কার্পাস গাছ ও তুলার সতেরোটি ভেষজ গুণাগুণ

গল্মজাতীয় গাছের মধ্যে কাপাস বনপতি। সাধারণতঃ ৪। ৫ ফুট পর্যন্ত উচু হলেও সারই জায়গায় এটির বাড়-বৃদ্ধি বেশী এবং বহুক্ষেত্রে ১০। ১২ ফুট পর্যন্ত উচু হতে দেখা যায়। হৎপিণ্ডাকৃতি পাতাগলো ৩-৭ ভাগে বিভক্ত, ঠিক যেন হাতের পাঞ্জার মত বিভক্ত। ঘণ্টাকৃতি ফলগুলো সাধারণতঃ হলদে রঙের হলেও, কখনো কখনো সাদা ও বেগুনি রঙের ফুলও ফোটে। ফল গোলাকৃতি এবং ফলের ভেতর সাদা রঙের তুলো লেপটে থাকে। ফলের প্রত্যেক কোষের মধ্যে ৫। ৭টা পর্যন্ত বীজ হতে দেখা যায়। বীজগুলো নয় কালো, নয় সাদা, যাকে বলে শ্যামবর্ণ। বর্ষার পরে ফুল ও ফল হয়, তুলা সংগ্রহ করা হয় ফাগন-চৈত্র মাসে। ঔষধার্থে ব্যবহার্য অংশফল, বীজ, গাছের ও শিকড়ের ছাল।

অন্যান্য নাম:

এর সংস্কৃত নাম কাপাস, কার্পাসী; বাংলানাম কার্পাস, কাপাস, তুলা; হিন্দী নাম: কাপাস, কপাস, রুই; বোটানিকাল নাম: Gossypium herbaceum Linn. ফ্যামিলি Malvaceac. কার্পাস একটি তুলার গাছ। এটি একটি ছোট আকারের উদ্ভিদ। আমাদের দেশে ব্যাপক হারে এর কার্পাস চাষ হয়ে থাকে।[১]

রোগ নিরাময়ে কার্পাস-এর ব্যবহার:

১. ক্ষত সারাতে: ক্ষত বা পুরানো ঘা হলে পোড়া তুলা দিয়ে ক্ষত স্থানে প্রলেপ হিসেবে চাপা দিয়ে তারপর ফালি কাপড় দিয়ে বেঁধে রাখতে হবে। তবে পোড়া তুলা রোজ সকালে ক্ষতের ওপর থেকে তুলে ফেলে আবার নতুন করে পোড়া তুলা ক্ষতের ওপর চাপা দিয়ে ব্যান্ডেজ বাধা দরকার। ৩-৪ দিন এভাবে পোড়া তুলা প্রয়োগ করলে ক্ষত অবশ্যই সেরে যাবে।

২. অণ্ডকোষের সমস্যায়: অণ্ডকোষের জ্বালা যন্ত্রণা হলে শুকনা তুলার বীজের গুড়া ৬০ গ্রাম ৩০ গ্রাম আদা ও সামান্য পানির সাথে বেটে প্রলেপ দিলে উপকার হবে। নিয়মিত কয়েকদিন ধরে প্রয়োগ করা দরকার। এ রোগকে গ্রামবাংলায় কুরও রোগ বলে। রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর প্রলেপ দিলে সব থেকে বেশি উপকার হয়। কারণ চলাফেরা না করার জন্যে প্রলেপের ক্রিয়া ভালভাবে হতে পারে।

৩. প্রস্রাবের সমস্যা সারাতে: প্রস্রাবে কষ্ট ও পরিমাণে কম হলে আয়ুর্বেদশাস্ত্রে এ রোগকে মুত্রকৃচ্ছ বলে। নানা কারণে এ রোগ দেখা দিতে পারে। টাটকা কার্পাস পাতার রস ১০ মিলিলিটার এবং গরুর দুধ ১০০ মিলিলিটার জ্বাল দেয়া; ঠাণ্ডা হয়ে যাবার পরে উভয়কে একসাথে মিশিয়ে রোজ সকালের দিকে একবার করে খেলে উপকার হবে।

আরো পড়ুন:  আগর বা অগুরু গাছের ভেষজ গুণাগুণ ও বিবিধ ব্যবহার

৪. শরীর ফুলে গেলে: আঘাত জনিত কারণে শরীরের কোথাও ফুলে গেলে ও যন্ত্রণা হলে বড় আকারের কার্পাসের পাতা গাছ থেকে তুলে এনে তাতে খাঁটি সরিষার তেল মাখিয়ে আগুনে সামান্য গরম করে ফুলা জায়গায় চেপে বসিয়ে দিতে হবে। পাতা যাতে পড়ে না যায় তার জন্য হালকা করে অর্থাৎ জোরে চাপ না দিয়ে একটা ফালি কাপড়ের টুকরা দিয়ে বেঁধে রাখা দরকার। তিন দিন প্রয়োগ করলেই ফুলা কমবে এবং যন্ত্রণাও থাকবে না।

