৮/১০ বছর ভাল ফল হয়, তারপর থেকে ফলন কমতে থাকে।
গাছ বেশ শক্ত, সরু, ও লম্বা, নারকেল গাছের মত শাখা-প্রশাখাহীন গাছ, তবে বাঁশের মত মোটা হয়। লম্বায় ২৫ থেকে ৩০ ফুট হতে সচরাচর লক্ষ্যে পড়লেও, বেশী দিনের গাছ হলে ৩০/৪০ ফুট পর্যন্ত উচু হতে যে দেখা যায় না তা নয়। নারিকেল পাতার মত পত্রদণ্ডের পরস্পর বিপরীত দিকে পাতাগুলি থাকে, লম্বায় দেড় থেকে দুই ফুটের মতো, পত্রদণ্ড ৭/৮ ফুট পর্যন্ত লম্বা হতেও দেখা যায়।
পুষ্পদণ্ড প্রায় নারকেলের পুষ্পদণ্ডের মতো, বহু, শাখা-প্রশাখা তাতে, চলতি কথায় সেটাই কাঁদি, কাঁদিতে প্রচুর ফল হয়, কাঁচায় ফলগুলো সবুজ, পাকলে লাল, হলদে বা কমলালেবুর রঙের মতো হয়। ফলের খোসা ছাড়ালে তার মধ্যে সুপারি পাওয়া যায়। বৎসরের প্রায় সব সময় অল্পবিস্তর ফল ও ফল হলেও বেশীরভাগ সুপারি সংগৃহীত হয় নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে।
সুপারি গাছের অন্যান্য নাম:
সংস্কৃতে একে পূগ, পোগীফলম; বাংলা ও হিন্দীতে সুপারি, বাংলার ও উড়িষ্যার অঞ্চল বিশেষে ‘গুয়া’ বলে। এটির বৈজ্ঞানিক নাম: Areca Catechu Linn., ফ্যামিলী Palmae. সুপারির কয়েকটি জাত আছে, সেগুলি এইরূপ:
১. Areca triandra Roxb.দেখতে লালবণ. বাংলাদেশের চট্টগ্রামে, আন্দামান, আইসল্যান্ড, সুমাত্রা প্রভৃতি স্থানে এটির চাষ হয়।
২. Areca gracilis Bl.-বর্তমান নাম Pinanga gracilis Kurz. সিকিম, আসাম, পূর্ববঙ্গ প্রভৃতিতে এটা বেশী পরিমাণে পাওয়া যায়। এই গাছে বৎসরের প্রায় সবসময় ফুল ও ফল হয়। শ্রীহট্ট প্রদেশে এইটিকে নাকি রামগুয়া বলে। এগুলির ফ্যামিলী একই Palmae.
ঔষধার্থে ব্যবহার্য অংশফল, ফল, ত্বক ও শিকড়। কাঁচা সুপারি কষায়ধমী, এতে প্রচুর পরিমাণে ট্যানিক ও গ্যালিক এসিড আছে। সুপারি বল্য, কামোত্তেজক, উত্তেজক ও উল্লাসজনক। এটা খেলে মাথা ঘুরতে থাকে, তারপর ঝিমনি আসে, অনেকে বমিও করেন।
ঔষধার্থে ব্যবহার হয়:
অগ্নিমান্দ্যে, দুষিত ক্ষতে, মুত্রযন্ত্রের বিবিধ পীড়ায়। অন্তধামে দগ্ধ সুপারিতে মাজন তৈরী হয়। অবশ্য সেটাকে মিহি চূর্ণ করে মাজনে মিশাতে হয়।
সুপারি:
ক) দাঁতের ব্যথায়: সুপারি ভস্ম দিয়ে দাঁত মাজলে মাড়ির ব্যথা কমে যায়।
খ) অতিসারে: কাঁচা সুপারি শুকিয়ে, তাকে গুড়া করে ৫০০ মিলিগ্রাম মাত্রায় সকালে ও বিকালে দু’বার খেলে দুর্বলতাজনিত অতিসার উপশম হবে।
গ) ক্রিমিতে: সুপারি চূর্ণ ৫০০ মিলিগ্রাম মাত্রায় দুধসহ সেবন করলে ক্রিমির উপদ্রব কমে যায়, এমনকি ফিতে ক্রিমির উপদ্রবেরও শান্তি হয়। তবে এই মাত্রায় উপকার না হলে আর একবার দেওয়া যায়, তবে বলি মাথা ঘুরতে থাকে তবে দু’বার দেওয়া উচিত নয়।
ঘ) পায়োরিয়ায়: যাঁরা এই রোগে ভুগছেন তাঁরা মাজনের মতো গুড়া দিয়ে দাঁত মাজবেন। এটাতে উপকার হবে।
ঙ) দাঁতের মাড়ি থেকে রক্তপড়া: ইহার কষায় ধর্মিত্বের জন্য মাড়ির রক্তক্ষয় বন্ধ করে।
চ) যোনিস্রাবে: যোনি থেকে জলের মতো যে স্রাব বেরোয়, সেটা বন্ধের জন্য মলতানের মেয়েরা ইহার আভ্যন্তরীণ এবং বাহ্য প্রয়োগ করেন।
ছ) কুকুরের ক্রিমিনাশে: আধখানা সুপারির চূর্ণ মাজনের সঙ্গে মিশিয়ে খেতে দিলে কুকুরের ক্রিমিনাশ হয়। এক বা দুই মাত্রাই যথেষ্ট।
২. কচিপাতা: সুপারির কচি পাতার রস তেলের সঙ্গে মিশিয়ে মালিশ করলে কটিবাতে বিশেষ উপকার পাওয়া যায়।
সুপারি গাছের ঔষধ হিসাবে প্রয়োগ:
প্রথমেই বলে রাখি কাঁচা সুপারি বিকাশি অর্থাৎ পরিপাক হবার পূর্বেই এটি এক ধরনের মত্ততা সৃষ্টি করে, সেজন্য সর্বদা কাঁচা সুপারিকে শুকিয়ে ব্যবহার করতে হয়। সুপারি রসবহ স্রোতে এবং রক্তবহ স্রোতে কাজ করে।
১. কৃমিনাশক: ক্রিমি সাধারণত কফ বিকারের জন্য আমাশয়েও হয় আবার রক্তদৃষ্টিতেও হয়। কেউ শক্তিতে কারর চেয়ে কম নয়। তবে সচরাচর বিষ্ঠাজাত ক্রিমি বড় বিশ্রী উৎপাত করে। এগুলির বর্ণ সাদা, আকারে খুব ছোট ছোট, যাকে চলতি কথায় বলে কুচো বা ঝুরো ক্রিমি। পেটফাঁপা ও অগ্নিমান্দ্যে, বলক্ষয়ে, হৃদক্ষয় এদের উপদ্রব সাধারণতঃ বৃদ্ধি পায় এবং সরলালে সেগুলি অবস্থান করে ও বিষ্ঠার সঙ্গে বেরোয়, সুযোগমতো আবার সুড়সুড়িও দিয়ে থাকে।
এই উপদ্রবটি দেখা দিলেই সুপারি ৪ গ্রাম থেতো করে তাকে ৩ কাপ জলে সিদ্ধ করে ১ কাপ থাকতে নামিয়ে, ছে’কে, সকালে ও বৈকালে ওটাকে দু’বেলায় কয়েকদিন খেলে ওগুলোর উপদ্রব প্রশমিত হবে। তবে বাচ্চাদের জন্য এ পরিমাণ অর্ধেক করতে হবে।
২. আমাশয় সারাতে: রক্তামাশয়ে সাধারণ পেটের দোষকে ঠিকভাবে না সারিয়ে পুষ্টিকর খাদ্য খেলে সেটা কিন্তু শরীরের পক্ষে ক্ষতিকারক হয় আর প্রায় ক্ষেত্রেই এরই পরিণতিতে আসে রক্তামাশা, পেটে যন্ত্রণা, দাস্তের সঙ্গে রক্ত পড়া, তার সঙ্গে কুন্থন ও আম নিঃসরণ। এক্ষেত্রে ঔষধ ও পথ্য সম্বন্ধে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন না করলে আম ও রক্তের বন্ধ হওয়াটাই স্বাভাবিক।
এই ধরনের ক্ষেত্রে যদি বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন না করা যায়, তাহলে আরও রোগের বৃদ্ধি হয়ে থাকে, যেমন— দুর্গন্ধযুক্ত মল-নিঃসরণ, তার কারণ থাকবে অন্ত্রের মাংস ক্ষয়। এর প্রথমাবস্থায় যদি সুপারির ক্বাথ দু’বেলা খাওয়া যায়, তাহলে বিপদটা কেটে যায়। আরও ভাল হবে, ওর সঙ্গে বেলশুঠের চূর্ণ ১ গ্রাম মাত্রায় মিশিয়ে দিলে।
৩. অজীর্ণ দূর করতে: এই রোগে যাঁরা ভুগছেন, তাঁদের ভোরের দিকে পিপাসা লাগে, মাঝে মাঝে শরীরে কামড়ানি, যাকে বলে অঙ্গমদ, সাধারণতঃ এদের একটু, পিপাসা লেগেই থাকে, মুখ দুর্গন্ধ, এছাড়া সর্বদাই যেন মুখটা শুকিয়ে আছে অর্থাৎ মুখে লালাংশ কম হয়ে যায়। অনেকের ধারণা—এটা বোধহয় লিভারের দোষেই হচ্ছে। সুপারির ক্বাথ তৈরী করে দু’বেলা কয়েকদিন খেলে অবস্থাটার উন্নতি হবে।
৪. ঘা সারাতে: ঘা পচে গিয়ে দুর্গন্ধ হয়ে গেলে এবং বিশ্রী স্রাব নির্গত হলে কাচা সুপারি ভালোভাবে শুকিয়ে খোসাসহ থেঁতো করে তার মিহি গুঁড়া ঘায়ে লাগালে ঘা যেমন শুকিয়ে যাবে, তেমনি দুর্গন্ধও দূর হবে।