৫. পাতলা পায়খানা বা ডাইরিয়া সারাতে: উদরাময় বা ডাইরিয়া রোগে কার্পাস গাছের কচি পাতা ৪০ থেকে ৫০ গ্রাম তুলে এনে কোন মাটির অথবা স্টিলের পাত্রে ১৫০ মিলিলিটার পানি দিয়ে সিদ্ধ করতে হবে। পানি ফুটে ৩০ থেকে ৪০ মিলিলিটার পরিমাণ হলে পাত্র আঁচ থেকে নামিয়ে ঠাণ্ডা হলে ছেঁকে নিতে হবে। এ সিদ্ধ-করা পানি তিন থেকে চার ঘণ্টা অন্তর রোগীকে খাওয়ালে উদরাময় রোগের উপশম হবে।

৬. জ্বর সারাতে: উপরক্ত প্রক্রিয়ায় কেবল উদরাময় নয়, জ্বরের ক্ষেত্রেও একই ভাবে দিনে দু’বার এ ঔষধ প্রয়োগ করতে হবে। তাহলে রোগ সারবে; এক্ষেত্রেই এটা একটা মহৌষধ।

৭. কানের সমস্যায়: কানে পুঁজ হলে বা কান পাকা রোগে কার্পাস গাছের কাচা ফলের রস সকালের দিকে তিন ফোটা এবং রাতে শোয়ার সময় একই পরিমাণ প্রয়োগ করলে পুজা পড়া সেরে যায়। তবে রস কানে দেয়াল পর তুলা দিয়ে কানের ফুটা বন্ধ করা দরকার।

৮. কুষ্ঠ রোগে: কুষ্ঠ রোগীদের প্রাথমিক অবস্থায় কার্পাস গাছের মূলের টাটকা ছাল ১০ গ্রাম এবং বার থেকে পনেরটি ফুল সামান্য পানি দিয়ে বেটে কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত স্থানে প্রলেপ দিলে উপকার হয়। তবে দীর্ঘদিন ধরে ধৈর্য সহকারে চিকিৎসা করা দরকার।

৯. আমজাত অতিসারে: আমজাত অতিসারটাই পেটের দোষের প্রথমাবস্থা, এই সময় কার্পাসের মূলের রস গরম করে, ঠাণ্ডা হলে তা থেকে ৩-৪ চা চামচ নিয়ে জল মিশিয়ে প্রত্যহ দুবার খেলেই দুদিনের মধ্যেই এটা সেরে যায়।

১০. শ্বেতপ্রদরে: মেয়েদের সাদা স্রাব হয়, এটাকে আয়ুর্বেদে বলা হয় “শ্বেতপ্রদর”। এই রোগ বেশীদিন চলতে থাকলে ভবিষ্যতে জরায়ুতে দুরারোগ্য ক্ষত (ক্যানসার) রোগও হতে পারে। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে ক্ষয়রোগ পর্যন্ত দেখা দেয় যাকে কনজামশান, বলে। এই রোগে প্রত্যক্ষ ফল পাওয়া যাবে যদি কার্পাসের মূল ৫ গ্রাম অতপ চাল ধোওয়া জলের সঙ্গে বেটে সেটাকে নিংড়ে নিয়ে তা থেকে ২। ৩ চা-চামচ আরও একটু চাল ধোওয়া জলের সঙ্গে মিশিয়ে খেলে রোগের উপশম হবেই, তবে স্বাস্থ্যের পরিবর্তন না হলে এ রোগের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায় না।

আরো পড়ুন:  সাদা তুঁত গাছের নানাবিধ ভেষজ প্রয়োগের বিবরণ

১১. স্তন্যের স্বল্পতায়: এক্ষেত্রে বন কার্পাসের মূলের রস খাওয়ার কথা বলা আছে, কিন্তু বন কাপাস বলতে কোনটি গ্রহণ করতে হবে, সেটা নির্ণয় করা কঠিন; তবে প্রাচীনেরা বলেন দেখতে তুলে গাছের মত, শুঁটিও হয় কিন্তু তাতে তুলো হয়, সেইটাই বনকাপাস। তবুও বনকাপাসের মূল কাঁজি দিয়ে (যাকে সংস্কৃতে কাঞ্জিক বলে) বেটে সেটা ছেকে তা থেকে ২ চা-চামচ একটু চিনি মিশিয়ে প্রত্যহ দু’বার খেলে স্তন্যের স্বল্পতা আর থাকে না।

১২. মনোরোগে: এরা কখনও চুপ করে বসে থাকেন আবার কখনও বা অস্থির হয়ে যান, এদিকে শরীরের কোথাও কিছু গোলমাল হয়নি, এটা করবো ওটা করবো করেন কিন্তু সেটা না করে অন্য একটা করে বসলেন—তাঁরা যদি কাপাসের মূলের ছালের রস এ চামচ ও দুধ দুই-তিন চামচ একসঙ্গে মিশিয়ে প্রত্যহ খান, তবে ২/৪ দিনের পর থেকে এর মানসিক পরিবর্তন যে হচ্ছে সেটা বুঝতে পারবেন।

১৩. পেটের দোষে: কিছু খাওয়ার পর যাঁদের পেট গুড়গুড় করে, মনে হয় আহার্য দ্রব্যগুলি পেটের মধ্যে ঘোড়দৌড় করছে, সেক্ষেত্রে কাপাসের মূলের ছাল ৫ গ্রাম (কাঁচা হলে ১০ গ্রাম) ৩ কাপ জলে সিদ্ধ করে আধ কাপ থাকতে নামিয়ে, ছেকে, সেই কাথটা প্রত্যহ একবার করে খেতে হবে। এইভাবে ২। ৩ দিন খেলেই ওটা প্রশমিত হবে।

১৪. মাসিক ঋতুবদ্ধ: স্বাভাবিক বয়সে ঋতুবন্ধ হওয়ার বহু পূর্বেই এটা বন্ধ হয়ে গিয়েছে বা যাচ্ছে, সেক্ষেত্রে এটি প্রয়োগ করা সমীচীন নয়; কেবলমাত্র সেখানেই ফলপ্রস হবে, যেখানে অস্বাভাবিক কারণে ঋতুবন্ধ হয়েছে। এ রকম কারণ উপস্থিত হ’লে, কাপাসমূল চূর্ণ ৫০০ মিলিগ্রাম জলসহ সকালে ও বৈকালে দু’বার খেতে হবে অথবা কাপাসবীজ চূর্ণ ৬ গ্রামকে দেড়/দু কাপ গরমজলে কয়েকঘণ্টা ভিজিয়ে রেখে সেটাকে ছেকে ৩/৪ বারে ওই জলটা খেতে হবে। এই রকম তিন-চার দিন খেলেই ঋতুস্রাবটা হয়ে যাবে। প্রাচীন বৈদ্যগণের অভিমত যে, এটাতে ২/৩ মাসের গর্ভও নষ্ট হয়ে যেতে পারে।

আরো পড়ুন:  জায়ফল-এর সতেরোটি ভেষজ গুণাগুণ ও প্রয়োগ

১৫. স্তন্য বৃদ্ধিতে: যে কাপাসের তুলোয় কাপড় তৈরী হয়, সেই গাছের পাতার রস ২ চা-চামচ একটু গরম করে সমপরিমাণ দুধ অথবা জল মিশিয়ে প্রত্যহ সকালে ও বৈকালে দু’বার করে খেলে স্তন্য বৃদ্ধি হয়।

১৬. রক্ত আমাশয়ে: আম ও রক্ত দুই-ই যাচ্ছে, সেক্ষেত্রে ২৫০ মিলিগ্রাম কাপাসবীজ চূর্ণ গরমজলসহ প্রত্যহ দু’বার খেলে রক্ত-আমাশায় সেরে যাবে।

১৭. বাতের যন্ত্রণায়: হাত বা পায়ের গাঁটে ব্যথা, যন্ত্রণা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে কাপাস বীজ ও আদা একসঙ্গে বেটে অল্প গরম ক’রে ওই ব্যথায় প্রলেপ দিলে ব্যথা ও যন্ত্রণার উপশম হবে।[১[২]

CHEMICAL COMPOSITION

Gossypium berhaceum

Analysis of cotton :- Cellulose 94%; protein 1.3%; ash 1.2%; pectic substances 9%; wax 6%; sugar .3%; pigments; betaine; choline. waxgossypyl alcohol; ceryl alcohol; esters; fatty acids; amyrins and sterols.[১]

সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।

তথ্যসূত্রঃ

১. আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য: চিরঞ্জীব বনৌষধি খন্ড ৫, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ ১৪০৩, পৃষ্ঠা, ৫১-৫৩।

২. মাওলানা জাকির হোসাইন আজাদী: ‘গাছ-গাছড়ায় হাজার গুণ ও লতাপাতায় রোগ মুক্তি, সত্যকথা প্রকাশ, বাংলাবাজার, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ ২০০৯, পৃষ্ঠা, ১৭৫-১৭৬।

বি. দ্র: ব্যবহৃত ছবি উইকিমিডিয়া কমন্স থেকে নেওয়া হয়েছে। আলোকচিত্রীর নাম: Len Worthington

Leave a Comment

error: Content is protected !!