৫. দাঁতের সমস্যায়: সুপারিতে ফেনোল জাতীয় রাসায়নিক উপাদান রয়েছে, যা দাঁতের ক্যারিস ও পায়োরিয়া সারাতে সাহায্য করে। এছাড়াও অনেক সময় দেখা যায় যন্ত্রণার সঙ্গে সঙ্গে দাঁতে একপ্রকার কালো দাগ পড়তে থাকে, যাকে মনে হয় পোকায় খাওয়া দাঁত। সেইসঙ্গে দাঁতের গোড়াটা ফোলাও থাকে; এইরকম যে ক্ষেত্র, সেখানে সুপারি গাছের শিকড় ও কাঁচা সুপারি (শুকনো) সমভাগে নিয়ে অন্তধমে পড়িয়ে (হাঁড়ির মধ্যে দ্রব্য রেখে মুখটা সরা দিয়ে ঢেকে পোড়াতে হবে) সেই ছাই দিয়ে দু’বেলা দাঁত মাজলে যন্ত্রণাটা চলে যাবে, দীর্ঘদিন ব্যবহার করলে কালো দাগটাও চলে যায়।
৭. রমণে অতৃপ্তি: এযেন পাকা বেল ও কাকের চঞ্চু, মনের অবস্থাটা এইরকম। দাম্পত্য-জীবনে অসুখী, এটা সাময়িক কোন কারণে উদ্ভব হলে তাকে খানিকটা মেরামত করতে পারে যেটা, সেটা হচ্ছে কাঁচা সুপারি কুচি কুচি করে কেটে শুকিয়ে তার মিহিচূর্ণ ১ গ্রাম, ঈষদুষ্ণ দুধ ১ কাপ ও ১ চা-চামচ চিনি একত্র মিশিয়ে সকালে অথবা বৈকালে কয়েকদিন খাওয়ার পর, তারপর দু’বার করে খাওয়া যেতে পারে। কিছুদিন ব্যবহার করলে নিজে উপলব্ধি করতে পারবেন।
৮. অতিসার: যে অতিসারে প্রবল বমনেচ্ছা বা বমি বমিভাব হচ্ছে, তার সঙ্গে মাঝে মাঝে পেটে কুনকুন, ব্যথা আর মুখে অনবরতঃ জল আসতে থাকে; এটাতে বমির ইচ্ছে হলেও বমি হয় না, যেখানে বমি হয়ে যায়, বুঝতে হবে—এর পেছনে অন্য কোন কারণ আছে। এই ধরনের ক্ষেত্রে সুপারি ৪ গ্রাম থেতো করে ৩ কাপ জলে সিদ্ধ করে ১ কাপ থাকতে নামিয়ে, ছে’কে, ঐ ক্বাথটাকে সকালে ও বৈকালে দু’বেলায় খেলে অতিসারেরও উপশম হবে এবং ক্রিমির উপদ্রবও কমে যাবে।
৯. অন্যান্য ব্যবহার: সুপারি ফল পান সহযোগে অনেকে খেয়ে থাকেন। পরিপক্ক গাছ ঘরের জানালার শিক, কাচা ঘরের খুঁটি, চালের ফ্রেম ইত্যাদি তৈরিতে ব্যবহার হয়।
সর্বশেষে এই কথাটা বলে রাখি—আভ্যন্তরিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে সর্বদাই সর্তকতার সঙ্গে মাত্রা নিরূপণ করতে হবে। সুপারি খেতে যাঁরা অনভ্যস্ত, তাঁদের ক্ষেত্রে প্রথমে অর্ধমাত্রায় শুরু করতে হবে। বালক, বৃদ্ধ ও গর্ভিণীর ক্ষেত্রে কোন চিকিৎসকের পরামর্শ ভিন্ন প্রয়োগ করা সমীচীন নয়।
CHEMICAL COMPOSITION
Areca catechu
1. Nuts contain :- (a) Moisture 31.3%; (b) Protein 4.9%; (c) Fat (Ether extract) 4.4%; (d) Carbohydrates 47.2%; (e) Mineral matter 1.0%; Calcium 0.05%; Phosphorus 0.13%; iron 1.5 mg/100 g. 2. Glycerides of :- (a) Lauric acid 50%; (b) Myristic acid 21%; (c) Oleic acids upto 29%. 3. Catechin. 4. Arecoline (Alkaloid, 0.1%). 5. Arecaidine (alkaloid). 6. Guvacoline (alkaloid). 7. Guvacine (alkaloid). 8. The green kernels contain 67% of tannin. 9. The husk contains 47.6% of cellulose.
সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।
তথ্যসূত্রঃ
১. আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য: চিরঞ্জীব বনৌষধি খন্ড ৪, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৩৮৩, পৃষ্ঠা, ৩২-৩৭।
জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ সম্মান ও এমএ পাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। বিভিন্ন সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রোদ্দুরে ডট কমের সম্পাদক।